দিলওয়ার বাংলাদেশের কাব্যধারার এক উজ্জ্বল পুরুষ, আজীবন করে গেছেন সাহিত্যসাধনা, কবিতায় আলাদা কণ্ঠ হিসেবে তাঁকে মান্য না করে আমাদের উপায় নেই, অথচ আপন কাব্যখ্যাতি কিংবা কাব্যস্বীকৃতি নিয়ে তিনি কখনো বিশেষ বিচলিত বোধ করেননি। তাঁর সম্পর্কে যখন যেটুকু আলোচনা হয়েছে কপালে জুটেছে ‘সিলেটের কবি’ অভিধা, প্রকাশ্যে না বললেও মফস্বলের কবি হিসেবে প্রায়ই তাঁকে গণ্য করা হয়েছে। সদর ও মফস্বলের ধারণা কলোনি আমাদের দিয়েছে, ইংরেজি অভিধানেও মফস্বল ক্রমে জায়গা করে নিয়েছে এবং এই ধারণায় কেন্দ্র ও প্রান্তিকতা, উচ্চ ও নিম্নতার যে বোধ, তা বাঙালিমানসে প্রায় স্থায়ী হয়ে আছে। অথচ কাব্য বিষয় আহরণে দিলওয়ার সর্বদা বৃহত্তর দুনিয়ার দিকে হাত বাড়িয়েছেন এবং আজীবন এই ছিল তাঁর ব্রত। নবীন বয়সে ১৯৫৩ সালে সুহূদদের উৎসাহে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ জিজ্ঞাসা, অনেকটাই কাঁচা হাতের লেখা, তার পরও সেখানে সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে উৎসর্গ করা কবিতা যেমন রয়েছে, তেমনি আছে কেনিয়ার মাউ মাউ বিদ্রোহীদের বন্দনা। তবে শিগগিরই দিলওয়ার নিজস্ব কাব্যভাষা ও কবিকণ্ঠ খুঁজে পান এবং ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত ঐকতান বড়ভাবে সেই পরিচয় মেলে ধরে। গ্রন্থভুক্ত প্রথম কবিতা সেই বিখ্যাত সনেট, কিনব্রিজে সূর্যোদয়, সনেটের আঁটসাঁট বন্ধনের মধ্যে তিনি যেন সুরমার শান্ত প্রবাহ বয়ে আনলেন, সূর্যবন্দনার ঐতিহ্যের অনুগত থেকে পূর্ববাংলায় নতুন ভোরের পূর্বাভাস বুঝি হয়ে উঠেছিল সেই কবিতা। নদীকে আবাহন করে তিনি লিখতে পেরেছিলেন ধারালো পঙিক্ত, ‘সৃষ্টির পলিতে সেই বীজ বোনে অক্ষর প্রজ্ঞার।’ সেই ষাটের দশকের সূচনায় লিখেছেন আরেক সনেট নেলসন ম্যান্ডেলাকে উদ্দিষ্ট করে, বলেছেন আফ্রিকা কীভাবে হয়ে উঠছে দীপ্তকণ্ঠ পল রোবসন।
দিলওয়ারের এই কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের সময় বন্ধুজনেরা একটি ছোট্ট ভূমিকা সংগ্রহ করেছিল রণেশ দাশগুপ্তের কাছ থেকে। তিনি খুব তাৎপর্যময়ভাবে নবীন কবি সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘তাঁর লেখাতে ঘোষণার চেয়ে সান্ত্বনার দিকে ঝোঁক বেশি। তাঁর লেখায় একটা ঘরোয়া আলাপের ভাব আছে। ভাব আছে রেস্তোরাঁর ভিড়ের মধ্যেও বন্ধুর সঙ্গে মৃদুকণ্ঠে আলাপ করার। ভাব আছে সৌহার্দ্যের। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে বাস্তবের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা আছে কোথাও। বরং জানালা বাইরের পৃথিবীর জন্য খোলা। জানালা অনেক; কিন্তু বাসাটি ছোট। মাটির ঘর।’
কবি হিসেবে দিলওয়ার আজীবন মাটির ঘরেই বসবাস করেছেন এবং অনেক কটা জানালা রেখেছেন খোলা। তিনি ঢাকায় এসে সংবাদ পত্রিকায় কাজ করেছেন বছর দুয়েক, আবার ফিরে গেছেন তাঁর মাটির ঘর সিলেটে। স্বাধীনতার পর আবার ঢাকায় কিছুকাল কাজ করেছেন সোভিয়েত দূতাবাসের তথ্য বিভাগে। তবে রাজধানীতে থাকার আকুতি কখনো তাঁর মধ্যে কাজ করেনি, তিনি অচিরে ফিরে গেছেন আপন স্বস্তির ঘরে, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মতো তাঁকে কখনো বলতে হয়নি, ‘আমাকে তুই আনলি কেন, ফিরিয়ে নে।’
কবি দিলওয়ারের সঙ্গে দীর্ঘকাল দেখা-সাক্ষাৎ না হলেও শ্রদ্ধা ও স্নেহের পারস্পরিক এক অন্তঃসলিলা প্রবাহ সব সময় বহমান ছিল। চলতি বছরের শুরুতে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের কার্যোপলক্ষে সিলেট যাওয়া হলে সুপ্রিয় চক্রবর্তী, আমাদের রঞ্জুদাকে বলে রেখেছিলাম, দিলওয়ার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা না করে ফিরব না। ‘খান মঞ্জিল’-এ কবির সঙ্গে সেই সাক্ষাৎ জীবনের এক বড় পাওয়া হয়ে আছে। দিলওয়ার ভাইয়ের সঙ্গে মার্কিন লেখক নরম্যান রস্টেনের যোগাযোগের কথা কিছু জানা ছিল, তবে এর ব্যাপ্তি ও গভীরতা জানতে পারলাম এবারের সাক্ষাতে। কবি হিসেবে দিলওয়ার যেমন ঢাকাকে উপেক্ষা করতে পেরেছেন, তেমনি তিনি নরম্যান রস্টেনের সঙ্গে তাঁর হার্দিক সম্পর্ক নিয়ে কখনো উচ্চকিত হননি। রস্টেন বিশ শতকের এক প্রধান মার্কিন লেখক, নাট্যকার আর্থার মিলারের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের তিনি একজন, নিউইয়র্কবাসী রস্টেনের কবিতার পঙিক্ত খোদাই করা আছে ব্রুকলিন ব্রিজের গোড়ায়। নরম্যান রস্টেন স্পেনের গৃহযুদ্ধে প্রজাতন্ত্রীদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে হাওয়ার্ড ফাস্ট, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, জন ডস প্যাসোস প্রমুখ সাহিত্যিকের সঙ্গে একত্রে কাজ করেছেন। ডেথ অব এ সেলস্ম্যান-এর লেখক আর্থার মিলার যখন হলিউডের লাস্যময়ী নায়িকা মেরিলিন মনরোকে বিয়ে করেন, তখন রস্টেন দম্পতি ছিলেন মুষ্টিমেয় অতিথিদের একজন। রস্টেনের সঙ্গে মেরিলিন মনরোর যে অকৃত্রিম বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, সেটা আর্থার মিলারের সঙ্গে বিচ্ছেদের পরও অব্যাহত ছিল। মেরিলিন মনরো অনেক ব্যক্তিগত বিষয় ভাগ করে নিয়েছিলেন রস্টেনের সঙ্গে, যে গুটিকয় কবিতা তিনি লিখেছিলেন, সেটা রস্টেনের কাছেই গচ্ছিত ছিল। মেরিলিনের আত্মহত্যার বেশ কিছুকাল পর লেখা রস্টেনের বই মেরিলিন: অ্যান আনটোল্ড স্টোরি হলিউডের এই নায়িকা সম্পর্কে লেখা শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হিসেবে নন্দিত হয়েছে।
নরম্যান রস্টেনের সঙ্গে দিলওয়ারের যোগাযোগের কাহিনিও বিস্ময়কর। মেরিলিনের আত্মহত্যার পর মার্কিন ম্যাগাজিন লাইফ-এ যে ফটোস্টোরি পত্রস্থ হয়, এর রচয়িতা ছিলেন নরম্যান রস্টেন। ওই রিপোর্ট পাঠান্তে দিলওয়ার শনাক্ত করতে পেরেছিলেন গ্ল্যামারের অন্তরালের বিষাদ, তিনি ইংরেজিতে লিখে ফেলেন ছোট এক কবিতা এবং পাঠিয়ে দেন লাইফ ম্যাগাজিনের ঠিকানায়। এই কবিতা পাঠে চমকে উঠেছিলেন নরম্যান রস্টেন এবং সেই যে গড়ে ওঠে দিলওয়ারের সঙ্গে সখ্য, সেটা আশির দশকে নরম্যানের মৃত্যু অবধি বজায় ছিল। দিলওয়ারের ঘরের দেয়ালে রয়েছে নরম্যান রস্টেনের বড় এক ছবি। নরম্যানের স্বাক্ষরিত বিভিন্ন বই, কবিকে দেওয়া উপহার, তিনি আমাকে এনে দেখালেন।
মেরিলিন মনরো আমেরিকার সাংস্কৃতিক ইতিহাসের এক রহস্য, তাঁর সঙ্গে মার্কিন সমাজের বোঝাপড়া এখনো অসমাপ্ত রয়ে গেছে। অ্যান্ডি ওয়ারহল মেরিলিনের প্রতিকৃতি এঁকে পপ-কালচারের সূচনা করেছিলেন। পিট সিগার্স তাঁর আসল নাম নিয়ে বেঁধেছিলেন অনেক জিজ্ঞাসার জন্মদাতা গান, ‘হু কিল্ড নর্মা জিনস, হোয়াই সি হ্যাড টু ডাই।’ আর আমাদের কাছে যিনি সিলেটের কবি, নরম্যান রস্টেনের কাছে তিনি নিশ্চয় বাংলার কবি, সেই দিলওয়ার লিখেছিলেন হূদয়-নিংড়ানো কবিতা, এ গ্ল্যান্স অব এম.এম.। লিখেছিলেন, ‘ইউ মে কল হার/ অ্যা ব্যাড গার্ল/ অ্যা ম্যাড গার্ল/ অ্যা মরবিড হিউম্যান ফ্রাইট/ বাট আই নো, ও লিসন টু মি/ সি ইজ এ স্যাড গার্ল/ অ্যা রেড গার্ল/ অব জোডিয়াক্যাল লাভ অ্যান্ড লাইট।’
মধ্যের পঙিক্তগুলো নিম্নরূপ: ‘হোয়েন দা নাইট ইজ ডিপ/ অ্যান্ড স্লিপ ইজ রেয়ার/আই ফাইন্ড হার হার্ট স্যাড/ আই ফাইন্ড হার ইন প্রেয়ার/ সো আই নো, ও লিসন টু মি/ সি ইজ অ্যা স্যাড গার্ল/ অ্যা রেড গার্ল/ অ্যা জোডিয়াক্যাল অব লাভ অ্যান্ড লাইট।’
যখন আমেরিকাতেও খুব সামান্য কজন ব্যক্তিত্ব উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন গ্ল্যামার-কন্যা মেরিলিন মনরোর অন্তর্গত বিষাদ, তখন বাংলার এক সংবেদনশীল কবি হয়েছিলেন সেই বেদনার রূপকার এবং সেই সুবাদে মেরিলিন-সুহূদ লেখক নরম্যান রস্টেনের সঙ্গে তাঁর গড়ে ওঠে নিবিড় বন্ধুত্ব। একজন বড় মাপের মানুষ ও কবি হিসেবে এই কাহিনি ফেরি করে বেড়াননি কবি দিলওয়ার, আজ তাঁর প্রয়াণে সেই কথাগুলো মেলে ধরতে হলো এ কারণে যে, মেরিলিন মনরোকে বুঝতে মার্কিন সমাজের লেগেছিল কয়েক দশক, দিলওয়ারকে বুঝতেও আমাদের প্রয়োজন হবে তেমনি সাধনার। সে জন্য প্রয়োজন মাটির ঘর, যার অনেক কটা জানালা খোলা।
মফিদুল হক: লেখক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।