পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী স্বপ্না রহমানের খুন হওয়ার খবরটিও সমগ্র জাতিকে ভীষণভাবে আলোড়িত করেছে। এই খুনের সঙ্গে তাঁদের মেয়ে ঐশীর সম্পৃক্ততা ছিল বলে পুলিশ জানিয়েছে। আমাদের সামাজিক অবক্ষয় ও বিপর্যয়ের কিছু আলামত প্রকাশ পেয়েছে। এই নির্মম হত্যাকাণ্ড নিয়ে রগরগে কাহিনি সাজিয়ে আমরা মেয়েটিকে সুস্থ হয়ে ফিরে আসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করতে পারি না।
কিশোর-কিশোরীদের অপরাধী হওয়া বা অপরাধে জড়িয়ে পড়ার পেছনে অনেক দেহ-মনো-সামাজিক কার্যকারণ রয়েছে। পুরো ব্যাপারটি সংবেদনশীল হওয়ায় এটি নিয়ে আলোচনা করার সময়ও বিবেচনায় রাখতে হবে, যাতে অল্প বয়সী মেয়েটির প্রতি অবিচার করা না হয়। আবার বিষয়টি পুরো এড়িয়ে যাওয়াও সমীচীন হবে না। সম্পূর্ণ একাডেমিক দৃষ্টিভঙ্গিতে আলোচনা করা প্রয়োজন।
সমাজে এক-তৃতীয়াংশ অপরাধ ঘটে থাকে ১৭ বছরের নিচের কিশোর-কিশোরীদের দ্বারা। এদের বেশির ভাগই আচরণগত সমস্যাগ্রস্ত (কনডাক্ট ডিজঅর্ডার) ছেলেমেয়ে। এদেরই একটি অংশ প্রাপ্ত বয়সে পেশাদার অপরাধী বনে যায়। মা-বাবার সঙ্গে সন্তানের যে আত্মিক বন্ধন থাকে (অ্যাটাচমেন্ট), সেটি শুধু স্বর্গীয় নয়, সুদৃঢ়ও। এমন কী মনস্তাত্ত্বিক বা সামাজিক কারণ ঘটেছে যে, সেই বন্ধনে ভাঙন ধরেছিল? ঐশীর ঘটনা আমাদের পরিবার ও সমাজের একটি অন্ধকার, ভয়ংকর অংশ উন্মোচিত করেছে।
এই ঘটনার তিনটি দিক ভেবে দেখা দরকার। প্রথমত, সব দেশেই মাদকাসক্তির হার মেয়েদের চেয়ে ছেলেদের মধ্যে বেশি। বাংলাদেশেও তা-ই ছিল। কিন্তু গত এক দশকে দেশে যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নারীও মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে, তা সংশ্লিষ্টরা লক্ষ করেননি। বিশেষ করে, ইয়াবা মাদকাসক্তি বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদেরও এই অন্ধকার পথে যাত্রা বেড়েছে। ইয়াবা ওজন কমিয়ে স্লিম রাখবে, ক্ষুধা-নিদ্রা-ক্লান্তি হরণ করে তরতাজা-সচল রাখবে, যৌন কামনা ও যৌন ক্ষমতা বাড়িয়ে দেবে—এ রকম বিশ্বাস অনেক আধুনিক তরুণ-তরুণীর। ধনীর সন্তানেরা ইয়াবা মাদক ব্যবসায়ীদের প্রধান টার্গেট। ঐশীর মতো অনেক মেয়েই সহজে এর শিকার হয়। পত্রিকা থেকে জানা গেছে, তার সহযোগী বন্ধুরা ইয়াবা শুধু তার কাছে নয়, অন্যদের কাছেও বিক্রি করত। দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে আচরণগত সমস্যা দেখা যাওয়া। আচরণগত সমস্যা যাদের, তারা মিথ্যা কথা বলে, চুরি করে, অন্যের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করে, মারামারিতে লিপ্ত থাকে, যৌন হয়রানি করে, অন্যের সম্পত্তি ধ্বংস করে, মা-বাবার বাধা সত্ত্বেও ঘরের বাইরে অধিক রাত পর্যন্ত কাটায়, এমনকি ঘর থেকে বের হয়ে যায়, স্কুল-কলেজ-পড়াশোনায় ফাঁকি দেয়, বড়দের অসম্মান করে, মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে, অনৈতিক-অসামাজিক এবং অবশেষে অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ে। যতটুকু জানা যায়, ঐশীর মধ্যেও এ রকম কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল। অনেকের ঘরেই ওই রকম আচরণগত সমস্যাগ্রস্ত শিশু-কিশোর আছে। আমাদের কাছে ভুক্তভোগী তেমন অনেক মা-বাবাই বখে যাওয়া সন্তানের চিকিৎসার জন্য এসে থাকেন।
