কূটনীতি

ওবামা-রুহানি ফোনালাপের পর কী?

বারাক ওবামা, হাসান রুহানি
বারাক ওবামা, হাসান রুহানি

যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগের বিষয়টি কেবল দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নয়ন নয়, বিশ্ব কূটনীতিতেও একটি ইতিবাচক ঘটনা বলে মনে করি। উল্লেখ্য, ১৯৭৯ সালে থেকে এই দুটি দেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। সাড়ে তিন দশকের অচলাবস্থা কাটিয়ে যদি ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে, তা হবে বর্তমান বিশ্বে এক যুগান্তকারী ঘটনা। এবারে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভাষণ দিতে গিয়ে ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি যে নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি দেখিয়েছেন, তা পশ্চিমা কূটনীতিক মহলে প্রশংসা কুড়িয়েছে। অনেকে ভেবেছিলেন, জাতিসংঘের মহাসচিবের দেওয়া ভোজসভায় মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তাঁর কুশল বিনিময় হবে। কিন্তু সেটি হয়নি। ইরানি প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি নিউইয়র্ক ত্যাগের আগে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলার আগ্রহ প্রকাশ করলে হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তারা তাঁদের মধ্যে টেলিফোন সংযোগ করিয়ে দেন। দুই প্রেসিডেন্ট ১৫ মিনিট কথা বলেন। এর আগে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি ও ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জাফরির মধ্যে বৈঠক হয়েছে; যদিও সেটি একান্ত বৈঠক ছিল না। তাঁদের সঙ্গে আরও কয়েকটি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা যোগ দিয়েছিলেন। এই সাম্প্রতিক ঘটনাবলি বিশ্ব কূটনীতিতে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে প্রতীয়মান হয়। ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের নেতাদের মধ্যকার বৈঠক ও টেলিফোন সংলাপের প্রভাব কেবল সংশ্লিষ্ট দুটি দেশের বৈরিতা অবসানেই ভূমিকা রাখবে না, এই অঞ্চলের ভূ-রাজনীতি ও কূটনীতির গতিধারাও বদলে দিতে পারে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ চলছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামেও তারা একে অপরের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়ে থাকে। এমনকি ইরানের বন্ধু দেশগুলোকেও যুক্তরাষ্ট্র সন্দেহের চোখে দেখে। এ অবস্থায় দুটি দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে সরাসরি যোগাযোগ বড় ধরনের পরিবর্তন বলেই ধারণা করি। আলোচনার এই ধারা অব্যাহত থাকলে দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক হতেও সময় লাগবে না। এখন দেখা যাক কী প্রেক্ষাপটে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির টেলিফোন আলাপটি হলো? এটি নিছক সৌজন্য সংলাপ, না মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির মোড় ফেরা—সেটি জানার জন্য হয়তো আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের তিনটি জ্বলন্ত সমস্যা হলো যথাক্রমে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল বিরোধ, সিরিয়ায় ‘গৃহযুদ্ধ’ এবং ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি। ইতিমধ্যে সিরিয়ায় রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার নিয়ে যে যুদ্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, তা আপাতত কাটানো গেছে রাশিয়ার হস্তক্ষেপে। শেষ মুহূর্তে সিরিয়া আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে রাসায়নিক অস্ত্র পরীক্ষায় সম্মতি দেওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা শক্তিগুলো হামলা থেকে বিরত থাকে। আর রাশিয়া এ ক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নেয়। বলা যায়, শক্তিধর দেশগুলোর শুভবুদ্ধির ফলে বিশ্ব আরেকটি যুদ্ধ এড়াতে সক্ষম হয়। দ্বিতীয়ত, ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সমস্যার মূলে যে তেল আবিবের আগ্রাসী নীতি, সেই বাস্তবতা যুক্তরাষ্ট্র কখনোই স্বীকার করেনি। তারা এত দিন আক্রমণকারী ও আক্রান্তকে সমান দৃষ্টিতে দেখে এসেছে। বারাক ওবামা প্রথম মেয়াদে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সমস্যার সমাধানে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সে সময়ে তাঁর পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়েও সফল হননি। জন কেরি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর ফের মধ্যপ্রাচ্য সমস্যার সমাধানে কূটনৈতিক প্রয়াস শুরু করেছেন। ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর বৈঠক এর অংশ হলে সেটি অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ।
দ্বিতীয় সমস্যা সিরিয়ার ব্যাপারে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যগুলো একটি সমঝোতায় আসতে সক্ষম হয়েছে। তারা বলেছে, সিরিয়ার রাসায়নিক অস্ত্রের সম্ভার ধ্বংস করে দিতে হবে। দামেস্কও এই অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণ আন্তর্জাতিক সংস্থার হাতে ছেড়ে দিতে রাজি হয়েছে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, সিরিয়া সংকটের পথ ধরেই ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বৈরিতা আরও বৃদ্ধি পায়। ওয়াশিংটনের দাবি, ইরান ও তাদের সমর্থক ইসলামি গ্রুপ হিজবুল্লাহ সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে সর্বাত্মক সহায়তা করছে। অন্যদিকে সিরিয়ার ‘গৃহযুদ্ধে’ যুক্তরাষ্ট্র বাশার আল-আসাদের বিরোধীদের ইন্ধন জোগাচ্ছে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের কারণে দেশটির অর্থনীতিই কেবল বিপর্যস্ত হয়নি, হাজার হাজার মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে। অনেকে দেশ ছেড়ে পাশের দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন।
এই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে কূটনৈতিক যোগাযোগ শুভযাত্রা বলেই মনে হয়। এই দুটি দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক হলে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে তার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মধ্যপ্রাচ্য সমস্যার মূলে রয়েছে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল বিরোধ তথা ইসরায়েলি আগ্রাসন। ছয় দশকের বেশি স্থায়ী এই সমস্যার সমাধানে গৃহীত কোনো আন্তর্জাতিক উদ্যোগই সফল হতে পারছে না ইসরায়েলের বিরোধিতা ও একগুঁয়েমির কারণে।
তেহরান তাদের পারমাণবিক কর্মসূচিকে শান্তিপূর্ণ দাবি করলেও পশ্চিমা শক্তিসমূহ দেখছে বিপদ হিসেবে। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ একাধিক দেশ ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞাও জারি করেছে; ফলে এ অঞ্চলে অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা বেড়েছে। ওবামা ও রুহানির টেলিফোন সংলাপে মনে হচ্ছে, দুই দেশই এই অস্থিরতা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
শেষ মুহূর্তে সিরিয়ার যুদ্ধ এড়ানো, সিরিয়া প্রশ্নে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ঐকমত্য এবং ইরানের ব্যাপারে ওবামা প্রশাসনের নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি ইতিবাচক পরিবর্তনেরই ইঙ্গিত দেয়। তবে পশ্চিমের এই নীতি পরিবর্তনে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর জনমতও অনেকটা নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। ব্রিটেন, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ হয়েছে। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী পার্লামেন্টে সিরিয়ার যুদ্ধে যোগ দেওয়ার যে প্রস্তাব আনেন, তা ভোটাভুটিতে নাকচ হয়ে যায়। শেষ মুহূর্তে বারাক ওবামাও পিছু হটেন।
আমি মনে করি, ওবামা প্রশাসনের এই সতর্ক পদক্ষেপের পেছনে আরও দুটি বিষয় কাজ করেছে। প্রথমত, ইরান ও আফগানিস্তানে যুদ্ধের অভিজ্ঞতা তাদের পক্ষে যায়নি। দ্বিতীয়ত, আরেকটি যুদ্ধের ভার বহনের মতো ক্ষমতা এই মুহূর্তে মার্কিন অর্থনীতির নেই। ২০০৮ সালে দেশটিতে যে অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হয়েছে, তা এখনো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি।
বারাক ওবামা ও হাসান রুহানির টেলিফোন আলোচনার মাধ্যমে এটাই প্রমাণিত হলো যে যুদ্ধ নয়, আলোচনাই শান্তির পূর্বশর্ত। আর যুক্তরাষ্ট্র যতই ক্ষমতাধর হোক না কেন, বিশ্বকাঠামোয় তারও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এই বাস্তবতাও তাকে মেনে নিতে হবে।
আলোচনায় অংশগ্রহণকারী দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীও বিষয়টিকে ইতিবাচক বলে অভিহিত করেছেন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির ভাষায়, অত্যন্ত ভিন্ন দৃষ্টি ও ভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়েই তাঁরা এই বৈঠকে বসেছেন এবং তা এখানেই শেষ হচ্ছে না। অক্টোবরে জেনেভায় তাঁদের মধ্যে আরেক দফা বৈঠকের কথা রয়েছে।
অন্যদিকে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ আলোচনাকে অত্যন্ত বস্তুনিষ্ঠ ও কার্যকর বলে অভিহিত করেছেন। তিনি সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে ইরানের প্রতি পশ্চিমা দেশগুলোর প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার কথা বলেছেন। আর জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী জিডো ভেস্টারভেলের মতে, ‘এই সপ্তাহটিতে সুযোগের জানালা খুলে গেল।’ এখন সত্যি সত্যি সেই জানালা খুলবে কি না, তা নির্ভর করছে দুই দেশের নেতৃত্বের প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার ওপর।
হুমায়ুন কবির: যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত।