বাংলাদেশ ইমারত নির্মাণ বিধিমালা, ২০০৬ লঙ্ঘন এবং করপোরেট জগতের অপরাধমূলক অবহেলার কারণে আজ থেকে ১০ মাস আগে, ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারে রানা প্লাজা ধসে এক হাজার ১৩৫ জন শ্রমিক নিহত হয়েছেন। দুই হাজারের বেশি শ্রমিক নানাভাবে আহত হয়ে তাৎক্ষণিক চিকিৎসাসেবা নিয়েছেন। অনেকে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হারিয়ে চিরতরে প্রতিবন্ধী হয়ে গেছেন, যাঁদের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসাসেবা প্রয়োজন। ২৮৫ শিশু হয় মা অথবা বাবাকে হারিয়েছে। আহত এক নারী শ্রমিক পরে যন্ত্রণা-হতাশায় আত্মহত্যা করেছেন।
খবরে প্রকাশ, বিধ্বস্ত রানা প্লাজা থেকে দুই হাজার ৫১৫ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে; তাঁদের মধ্যে ১২ জন পরে হাসপাতালে মারা গেছেন। আরও ১৯৯ জন শ্রমিক এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। এই ভবনধসের শিকার হয়েছেন, কিন্তু তাঁদের পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি, এমন মানুষের সংখ্যা সরকারি হিসাবে ১৩৬। এসব সংখ্যা যোগ করলে দাঁড়ায় তিন হাজার ৯৮৫। অর্থাৎ এই সংখ্যক মানুষ রানা প্লাজা ধসের সময় ভবনটির ভেতরে অবস্থান করছিলেন। নিহত ব্যক্তিদের ডিএনএর নমুনা গ্রহণের পর কবর দেওয়া হয়েছে। নিহত কিংবা এখনো নিখোঁজ শ্রমিকদের আত্মীয়স্বজনের অনেকে ডিএনএ পরীক্ষার ফলের জন্য অপেক্ষা করছেন।
আজ থেকে এক বছর তিন মাস আগে, ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর সাভারে তাজরীন ফ্যাশনস নামের আরেকটি তৈরি পোশাক কারখানায় আগুন লেগে ১১২ জন শ্রমিক নিহত হন। সেখানেও ছিল করপোরেট অবহেলা এবং বাংলাদেশ অগ্নি ও নিরাপত্তাবিষয়ক বিধিবিধান অনুসরণের ঘাটতি।
রানা প্লাজা ধস ও তাজরীন ফ্যাশনসের অগ্নিকাণ্ড—দুটোই বড় ধরনের দুর্ঘটনা। বিপুলসংখ্যক মানুষের প্রাণহানির মধ্য দিয়ে এটাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পে শ্রমিকদের নিরাপত্তাব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে হবে। এমন সংস্কার জরুরি হয়ে পড়েছে, যাতে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়। দুর্ঘটনার শিকার হলে তাঁদের ক্ষতিপূরণ প্রদানে চলমান গাফিলতি এবং স্বল্প পরিমাণে ক্ষতিপূরণ প্রদানের বিষয়গুলো পরিবর্তনেও আইনি সংস্কার সাধন জরুরি হয়ে পড়েছে।
এ মুহূর্তের একটি বড় অগ্রাধিকার হওয়া উচিত উল্লিখিত দুটি দুর্ঘটনায় নিহত বা আহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ পরিশোধ করা। ইতিমধ্যেই যে বিলম্ব হয়ে গেছে, তার ফলে অনেক শ্রমিকের পরিবার অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশার শিকার হয়েছে। অথচ এই শ্রমিকদের শ্রমের ফসল দিয়ে ইউরোপ-আমেরিকার অন্তত ৩০টি নামকরা কোম্পানির তৈরি পোশাক সরবরাহ করা হয়; এই শ্রমিকদের শ্রমে ও ঘামেই বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের চাকা সচল রয়েছে।
রানা প্লাজা ধসের পর প্রাথমিক উদ্ধার তৎপরতা শেষ করা হয়েছে এক মাসের মধ্যেই। শ্রমিকদের মধ্যে ৩৩৯ জন গুরুতরভাবে জখম হয়েছেন, তাঁদের বড় ধরনের অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়েছে। অনেকে গুরুতর আঘাত পেয়েছেন মাথায়, কোমর ও মেরুদণ্ডে। তাঁদের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা প্রয়োজন। কয়েক সপ্তাহ পরে যেসব শ্রমিককে হাসপাতাল থেকে বিদায় দেওয়া হয়েছে, তাঁরা এখনো কাজে ফিরে যেতে অক্ষম। তাঁদের কেউ কেউ হয়তো আর কখনোই কাজে ফিরে যেতে পারবেন না। কারণ, তাঁরা কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন।
শ্রমিকদের টিকে থাকা এখনো একটা অনিশ্চিত ব্যাপার। আহত শ্রমিকদের পুনর্বাসনের জন্য কী করছি আমরা? কী করছি নিহত শ্রমিকদের এতিম ছেলেমেয়েদের জন্য, তাঁদের পরিবার-পরিজনের জন্য? অস্থায়ী ভিত্তিতে কিছু টাকাপয়সা হয়তো দেওয়া হয়েছে; কিন্তু এটা কোনোভাবেই ন্যায্য ক্ষতিপূরণের বিকল্প হতে পারে না। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, রানা প্লাজার জন্য প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ ত্রাণ তহবিলে ১২৭ কোটি টাকা জমা পড়েছে। প্রায় ৭০০ শ্রমিকের প্রত্যেকে সাত লাখ টাকা করে পেয়েছেন। আরেক খবরে প্রকাশ, প্রাইমার্ক, লবল ও বন মার্শ—এই তিনটি কোম্পানি এক হাজার ৬২৯ জন শ্রমিকের প্রত্যেককে ছয় মাস ধরে মাসিক পাঁচ হাজার টাকা করে দিয়ে আসছে। কিন্তু যেসব পরিবারের একেকজন সদস্য মাসে পাঁচ থেকে আট হাজার টাকা করে উপার্জন করতেন, তাঁদের জন্য এই অর্থ পর্যাপ্ত নয়।
শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ নির্ধারণের প্রক্রিয়াটি দীর্ঘায়িত করা হচ্ছে। দুর্ঘটনার পরপরই, ২০ এপ্রিল হাইকোর্ট ক্ষতিপূরণের দাবিদাওয়া মূল্যায়ন করার লক্ষ্যে একটি কমিটি গঠনের নির্দেশনা দিয়েছিলেন উদ্ধার তৎপরতায় থাকা জিওসিকে। কিন্তু সেই নির্দেশনা আমলে নেওয়া হয় কেবল গত সেপ্টেম্বরে, যখন হাইকোর্ট আবার সেটি স্মরণ করিয়ে দেন। জিওসি দুটি কমিটি গঠন করেন। একটি কী প্রক্রিয়ায় ক্ষতিপূরণ করা হবে তা নির্ধারণের উদ্দেশ্যে; অন্যটি আহত শ্রমিকদের পুনর্বাসনের চাহিদা নিরূপণের লক্ষ্যে। অন্যান্য দেশে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন দুর্ঘটনা ও সেগুলোর ক্ষতিপূরণ প্রদানের দৃষ্টান্তগুলো খতিয়ে দেখার পর ক্ষতিপূরণ কমিটি ট্রেড ইউনিয়নগুলোর সঙ্গে পরামর্শ না করেই নিহত ও গুরুতর আহত শ্রমিকদের প্রতিটি পরিবারের জন্য ১৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং অন্যান্য আহত শ্রমিকদের জন্য আরও কম অঙ্কের ক্ষতিপূরণ নির্ধারণের সুপারিশ করে।
অল্প বয়সী এসব শ্রমিকের প্রত্যাশিত আয়ু, তাদের ওপর চার থেকে ছয় সদস্যের এক-একটি পরিবারের নির্ভরশীলতা, চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যয় এবং তাদের দুঃখ, যন্ত্রণা ও ভোগান্তি বিবেচনায় নিলে ওই কমিটির হিসাবকে নিতান্তই কম ও অপর্যাপ্ত বলে মনে হয়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার মাপকাঠি ও বাংলাদেশের সর্বোত্তম অনুশীলনগুলোর ওপর ভিত্তি করে ইন্ডাস্ট্রি অল বাংলাদেশ নামের একটি সংগঠন ও শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ সুপারিশ করেছিল, শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দুই কোটি ৮০ লাখ পর্যন্ত হওয়া উচিত। ক্ষতিপূরণ কমিটি আরও সুপারিশ করে যে ক্ষতিপূরণ প্রদানের তহবিলে ক্রেতা ব্র্যান্ডগুলো, বিজিএমইএ, কারখানার মালিকেরা ও সরকার অংশ নেবে যথাক্রমে ৪৫: ১৮: ২৮: ৯ অনুপাতে।