করোনাভাইরাসের টিকা

করোনাভাইরাসের টিকা কবে আসবে, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। কিন্তু যেকোনো সময় এ টিকার পরীক্ষা সফল হবে, সেই সম্ভাবনা বিবেচনায় রাখতে হবে। ভারতের পররাষ্ট্রসচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলার সাম্প্রতিক ঢাকা সফরকালে টিকার বিষয়টি আলোচনায় এসেছিল। টিকার উদ্ভাবন হওয়ামাত্রই বাংলাদেশকে সরবরাহ করার ক্ষেত্রে ভারত তার আগ্রহ স্পষ্ট করেছে। অন্যদিকে আইসিডিডিআরবি ও সিনোভ্যাকের সঙ্গে চুক্তির আওতায় বিনা মূল্যে ১ লাখ ১০ হাজার চীনা টিকা এবং টিকা সরবরাহে রাশিয়া সরকারের আগ্রহের কথাও গণমাধ্যমে এসেছে। কিন্তু টিকা আমদানি, উৎপাদন ও বিতরণ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের নীতি, পরিকল্পনা ও কৌশল কী হবে, সেটা একেবারেই পরিষ্কার নয়।

এই প্রেক্ষাপটে কোভিড-১৯ মোকাবিলাসংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি উপদেষ্টা কমিটি ‘একটির’ পরিবর্তে ‘একাধিক’ বিদেশি উৎস থেকে টিকা সংগ্রহে এখনই ‘অগ্রিম পরিশোধ’ করার পরামর্শ দিয়েছে। অবশ্য এ মতামত প্রশ্নে ভিন্নমত থাকতে পারে। কারণ, একাধিক সংস্থার কাছ থেকে টিকা পেতে অগ্রিম পরিশোধের সঙ্গে বিরাট অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ এবং ঝুঁকির বিষয় বিবেচ্য হতে পারে। তবে সামগ্রিক দিক পর্যালোচনা করে টিকা সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনার বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারকে অবশ্যই তার প্রাথমিক নীতি ও কৌশল চূড়ান্ত করতে হবে। পরে সেটা পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে সমন্বয় করার সুযোগ থাকবে।

স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক মধ্য আগস্টে বলেছিলেন, ‘সবার জন্য একবারে টিকা মিলবে না। প্রথমে স্বাস্থ্যকর্মী, দ্বিতীয় দফায় বয়স্কদের, তারপর সবার জন্য।’ কিন্তু এক মাস অতিক্রান্ত হলেও তিন ধাপে টিকা প্রদানের এ কৌশলের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কোনো পদক্ষেপ সরকারকে নিতে দেখা যায়নি। টিকা অনিশ্চিত। কিন্তু টিকা যখন নিশ্চিত হবে, তারপর বাংলাদেশ সেই প্রস্তুতি নিতে চাইলে পরিস্থিতি লেজেগোবরে হতে পারে। কারণ, টিকা আসার আগে করণীয় অনেক কিছু রয়েছে। বিশেষ করে একটা উপযুক্ত সমীক্ষা দরকার হবে। সে কারণেই বিশেষজ্ঞরা অ্যান্টিবডি টেস্ট কিটের মাধ্যমে ‘সেরো সার্ভিলেন্স’–এর ওপর বেশ জোর দিচ্ছেন। যাতে বোঝা যায় ঠিক কতসংখ্যক মানুষের অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে। কারণ, যঁাদের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে, তাঁদের টিকার দরকার পড়বে না।

দুঃখের বিষয়, এ ধরনের কোনো তৎপরতাই চোখে পড়ছে না। অথচ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে এখনই সতর্ক না হলে হয়তো দেখা যাবে, যাঁদের দেহে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে, তাঁরাও অসাবধানতাবশত বা হুজুগে টিকা নিচ্ছেন। আর যঁার একান্ত দরকার পড়বে, তিনি হয়তো বঞ্চিত হবেন।

টিকা আমদানি ও বিতরণে বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করা একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। প্রতিযোগিতামূলকভাবে কাজটি করতে পারলে একচেটিয়া কর্তৃত্ব আরোপ করার ঝুঁকি কমে। ব্রিটেনের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি এবং অ্যাস্ট্রাজেনেকা কোম্পানির যৌথ উদ্যোগে তৈরি করোনাভাইরাস টিকাকে যথেষ্ট সম্ভাবনাময় মনে করা হচ্ছে। কিছুদিন আগে সেই টিকার ট্রায়াল স্থগিত হলেও আবার চালু হয়েছে। ওই টিকা বাংলাদেশে সরবরাহ করার জন্য ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে বাংলাদেশের একটি বেসরকারি কোম্পানি চুক্তি করেছে। কোম্পানিটি বিবৃতিতে বলেছে, তারা এ টিকা সরবরাহ করবে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, একই টিকা সরকারিভাবেও আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু এ বিষয়ে পরে আর নির্দিষ্ট বা বিস্তারিতভাবে কিছু জানা যায়নি।

আমরা মনে করি, টিকা দেশে আনার পাশাপাশি এর ব্যবস্থাপনার বিষয়টিকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। আবার পরিবহনগত ঝুঁকি বিবেচনায় বিদেশি উৎস থেকে যথাসময়ে টিকা সংগ্রহ অপেক্ষাকৃত বেশি নাজুক বলেই গণ্য হওয়ার কথা। সে কারণে দেশের অভ্যন্তরে যৌথ উদ্যোগে টিকা উৎপাদন নিশ্চিত করার বিকল্প খতিয়ে দেখার বিষয়টিতেও অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।