বাংলাদেশের রাজনীতি এখন সহিংস সংঘাতে ভরপুর। একদিকে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ও সাধারণ মানুষ; অন্যদিকে রয়েছে মৌলবাদী এবং যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থক সন্ত্রাসী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী ও তাদের সমর্থকেরা। এই সংঘাতে বিজয় অর্জিত না হলে বাংলাদেশ পুনরায় ৪২ বছর পিছিয়ে পাকিস্তানি বাংলাদেশে পরিণত হবে। যদিও সেটি হওয়া সহজ নয় বলেই আমি এখনো বিশ্বাস করি।
এখন আওয়ামী লীগ ও জামায়াত উভয়ের দ্বন্দ্ব চরম বৈরিতামূলক দ্বন্দ্বে পরিণত হয়েছে। এই বিশেষ সন্ধিক্ষণে গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রশ্নে কমরেড মণি সিংহের কাছ থেকে তাঁর অনুসারী আমরা কী শিক্ষা পেতে পারি, তা নিয়েই সংক্ষিপ্ত আলোচনা করব।
প্রথমে দেখা যাক, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন কমরেড মণি সিংহ জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজন সম্পর্কে কী বলেছিলেন। স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্রে মণি সিংহের দেওয়া সাক্ষাৎকার থেকে এ বিষয়ে আমরা জানতে পারব। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচন সম্পর্কে কমরেড মণি সিংহ তাঁর সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘নির্বাচনের ফলাফল মূল্যায়ন করে আমরা (কেন্দ্রীয় কমিটি) আরও দেখেছিলাম যে, আওয়ামী লীগ কেবল “পূর্ব পাকিস্তানের” জনগণেরই সর্বাত্মক সমর্থন পায়নি, তৎকালীন পাকিস্তানের সরকার গঠনের অধিকার লাভ করেছে। ...পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলো এবং এই শাসকদের মদদদাতা সাম্রাজ্যবাদ কিছুতেই নির্বাচনের এই ফলাফল মেনে নেবে না এবং তা বানচাল করার ষড়যন্ত্র করবে।...এ অবস্থায় বাংলাদেশ স্বাধীনতাসংগ্রামের দিকেই অগ্রসর হবে এবং সে জন্য জনগণকে প্রস্তুত করা দরকার।’
পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ সেদিকে এগিয়ে গেলে পাকিস্তানের দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মভিত্তিক দল ও শক্তিগুলো পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করে। এই মুষ্টিমেয় অংশকে বাদ দিয়ে স্বাধীনতার প্রশ্নে ব্যাপক জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার প্রশ্ন ১৯৭১ সালে সামনে চলে আসে। তখন বামপন্থীদের মধ্যে দুটি মত বিরাজ করছিল, একটি মত ছিল আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে স্বাধীনতাসংগ্রামে অংশগ্রহণ করা। অপর মতটি মুক্তিযুদ্ধকে দেখছিল ‘দুই কুকুরের লড়াই’ হিসেবে। এই দ্বিতীয় মতটি ‘পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী’ এবং ‘মুক্তিযোদ্ধাদের বাহিনী’ উভয়কেই সমশত্রু জ্ঞান করে সমদূরত্বের নীতির পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছিল।
স্বাধীনতার মতো ‘জাতীয় ইস্যুতে’ জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলে এগোনোর পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন কমরেড মণি সিংহ। ‘জাতীয় ইস্যু’র বিপরীতে বামপন্থী অবস্থানকে তিনি ‘বিভেদাত্মক’ এবং ‘ভ্রান্ত’ বলে অভিহিত করেছিলেন।
‘জাতীয় ঐক্যের’ মধ্যে স্বভাবতই বাম ও ডানপন্থী উভয় প্রকার শক্তি বিদ্যমান থাকে। সেই জাতীয় ফ্রন্ট জনগণের কল্যাণে কতটুকু আসবে, তা সর্বদাই নির্ভর করে ফ্রন্টের ভেতরে শক্তি-ভারসাম্য ও নেতৃত্বের চরিত্রের ওপর। এ বিষয়টি সম্পর্কে কমরেড মণি সিংহ কি সজাগ ছিলেন না? তিনি কি ‘জাতীয় ঐক্যের’ অবস্থান নিতে গিয়ে জাতীয় ফ্রন্টের অভ্যন্তরে কমিউনিস্ট ও বামদের ‘সংগ্রামের’ দিকটিকে ভুলে গিয়েছিলেন বা তার ওপর জোর কম দিয়েছিলেন? এই প্রশ্নটি এখন আমরা বিচার করে দেখব। মণি সিংহ স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্রে প্রদত্ত একই সাক্ষাৎকারের আরেক অংশে লিখেছেন, ‘আমরা আওয়ামী লীগসহ স্বাধীনতার পক্ষের সব শক্তির বৃহত্তম জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে সচেষ্ট ছিলাম। এই প্রচেষ্টা তেমন সফল হয়নি। শেষের দিকে বাংলাদেশ সরকারের “পরামর্শদাতা কমিটি” গঠিত হয় এবং তাতে আমাদের পার্টির প্রতিনিধিরূপে আমি ছিলাম। সশস্ত্র সংগ্রামের অগ্রগতির পর্যায়ে আমাদের উভয় দলের দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য ছিল।....আমরা স্বাধীনতাসংগ্রামকে কেবল জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতাম না।’
এই উদ্ধৃতি থেকে এটা স্পষ্ট যে কমিউনিস্টদের জাতীয় ঐক্যের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার অর্থ জাতীয়তাবাদী হয়ে যাওয়া নয় বা আত্মসত্তা বিসর্জন দেওয়া নয়। নিজস্ব পৃথক বৈশিষ্ট্য ও পৃথক রণকৌশল বজায় রাখার শর্ত মেনে নিয়েই জাতীয় ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে হবে। এখানেই গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন হচ্ছে, ওই ‘জাতীয় ঐক্যের’ সাংগঠনিক সুনির্দিষ্ট রূপটি কী রকম হবে? আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ, আওয়ামী লীগ, জাতীয় কংগ্রেস ও মওলানা ভাসানীকে (ব্যক্তি হিসেবে) নিয়ে গঠিত হয়েছিল ঢিলেঢালা ‘পরামর্শদাতা কমিটি’। এ ছাড়া আওয়ামী নেতৃত্বাধীন গেরিলা বাহিনীগুলোর সঙ্গে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টির গেরিলা বাহিনীর কাজের সমন্বয়ের জন্যও একটি ‘কো-অর্ডিনেশন’ কমিটি গঠিত হয়েছিল।
এ আলোচনা থেকে আমরা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষায় উপনীত হতে পারি। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি বা ফ্যাসিবাদের মতো সুনির্দিষ্ট জাতীয় ইস্যুতে বামপন্থীদের সঙ্গে অন্যান্য শক্তির ব্যাপক ঐক্য গড়ে তোলার ঐতিহাসিক প্রয়োজন রয়েছে, কিন্তু সেই প্রয়োজনীয় ঐক্যের সুনির্দিষ্ট রূপ এমন হতে হবে, যাতে জাতীয় ইস্যুর সমর্থক বামপন্থীদের অন্যান্য উচ্চতর সংগ্রামগুলো চালানোর স্বাধীন সুযোগ ও অধিকার বজায় থাকে। তার মানে ঐক্যের মধ্যে পার্থক্য ও সংগ্রাম এবং সংগ্রামের মধ্যে ঐক্যের বা মিলের একটি যুগপৎতা ঘটিয়ে জাতীয় ইস্যু এবং শ্রেণীসংগ্রামের ইস্যুকে যুগপৎ অগ্রসর করে নিতে হবে। এই যুগপৎতার জটিল কৌশলেরই অনুমোদন আমরা কমরেড মণি সিংহের উল্লিখিত সাক্ষাৎকারে পাচ্ছি।
এই মহান নেতার ২৩তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে জানাই অন্তরের গভীরতম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
এম এম আকাশ: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। akash92@hotmail.com