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এক সভায় রানা প্লাজায় আহত এক নারী শ্রমিকের লাগানো দুটি কৃত্রিম হাত প্রদর্শন করা হয়। দেখতে সেগুলো স্বাভাবিক বটে, কিন্তু এমন অনমনীয় যে হাত দুটি ব্যবহার করে তিনি কোনো কাজ করতে পারেন না। হতাহত শ্রমিকদের ছেলেমেয়েরা অর্থের অভাবে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারছে না। অনেক আহত শ্রমিক জানিয়েছেন, তাঁরা চিকিৎসা নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। কারণ, চিকিৎসার খরচ জোগানোর
মতো আর্থিক সংগতি তাঁদের নেই। কিছু শ্রমিক ও তাঁদের পরিবার-পরিজন ক্ষতিপূরণ পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়ে নিজেদের গ্রামে ফিরে গেছেন।
আন্তর্জাতিক বাজারের কারণে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের রপ্তানি-বাণিজ্য বিরাট এক সাফল্য বয়ে এনেছে। তাজরীন ফ্যাশনস ও রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর এই শিল্পের যে ক্ষতি হয়েছে, আমরা সে জন্য আফসোস করেছি; বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের ওপর এর ক্ষতিকর প্রভাবের আশঙ্কায় ভুগেছি। কিন্তু যেসব শ্রমিক নিহত হয়েছেন, যাঁদের শ্রমে-ঘামে এই শিল্পের এত সাফল্য, তাঁদের ও তাঁদের পরিবারবর্গের জন্য আমরা কী প্রতিবিধানের ব্যবস্থা করেছি? আমরা তাঁদের কী ক্ষতিপূরণ দিয়েছি?
তৈরি পোশাক-বাণিজ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে অর্থসাহায্য বা চাঁদা গ্রহণের জন্য আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থাকে ট্রাস্টি করে রানা প্লাজা ট্রাস্ট ফান্ড নামে একটি তহবিল গঠন করা হয়েছে। যে ৭০টি ইউরোপীয় ক্রেতা প্রতিষ্ঠান অগ্নি ও নিরাপত্তাবিষয়ক চুক্তিতে সই করেছে, তাদের অঙ্গীকার রক্ষা করা উচিত।
তুবা গ্রুপের (তাজরীন ফ্যাশনসের মালিক) মতো তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান, যাদের অনেকগুলো করে কারখানা রয়েছে, তাদের অবশ্যই দায়িত্ব নিতে হবে, যেমন দায়িত্ব নিতে হবে বিজিএমইএর সদস্যদেরও। কয়েকটি ব্যাংক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ দানের অর্থ জমা পড়েছে। বিজিএমইএর সদস্যরাও একটি তহবিল সংগ্রহ করেছেন।
সুতরাং তহবিল-ঘাটতির কোনো অজুহাত থাকা উচিত নয়। ক্ষতিপূরণ প্রদানের প্রতিশ্রুতি পূরণ না করার কোনো কারণ থাকতে পারে না। যাঁরা তৈরি পোশাক রপ্তানির বৈশ্বিক বাণিজ্য থেকে লাভবান হয়েছেন ও হচ্ছেন, তাঁদের অবশ্যই তাঁদের ভুলত্রুটির ক্ষতি পূরণ করতে হবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
হামিদা হোসেন: আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারপারসন।