আপনার শুধু দরকার সদিচ্ছা। যদি করযোগ্য আয় থাকে, আর যদি আপনি কর দিতে চান, তাহলে আর বিশেষ কিছু লাগবে না। কর মেলায় গেলে সব সহযোগিতা পাবেন। সেখানে আপনার ফরম পূরণ থেকে শুরু করে কর জমা দেওয়া, সব ফ্রি। প্রাপ্তি রসিদও হাতে হাতে পাবেন।
কয়েক বছর থেকে কর মেলার ব্যবস্থা হচ্ছে। এই ব্যবস্থাটি আসলে ভোগান্তির শেষ অধ্যায়ের শুরু। বিশ্বাস না হলে একবার ঢাকায় অফিসার্স ক্লাবে কর মেলা প্রাঙ্গণে যান। অন্য জেলায়ও চলছে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় সবই অভাবনীয়। শনিবার কর দিতে গিয়ে আমি বেশ মুগ্ধ! আগেও দিয়েছি। কিন্তু এবার নতুন কিছু মাত্রা যোগ হয়েছে। লোকে লোকারণ্য, কিন্তু তেমন কোনো বিশৃঙ্খলা নেই। তার একমাত্র কারণ, কিছু জানতে চাওয়ার আগেই সব জেনে যাচ্ছেন।
একটা বড় সুসজ্জিত তাঁবুর ভেতরে সব অনুসন্ধানের ব্যবস্থা। দেখলাম চেয়ার-টেবিলে ফরম পূরণ চলছে। তারপরও ফাঁকা জায়গায় গ্রুপে গ্রুপে ছেলেমেয়েরা বসে নিজেরাই ফরম পূরণ করছেন। এবারের বৈশিষ্ট্য হলো, কর দিতে উৎসাহীদের এক বড় অংশই তরুণ বয়সী। চোখেমুখে উদ্দীপনা। বিনা হয়রানিতে কর দিতে পারছেন। এটাই তাঁদের মনের জোর বাড়িয়ে দিচ্ছে।
একটা জিনিস পরিষ্কার। দেশের তরুণ থেকে প্রবীণ, প্রায় সবাই সরল মনের মানুষ। সৎভাবে থাকতে চান। কিন্তু ওই যে একটা প্রচার, একবার ট্যাক্সের চক্করে পড়লে বছর বছর ভুগতে হয়। হয়তো কথাটা ঠিক নয়। তবে এটা তো ঠিক, আইনের যত মারপ্যাঁচ, হয়রানিতে ফেলতে চাইলে তো খুবই সম্ভব। তাই এত দিন অনেকেই ট্যাক্সের ধারেকাছে যেতে চাইতেন না। কিন্তু এখন সেই ভয় ভেঙে যাচ্ছে। বছরে করযোগ্য আয় তিন-চার লাখ টাকা হলে ১০-২০ হাজার টাকা ট্যাক্স দিয়ে নিজের মনে তৃপ্তি অনুভব করতে পারাটা তো আনন্দের ব্যাপার।
তার মানে এই নয় যে কর ফাঁকি দেওয়ার লোকের অভাব আছে দেশে। থাকতে পারে। কোটি কোটি টাকার মালিকদের ব্যাপার আলাদা। তাঁদের মধ্যে হয়তো সে রকম একটি অংশ আছে। তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার আইনগত বিধিবিধানও রয়েছে। কিন্তু যাঁরা ঝুটঝামেলামুক্ত থাকতে চান, তাঁদের জন্য এনবিআর দরজা খুলে দিয়েছে। প্রতিবছর কর মেলার আয়োজন করছে।
শুধু তা-ই নয়। মেলায় বসেই আপনি ব্যাংকের বুথে অথবা বিকাশ বা রকেটে কর পরিশোধ করে হাতে হাতে স্লিপ পেয়ে যাচ্ছেন। ব্যাংকের কাউন্টারে লাইন দিতে হচ্ছে না। অনলাইনে কর পরিশোধের এই ব্যবস্থা এ বছর নতুন আকর্ষণ সৃষ্টি করেছে।
যেটা সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়, তা হলো সুশৃঙ্খল, পরিপাটি ব্যবস্থা। ভিড়, ঠেলাঠেলি, ধাক্কাধাক্কি—কিচ্ছু নেই। যাবেন আর আসবেন। একটা ব্যাগ উপহার পাচ্ছেন। সেই ব্যাগ উঁচু করে ধরে আপনি বের হচ্ছেন। এই দৃশ্য দেখে মনে হলো বাংলাদেশের চেহারাটাই এই মানুষেরা বদলে দিচ্ছেন। আর সেই সুযোগ সৃষ্টি হতো না, যদি এনবিআর এ রকম উন্নত ব্যবস্থাপনার কর মেলার ব্যবস্থা না করত।
শুধু যে করদাতারা খুশি, তা-ই নয়। এনবিআরের কর্মকর্তারাও খুশি। তাঁদের পেশাগত কাজ এত দিন শুধু ঘরের ভেতর চেয়ার-টেবিলে আটকে ছিল। এখন বছরে কয়েকটা দিন সরাসরি করদাতাদের সঙ্গে কথাবার্তা, মতবিনিময় হচ্ছে। ব্যতিক্রমী উদ্যোগ তাঁদের জন্যও আনন্দদায়ক।
এটা বুঝতে পারলাম মেলা প্রাঙ্গণে মিডিয়া সেন্টারে গিয়ে। সেখানে জনসংযোগ কর্মকর্তা সৈয়দ এম এ মোমেন সাহেবের সঙ্গে দেখা। তিনি সবিস্তারে সব বললেন। বড় কর্মকর্তাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং তাঁদের আন্তরিকতায় যে কেউ অবশ্যই মুগ্ধ হবেন। তাঁদের সবাই দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত। দরকারি কথাবার্তা খোলা প্রাণে সেরে নিচ্ছেন। সেখানে আমলাগিরির চিহ্ন পাওয়া গেল না।
বিশেষভাবে দেখলাম, কর্মকর্তা ও অন্যান্য কর্মীর শত ব্যস্ততার মধ্যেও একটু দম নেওয়া, এক কাপ চা। একটু মজার খাওয়া। সব ব্যবস্থাই রয়েছে সেখানে। হাজার হলেও কর্মকর্তা ও অফিসের কর্মীরা তো মেলার কয়েকটা দিন অফিস টাইমের অতিরিক্ত সময় কাজ করছেন। সেটা আবার হাসিমুখেই। একজন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর কাছ থেকে দেশ ও দেশের মানুষ যে সত্যিই অতিরিক্ত কিছু পাচ্ছেন, সেটা একেবারে খোলাখুলি দেখার সুযোগ সেখানে রয়েছে। এই কাজ যে লোকদেখানো নয় তা বোঝা যায়। হয়তো কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম থাকতে পারে। আমাদের সমাজে সেটা বিরল নয়। কিন্তু সেই ব্যতিক্রম আমাদের অতিক্রম করতে হবে। অবশ্য মনে রাখতে হবে, ব্যতিক্রম নিয়মেরই অংশ।
এই যে মেলার আয়োজন করা হচ্ছে, তার বিনিময়ে প্রাপ্তিটাও কিন্তু বেশ বড়। সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি মানুষের মধ্যে কর-অভ্যাস গড়ে উঠছে। এটা না হলে দেশ কখনোই উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে পারবে না।
এখন বলতে পারি, আমরা বর্তমান বিশ্বের আধুনিক বিধিব্যবস্থার সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারছি। কর ফাঁকির প্রবণতা কমে আসছে। কর মেলার এটাই বোধ হয় সবচেয়ে বড় সাফল্য।
আব্দুল কাইয়ুম প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক
quayum.abdul@prothomalo.com