যেকোনো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন—বাংলাদেশে আন্তসীমান্ত নদ–নদীর সংখ্যা কত? এর সঠিক উত্তর হিসেবে গ্রহণ করা হয় ৫৭টি। অথচ এটি ভুল উত্তর। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নদ–নদীবিষয়ক ভুল পাঠ দান করা হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের জানানো হচ্ছে, আন্তসীমান্ত নদ–নদীর সংখ্যা ৫৭টি। কোনো পরীক্ষার্থী যদি উত্তরপত্রে এ তথ্যের বাইরে প্রকৃত তথ্য দিয়ে থাকে, তাহলে পরীক্ষকই হয়তো ওই পরীক্ষার্থীকে ভুল হিসেবে চিহ্নিত করবেন। আন্তসীমান্ত নদ–নদীতে অভিন্ন অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এর প্রকৃত সংখ্যা জানা জরুরি।
নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকীর মতে, আন্তসীমান্ত নদ–নদীর সংখ্যা শতাধিক। নদী বিশেষজ্ঞ ম. ইনামুল হকের মতে, এ সংখ্যা ১৭১টির বেশি। আন্তসীমান্ত নদ–নদীর সংখ্যা কত, সেটি জানতে আমাদের কত বছর লাগবে, আমরা এখনো জানি না। সরকারিভাবে কখনো সে সংখ্যা জানার চেষ্টা হয়েছে বলে মনে হয় না। স্বীকৃত আন্তসীমান্ত ৫৭টি নদ-নদীর মধ্যে ভারতের সঙ্গে ৫৪টি এবং মিয়ানমারের সঙ্গে ৩টি। বাংলাদেশ-ভারত আন্তসীমান্ত নদ-নদীর মধ্যে কুলিক নামের একটি নদ বাংলাদেশে উৎপন্ন হয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে আর বাকি ৫৩টি ভারতে উৎপন্ন হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
বাংলাদেশ-ভারত আন্তসীমান্ত নদ-নদীর সংখ্যা কোনোভাবেই ৫৪টি নয়। রংপুর বিভাগের ৮টি জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া আন্তসীমান্ত স্বীকৃত নদ-নদীর সংখ্যা বলা হয়েছে ১৮টি। সেগুলো হলো ব্রহ্মপুত্র, জিঞ্জিরাম, দুধকুমার, ধরলা, তিস্তা, বুড়িতিস্তা, দেওনাই, ঘোড়ামারা, তালমা, করতোয়া, ডাহুক, মহানন্দা, কুলিক, নাগর, টাঙন, তেঁতুলিয়া, পুনর্ভবা ও আত্রাই।
আমি সরেজমিন অনুসন্ধান করে রংপুর বিভাগে এখন পর্যন্ত পেয়েছি ৩৯টি আন্তসীমান্ত নদ-নদী। রংপুর বিভাগে স্বীকৃতি না পাওয়া আন্তসীমান্ত নদ-নদীগুলো হচ্ছে কুড়িগ্রাম জেলায় ধরণী, কালো, গদাধর, গঙ্গাধর, নওল, নীলকমল, বারোমাসি, ফুলকুমার, তোর্সা, কালজানি, সংকোশ ও গিরাই। লালমনিরহাট জেলার স্বীকৃতিবিহীন আন্তসীমান্তীয় নদ-নদী গিদারি, মালদাহা, সানিয়াজান, সিংগিমারী। পঞ্চগড় জেলার স্বীকৃতিবিহীন আন্তসীমান্তীয় নদ-নদী কুরুম, যমুনা ও চাওয়াই। শুধু রংপুর বিভাগেই ৫৪টির বাইরে আরও ১৯টির মধ্যে ১৮টির পাড়ে আমি নিজেই গিয়েছি। যে আন্তসীমান্তীয় নদ-নদীগুলো স্বীকৃতি পায়নি, সেগুলোর মধ্যে সবই ছোট নদ-নদী নয়। বড় নদ-নদীও আছে। গঙ্গাধর, কালজানি বড় নদ-নদী। বাংলাদেশ-ভারত আন্তসীমান্তীয় সব নদ-নদীর স্বীকৃতি থাকা জরুরি।
সরকারের পক্ষে আন্তসীমান্ত নদ-নদীর সংখ্যা জানা সহজ হলেও নদী নিয়ে সরকারিভাবে যাঁরা কাজে নিয়োজিত, তাঁদের ওপর আস্থা রাখা কঠিন। কারণ, দেশ স্বাধীন হওয়ার অর্ধশত বছরে কোনো সংস্থাকে নদ-নদী সুরক্ষার কাজে আস্থা অর্জন করতে দেখা যায়নি। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের নদীবিষয়ক কাজ দৃশ্যমান হয়ে উঠলেও তা কতখানি তার অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হবে, তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার অর্ধশত বছর পর আমরা দেখছি, দেশের নদীপথ ২৪ হাজার কিলোমিটার থেকে ৬ হাজার কিলোমিটারে নেমে এসেছে। গত দুই বছরে অনেক নদ-নদী খনন করা হলেও জলপথ হিসেবে সেগুলো হয়ে ওঠেনি। এ অর্ধশত বছরে অনেক নদ-নদী বাংলাদেশের নদ-নদীর মানচিত্র থেকে মুছে ফেলা হয়েছে। ১৯৪০ সালের সিএস নকশায় যত নদ-নদী আছে, বাস্তবে তত নদ-নদী নেই। উজানের দেশ ভারত যদি নদীর খাত পরিবর্তন করে দেয়, ভাটিতে আমাদের দেশে ওই নদীগুলো নিশ্চিহ্ন হতে সময় লাগবে না। বাংলাদেশের নদীখেকোরা সেই অপেক্ষায় থাকে। আন্তসীমান্ত প্রতিটি নদ-নদীর স্বীকৃতি এবং যৌথ নদী ব্যবস্থাপনা নদী ও জীবনের স্বার্থে অপরিহার্য।
আমাদের আন্তসীমান্ত নদ-নদীর সংখ্যা সুচারুরূপে নিরূপণ করতে হলে অবশ্যই সীমান্তবর্তী এলাকায় অনুসন্ধান করতে হবে। সরকার প্রয়োজন মনে করলে সীমান্তবর্তী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, সহকারী ভূমি কর্মকর্তা, উপসহকারী ভূমি কর্মকর্তা, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা এবং স্থানীয়ভাবে যাঁরা নদ-নদীর প্রকৃত খবর রাখেন, তাঁদের মাধ্যমে দ্রুততম সময়ের মধ্যে দেশের সব আন্তসীমান্ত নদ-নদীর তালিকা চূড়ান্ত করা সম্ভব। যাঁরা নদ-নদী নিয়ে কাজ করেন, এমন উপযুক্ত ব্যক্তিদের সহায়তায় আন্তসীমান্ত নদ-নদীর সংখ্যা চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
বাস্তবে কোনো নদ-নদীর স্বীকৃতি না হলে যে সেগুলো আন্তসীমান্ত নয়, তা–নয়। তারপরও বাংলাদেশ-ভারত-মিয়ানমার আলোচনা এবং আন্তদেশীয় ব্যবস্থাপনার জন্য সেগুলোর স্বীকৃতির ব্যবস্থা করতে হবে। বর্তমানে নদ-নদী নিয়ে কোনো দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা নেই বললেই চলে। অভিন্ন নদ-নদীতে, অভিন্ন অধিকার প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত-মিয়ানমারের দ্বিদেশীয় আলোচনার কোনো বিকল্প নেই। সে আলোচনার জন্য আন্তদেশীয় নদ-নদীর প্রকৃত সংখ্যা আমাদের জানতেই হবে।
অর্ধশত বছরে আন্তসীমান্ত নদ-নদীর তালিকা না হওয়া কোনো অজুহাতেই মানার মতো নয়। ভাটির দেশ হিসেবে তাই এ সংখ্যা আমাদেরই চিহ্নিত করতেই হবে।
● তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক
wadudtuhin@gmail.com