আচরণগত সমস্যায় ভুগছে এমন কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে সমাজমুখী আবেগ প্রবল না হয়ে সমাজবিরোধী, নৈতিকতাবিরোধী আবেগ প্রবল হয়ে ওঠে। ইতিবাচক ও সমাজমুখী আবেগ হচ্ছে মানসিক ও আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্যের সংমিশ্রণ। ভালোবাসা, আশা, আনন্দ, ক্ষমাশীলতা, করুণা, সমবেদনা, বিশ্বাস, সশ্রদ্ধ ভয় ও বিস্ময় এবং কৃতজ্ঞতাবোধ—এই আটটি মানবীয় আবেগ মানুষে মানুষে সম্পর্কের জাল তৈরি করে। এই আবেগগুলো সম্প্রসারণশীল এবং এগুলো আমাদের মহৎ হতেও সহায়তা করে। এগুলো ভবিষ্যতে আমাদের সহনশীলতা বাড়ায়, নৈতিক ক্ষেত্র বিস্তৃত করে, সৃজনশীলতার মান বৃদ্ধি করে, চিন্তা-প্রণালিকে অধিকতর নমনীয়, সমন্বয়পূর্ণ ও কার্য-উপযোগী করে।
কিন্তু সন্তান প্রতিপালনের সঠিক পদ্ধতির (গুড প্যারেন্টিং) ব্যবহার অনেক অভিভাবকই জানেন না। আমাদের অজ্ঞতা ও অসতর্কতার কারণে প্রিয় কিছু সন্তানের মধ্যে আচরণগত সমস্যা দেখা দেয়। এমন ছেলেমেয়েরাই অসৎ সঙ্গের প্রভাবে সহজে বখে যায়, নষ্ট হয়ে যায়। তারা মাদকাসক্ত হয় বা অন্যবিধ অসামাজিক, অনৈতিক এমনকি অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ে। তাই অভিভাবকদের সঠিক প্যারেন্টিং পদ্ধতি জানা থাকা ভালো।
বছর খানেক আগে আমি প্রথম আলোর উপসম্পাদকীয় পাতায় ‘অভিভাবকের করণীয়’ নামে একটি নিবন্ধ লিখি। আজকের পরিপ্রেক্ষিতে আরও কয়েকটি করণীয় বিষয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, যাতে আপন সন্তান বৈরী হয়ে উঠতে না পারে: ১. স্নেহ-ভালোবাসায় সিক্ত রাখুন, তবে সব বিষয়ে অবাধ স্বাধীনতা বা প্রশ্রয় দেবেন না, ২. প্রকাশ্যে প্রশংসা করুন, ৩. সবার সামনে সমালোচনা, তিরস্কার বা অপমান করবেন না, তবে একান্তে মন্দ আচরণগুলো তুলে ধরুন, ৪. মন্দ আচরণ নিরুৎসাহিত করতে দৃঢ়তা প্রদর্শন করুন এবং কোনটি মন্দ, তা সঠিকভাবে চিহ্নিত করে দিন, ৫. ভালো-মন্দ, নৈতিক-অনৈতিক ব্যাপারসহ সব আচরণে পূর্বাপর একই নিয়ম বজায় রাখুন (কনসিসটেন্সি), নিজের মেজাজ শান্ত রাখুন, ৬. নিজেদের আদর্শ রোল মডেল হিসেবে উপস্থাপন করুন, ৭. তাদের মধ্যে নিরাপত্তাবোধ তৈরি করুন, ৮. তাদের দায়িত্বশীল হতে, সামাজিক-ধর্মীয় রীতি-নিয়ম পালনে অভ্যস্ত করুন, ৯. ব্যস্ত মানুষ হলেও যতটুকু সময় পান, সেটিকে গুণগতভাবে ব্যবহার করুন (কোয়ালিটি টাইম), যাতে সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ, সহজ ও মধুর হয়। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মাধ্যমে সে কোথায় যায়, কী করে, বন্ধু কারা, অবসর সময়ে কী করে ইত্যাদি তদারক ও পর্যবেক্ষণ করুন।
তৃতীয় যে বিষয়টি উল্লেখযোগ্য, তা হচ্ছে শুধু আচরণগত সমস্যা ও মাদকাসক্তিই কিশোর-কিশোরীদের নির্মম, কঠিন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে সম্পৃক্ত করে থাকে। গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি বিষয় হলো মাদক প্রত্যাহারজনিত (উইথড্রল সিনড্রোম) অসহনীয় শারীরিক-মানসিক কষ্ট। আচরণগত সমস্যা ও মাদকাসক্তি থাকলে আগে উল্লিখিত ইতিবাচক ও সমাজমুখী আবেগগুলো ইতিমধ্যে দুর্বল হয়ে পড়ার কথা। আসক্তির ফলে বিবেচনাবোধ, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা, মায়া-মমতা প্রভৃতি নষ্ট হয়ে যায়। তার ওপর যদি মাদক প্রত্যাহারজনিত কষ্ট সহ্য করতে হয়, তখন তারা দিগিবদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে যেকোনো কাজ করতে পারে। মা-বাবা সন্তানের উচ্ছৃঙ্খলতা ও মাদকাসক্তির ব্যাপারে অবগত হওয়ার পর যেটি করা উচিত ছিল, তাকে শোধরানোর জন্য মনোরোগ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া। কিন্তু যতটুকু জানা যায়, ঐশীর বাবা-মা সেটি করেননি। তাঁরা শুধু মেয়েকে আটকে রাখতে চেয়েছেন। ফলে তাঁর মধ্যে মাদক প্রত্যাহারজনিত তীব্র শারীরিক ও মানসিক কষ্ট-যন্ত্রণার সৃষ্টি হয়েছে। ওই রকম দুর্বিষহ, কষ্টকর সময়ে তারা মাদক নেওয়ার জন্য বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এ রকম অসহনীয় যন্ত্রণার সময়ে খুন-ডাকাতি করা বা তেমনটি করার চিন্তা করা কঠিন কাজ নয়। যদি মেয়েটি চিকিৎসা পেত, তাহলে উইথড্রলের তীব্র শারীরিক-মানসিক কষ্টটুকু অনেকটা লাঘব হতো। ফলে তার মধ্যে মা-বাবার প্রতি এত গভীর ক্ষোভ বা আক্রোশ তৈরি না-ও হতে পারত।
তাই সবাইকে এ কথা মনে করিয়ে দিতে চাই, কারও ঘরে মাদকাসক্ত বা আচরণ সমস্যাযুক্ত সন্তান থাকলে অবহেলা না করে দ্রুত সঠিক জায়গায় মনোরোগ চিকিৎসা গ্রহণে এগিয়ে আসুন। অভিভাবকেরা ভাবেন, অন্যেরা যদি জানে তাঁর ছেলে (মেয়ে হলে তো কথাই নেই) মাদকাসক্ত, তাহলে তাঁদের মানসম্মান থাকবে না। কিন্তু একসময় সবাই ঠিকই জানে এবং এমনভাবে জানে, যখন অনেক বেশি ক্ষতি হয়ে যায়।
প্রথম আলোর পক্ষ থেকে মাদকবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে প্রতি মাসে অভিভাবকদের জন্য পরামর্শ সভা করা হয়। সেখানে অংশ নিয়ে দেখেছি, স্বল্পসংখ্যক অভিভাবক তাতে হাজির হন। বৃহদংশ বিনে পয়সার পরামর্শটুকু পর্যন্ত নিতে আসেন না।
ঐশীর পরিবারের মতো ঘটনা যাতে আর না ঘটে, সেটি প্রতিরোধ করতে সমাজ, রাষ্ট্র, সংবাদমাধ্যমসহ সব অভিভাবককে আরও সচেতন হতে হবে ও বিজ্ঞানভিত্তিক কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে।
ডা. মো. তাজুল ইসলাম: মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট।
drtazul84@yahoo.com