কার আগে কে টিকা বাজারে নিয়ে আসবে, কে কোন দেশের টিকা কিনবে, তা নিয়ে কূটনীতির চূড়ান্ত প্রতিযোগিতা চলছে।
কার আগে কে টিকা বাজারে নিয়ে আসবে, কে কোন দেশের টিকা কিনবে, তা নিয়ে কূটনীতির চূড়ান্ত প্রতিযোগিতা চলছে।

মতামত

করোনার টিকা যখন রাজনৈতিক অস্ত্র

করোনার টিকা নিয়ে রাজনীতি নতুন মোড় নিয়েছে। বলা যায়, বড় ধরনের ধাক্কাই খেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। স্বেচ্ছাসেবীর শরীরে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্য অক্সফোর্ডের টিকার তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। টিকা তৈরি করা ও বাজারজাত নিয়ে এখন তুমুল প্রতিযোগিতা চলছে কয়েকটি দেশের মধ্যে। কার আগে কে টিকা বাজারে নিয়ে আসবে, কে কোন দেশের টিকা কিনবে, তা নিয়ে কূটনীতির চূড়ান্ত খেলা চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছেন, আগামী ৩ নভেম্বর নির্বাচনের আগেই টিকা চাই। ওদিকে রাশিয়া পূর্বাভাস না দিয়েই হুট করে নিজস্ব টিকার অনুমোদন দিয়ে বসে আছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবমতে, বিশ্বে এখন করোনার ১৮০টি টিকা নিয়ে কাজ হচ্ছে। তবে কোনো টিকাই তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা শেষ করতে পারেনি। তৃতীয় ধাপে এসে অক্সফোর্ডের টিকাও আপাতত আটকে গেল। টিকা পরীক্ষার জন্য এটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। অনেক টিকাই পরীক্ষার বিভিন্ন ধাপে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্য স্থগিত করা হয়। আবার ভুলভ্রান্তি শুধরে পরীক্ষা সম্পন্ন করে বাজারে প্রবেশের অনুমোদনও পায়। তাই অক্সফোর্ডের টিকা বাতিল হয়েছে বা বাতিল করা হবে, এখনই এমনটা বলা সম্ভব নয়; বরং আরও পরীক্ষা–নিরীক্ষার পর তা বাজারে আসতে পারে। সমস্যা অক্সফোর্ডের টিকার মান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে নয়। সমস্যা হচ্ছে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নিজস্ব অবস্থান তৈরি করা নিয়ে।

বহুকেন্দ্রিক বিশ্বে একাধিক পক্ষ নেতৃত্ব দখলের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। যখনই বিশ্ব কোনো নতুন ঘটনার মুখে পড়ে, তখনই বিবদমান দেশগুলো এর সুবিধা নিয়ে নিজস্ব অবস্থান তৈরিতে সক্রিয় হয়। এটা হতে পারে আঞ্চলিক সংঘাত, হতে পারে যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা রোগশোকের মহমারি। এমনকি খেলাধুলার আসরও হতে পারে প্রতিযোগিতার রাজনৈতিক মঞ্চ। রাষ্ট্রের এ ধরনের আচরণে কেবল শক্তিরই বহিঃপ্রকাশ ঘটে না, অর্থনৈতিক সুবিধা লাভের বিষয়ও এখানে সক্রিয় থাকে। শেষ পর্যন্ত রোগের মহামারি, টিকা নিয়ে গবেষণা—সবই রিয়েল পলিটিকস, তথা বাস্তব রাজনীতির অন্তর্গত। এখানে মানবতাবাদ বা আদর্শবাদের চেয়ে রাষ্ট্রের শাসকদের স্বার্থ নিশ্চিত করাই মুখ্য। তাই করোনা মহামারি ও এর টিকা তৈরির সামগ্রিক প্রক্রিয়াকে রিয়েল পলিটিকসের আলোকে বিবেচনা করতে হবে।

