তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া

এ বর্বরতার অবসান চাই

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রয়াণ দিবসে মাদারীপুর শহরের পুরান বাজারের যৌনপল্লিতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট হয়েছে। যৌনকর্মীদের সম্পর্কে নজরুল লিখেছেন, ‘কে তোমায় বলে বারাঙ্গনা মা, কে দেয় থুতু ও-গায়ে?/ হয়ত তোমার স্তন্য দিয়াছে সীতা-সম সতী মায়ে।/ না-ই হ’লে সতী, তবু তো তোমরা মাতা-ভগিনীরই জাতি।’ [বারাঙ্গনা]
আমাদের কথিত ভদ্র সমাজের মানুষেরা যৌনকর্মীদের তাদের মা-বোনদের জাতি মনে করে না। তাঁদের দ্বারা তারা শুধু তাদের পাশবিক প্রবৃত্তি চরিতার্থ করে। মাদারীপুরের যৌনপল্লির বাসিন্দাদের ওপর হামলা ও সেখান থেকে তাঁদের বিতাড়নের যে দৃশ্য টিভি-সংবাদে দেখা গেছে, তাতে মনে হয় না আমরা কোনো সভ্য সমাজের মানুষ। আদিম বর্বরতার বৈশিষ্ট্যগুলো আমাদের সাধারণ মানুষের মধ্যেও পুরো মাত্রায় উপস্থিত।
আমাদের সমাজব্যবস্থায় যৌনকর্মীরা সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত ও লাঞ্ছিত মানুষ। যে সমাজ সাধারণ নারীকে মর্যাদা দিতে কুণ্ঠিত, সেখানে যৌনপল্লির মেয়েরা যে অবহেলিত ও লাঞ্ছিত হবে—তাতে সন্দেহ কী? তাঁদের প্রতি ধর্মীয় মৌলবাদীদের আক্রোশ ও নির্মমতা আরও বেশি। দিনদুুপুরে ইসলাহে কওম পরিষদ নামের একটি সংগঠন উচ্ছেদ ও হামলায় নেতৃত্ব দিলেও তাদের পাশে ছিল প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং সমাজের ‘গণ্যমান্যরা’। লুটপাটে অংশ নিয়েছে স্থানীয় লোকজন। আক্রমণে আহত হয়েছেন ৩০-৪০ নারী। বিপন্ন নারীদের পাশে দাঁড়াতে কাউকে দেখা যায়নি।
বিস্ময়কর ব্যাপার যে, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা ছিল যৌনকর্মীদের হয়রানি না করতে এবং তাঁদের পেশা চালিয়ে যেতে প্রশাসন
যেন কোনো বিঘ্ন সৃষ্টি না করে। কিন্তু সমাজপতিরা এতই প্রভাবশালী যে, আদালতের নির্দেশও অগ্রাহ্য করা হয়েছে এবং সে জন্য অভিযুক্ত সংগঠনের কোনো নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।
আড়াই শ বছর ধরে যৌনকর্মীরা সন্তানসন্ততি নিয়ে ওই জায়গায় বাস করছেন। বর্তমানে তাঁদের সংখ্যা প্রায় ৫০০। তাঁদের যথাযথ পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করে এমন বর্বরোচিতভাবে উচ্ছেদ করা মানবাধিকার লঙ্ঘন শুধু নয়, ফৌজদারি অপরাধ। কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে তা হতে পারে না।
সমাজের প্রতিটি দুর্বল শ্রেণীই আজ চরম অসহায়। অসহায় আদিবাসী, জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু, নারী, শিশু প্রভৃতি। যেভাবে যৌনকর্মীদের তাঁদের ঘরবাড়ি থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে, তা শুধু সাধারণ দাঙ্গাহাঙ্গামা নয়, নির্মম নারী নির্যাতন। মূল উদ্দেশ্য ভূমি দখল। নির্যাতিতদের পাশে রাজনৈতিক নেতৃত্ব নেই, সমাজপতি নেই, প্রশাসন নেই। এই ঘটনার পর দেশের অন্যান্য জায়গার যৌনকর্মীরাও আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। সন্ত্রাস ও নারী নির্যাতনের অভিযোগে দুর্বৃত্তদের কঠোর শাস্তি না হলে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে। সমাজহিতৈষী মানুষদের তাই শুধু মৌখিক প্রতিবাদ নয়, অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে গড়ে তুলতে হবে প্রতিরোধ।
আমাদের দাবি, ক্ষতিগ্রস্ত যৌনকর্মীদের তাঁদের জায়গায় অবিলম্বে করা হোক পুনর্বাসন। তাঁদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। দুর্বৃত্তদের গ্রেপ্তার ও বিচার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি। সেই সঙ্গে প্রশাসনকে দিতে হবে তাঁদের শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনে পূর্ণ নিরাপত্তা।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।