করোনা মহামারি বিশ্ব রাজনীতির নতুন উপাদানে পরিণত হয়েছে। মোটা দাগে চারটি দেশ করোনার টিকার রাজনীতিতে খুবই সক্রিয়: চীন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও রাশিয়া। রাশিয়া এ রাজনীতিতে নীরবে–নিভৃতে শেষ মূহূর্তে এসে সবাইকে চমকে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য প্রথম থেকেই করোনার প্রাদুর্ভাবকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেছে। চীনও শুরুতে চেপে যাওয়ার চেষ্টা করলেও পরবর্তী সময়ে করোনা মহামারিকে ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিজস্ব বলয় তৈরির চেষ্টায় লিপ্ত হয়। ডোনাল্ড ট্রাম্প টিকা বাজারে ছেড়ে নির্বাচনী বৈতরণি পার হতে চাইছেন। টিকা দিয়ে বিশ্ব রাজনীতি নিয়ন্ত্রণও করতে চাইবেন ট্রাম্প। ইরানের মতো দেশের সঙ্গে টিকা নিয়ে দর–কষাকষি করে নিজস্ব স্বার্থ হাসিল করতে চাইবে যুক্তরাষ্ট্র। ইরানের ওপর টিকার নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারে এই পরাশক্তি।
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের রাজনীতিটা এখানে ভিন্ন। জনসন ব্রেক্সিট নিয়ে এমনিতেই বেকায়দায় আছেন। অনেক ছেলেভোলানো গল্প দিয়ে তিনি ক্ষমতায় এসেছিলেন। কিন্তু এখন দেখছেন, পরিস্থিতি ভিন্ন। শেষ পর্যন্ত বিনা চুক্তিতেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ করতে পারে ব্রিটেন। এটা ব্রিটেনের জন্য আর্থিক ও বাণিজ্যিক দিক দিয়ে কখনোই সুবিধাজনক হবে না। এ ক্ষেত্রে অক্সফোর্ডে টিকার আবিষ্কার বরিসকে কিছুটা হলেও স্বস্তিতে দম নেওয়ার সুযোগ করে দেবে। আর চীন ও রাশিয়া উভয়েই নিজেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্প হিসেবে প্রমাণ করতে চাইছে। এমনকি কোনো টিকা তৈরি না করেও ভারত টিকার রাজনীতিতে ঢুকে পড়েছে। অক্সফোর্ডের টিকা উৎপাদন করবে ভারতের পুনে সিরাম ইনস্টিটিউট। সেই টিকা কেনার জন্য ভারত বিভিন্ন প্রতিবেশী দেশকে চাপ প্রয়োগ করছে বলে জোর প্রচারণা আছে।
মূলত করোনা রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে আছে টিকার আবিষ্কার ও বাজারজাতকরণ নিয়ে প্রতিযোগী দেশগুলোর কৌশল। শুরু থেকেই টিকা আবিষ্কারে চীনের প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে ছিল। যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড এ দৌড়ে শামিল হয়। পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোও সক্রিয় হয়ে ওঠে। এর পাশাপাশি জার্মানি, ফ্রান্স, জাপানসহ বিভিন্ন দেশে করোনার টিকা তৈরির গবেষণা হচ্ছে এবং অনেক দূর এগিয়েও গেছে। তবে এদের নিয়ে খুব বেশি উচ্চবাচ্য হচ্ছে না। মূল আলোচনা রাশিয়া, চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য ঘিরে।

করোনার টিকা নিয়ে বিশ্ব এখন মোটামুটি দুইভাবে বিভক্ত। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের ওষুধ কোম্পানি। অপর দিকে চীন ও রাশিয়ার প্রতিষ্ঠানগুলো। সবার আগে টিকার অনুমোদন দিয়েছে রাশিয়া। এ সংবাদ প্রকাশের পরপরই পশ্চিমা গণমাধ্যম ও তাদের অনুসারীরা রাশিয়ার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। রাশিয়ার টিকা কতটা মানসম্পন্ন, প্রচলিত নিয়মকানুন মানা হয়েছে কি না, এসব নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ শুরু হয়। অনেকে রাশিয়ার টিকাকে বাতিল করে দিয়েছে।
স্বভাবতই টিকার অনুমোদন দিয়ে রাশিয়া অন্যদের থেকে এগিয়ে আছে। অনেকেই ধারণা করেছিলেন, অক্সফোর্ডের টিকা বাজারে এসে রাশিয়ার টিকাকে টেক্কা দেবে। অনেক দেশই অক্সফোর্ডের টিকা আমদানির পদক্ষেপ নিয়েছিল। আমাদের দেশও টিকা রাজনীতির মধ্যে পড়েছিল। প্রথমে খবর ছিল, চীনের টিকার পরীক্ষা হবে আমাদের দেশে। এ নিয়ে অনেক নাটক, ঝামেলার পর শেষ পর্যন্ত চীনের টিকা পরীক্ষার অনুমোদন মিলেছে। অপর দিকে ভারতের মাধ্যমে অক্সফোর্ডের টিকা আমদানি নিয়েও চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছিল। বেশ কিছু ওষুধ কোম্পানি পুনে সিরাম ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে অক্সফোর্ডের টিকা আমদানির ঘোষণা দিয়েছিল।

এ অবস্থায় অক্সফোর্ডের টিকার পরীক্ষা স্থগিত করা যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের জন্য বড় ধরনের ধাক্কা। অক্সফোর্ডের টিকা আসতে দেরি হলে বাংলাদেশের মতো অনেক দেশই চীন ও রাশিয়ার টিকার দিতে ঝুঁকে পড়বে। এটা রাশিয়া ও চীনকে নতুন ভাবমূর্তি গঠনের সুযোগ করে দেবে। রাশিয়া ও চীন সারা বিশ্বের ত্রাতা বা উদ্ধারকারী হিসেবে আবির্ভূত হবে। অপর দিকে ভারতের মতো যারা অক্সফোর্ডের টিকার পক্ষে দূতিয়ালি শুরু করেছিল, তাদের জন্য পরিস্থিতি হতাশারই বটে।
ড. মারুফ মল্লিক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক