ছাত্রজীবনে কেনা একটি ছোট ক্যাসেট রেকর্ডার ছিল এন্ড্রু কিশোরের নিত্যদিনের সঙ্গী। সুরকারদের নানান সুরে করা গান সেই রেকর্ডারে ধারণ করতেন। আর ঘরে ফিরে সেই নতুন সুরের গানটি নিয়ে চর্চা করতেন। দম ধরে রাখার জন্য রেওয়াজের চেয়ে বেশি জোর দিতেন যোগব্যায়াম আর প্রাণায়ামে। বলতেন, আগেকার ওস্তাদদের মতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা রেওয়াজের দরকার নেই। ৩৫ বছর আগে যোগব্যায়াম সম্পর্কে খুব কম মানুষই জানতেন।
ঢাকায় তখন হাতে গোনা কয়েকটি রেকর্ডিং স্টুডিও। মগবাজারে শ্রুতি, নয়াপল্টনে এলভিস, ঝংকার। শ্রুতি স্টুডিওতেই এন্ড্রু কিশোরের গানের রেকর্ডিং বেশি হতো। যেদিন বরেণ্য শিল্পী রুনা লায়লা বা সাবিনা ইয়াসমীনের সঙ্গে দ্বৈত সংগীতের রেকর্ডিং থাকত, তাঁরা আসতেন সেই সময়কার দামি গাড়িতে। এন্ড্রু কিশোর যেতেন ফকিরাপুল থেকে রিকশায়। এই ঘটনা বহুবার দেখেছি, ১৯৮১ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত। বলতাম, একটা গাড়ি কেনেন, বলতেন, ‘এত ফুটানি ভালো নয়, ঢাকা শহরে আমার একটা বাড়ি নেই, আর গাড়ি কিনে কী হবে!’
১৯৮০ সালের পর যখন এন্ড্রু কিশোরের জনপ্রিয়তা আস্তে আস্তে তুঙ্গে উঠছে, প্রতিদিন বাংলাদেশের নানা প্রান্ত থেকে লোকজন আসত। উদ্দেশ্য, এলাকায় গান গাওয়ানো। সবাইকে হাসিমুখে চা-বিস্কুট খাওয়াতেন আর জিজ্ঞাসা করতেন, আর কোন কোন শিল্পী সেখানে যাবেন। পছন্দ হলে বা সম্মানীতে পোষালে যেতেন নতুবা বেশির ভাগই না করে দিতেন। এই রকম অনুষ্ঠানকে বলা হতো ‘খ্যাপ মারা’। এসব অনুষ্ঠানে আমি বহুবার সঙ্গী হয়েছি।
নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, কুমিল্লা, টাঙ্গাইল কত জায়গায়। অনুষ্ঠানে যেতেন ঢাকা থেকে নানা শিল্পী, যন্ত্রী, ছবির নায়ক প্রমুখেরা। তাঁর জনপ্রিয়তা ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছিল এবং ডাকও আসতে লাগল বেশি করে। আয়-রোজগারও ভালো হতে লাগল। কিন্তু সাধারণ জীবনযাত্রার কোনো পরিবর্তন হলো না। ব্যাচেলরদের আস্তানায় থাকতেন, নিজ হাতে বাজার করতে পছন্দ করতেন। এর মধ্যে অবশ্যই থাকত নানান বনৌষধিসমৃদ্ধ শাকসবজি। ছিলেন খুবই বাস্তববাদী। বলতেন, ‘আজকের আমার এই জনপ্রিয়তা একদিন না-ও থাকতে পারে। আর শেষ বয়সে এ দেশের শিল্পীরা না খেয়ে মরে।’ গড়গড় করে একগাদা শিল্পীর নাম বলে যেতেন তিনি। এ জন্য খানিকটা টেনশনেও থাকতেন আর ভবিষ্যৎ ভাবনাটা আগেই করতেন।
এন্ড্রু কিশোরের জনপ্রিয়তার কারণ কী শুধুই আবেগভরা বিধাতাপ্রদত্ত কণ্ঠস্বর, হিটকরা সিনেমার গান? না, এর সঙ্গে অবশ্যই যোগ করতে হবে স্টেজ পারফরমার হিসেবে তাঁর স্মার্ট স্টাইল। দর্শক শুধু গান শোনেন না, গান দেখেনও। বিজয় দিবসের সংগীতানুষ্ঠান হতো শিল্পকলা একাডেমিতে। পরিচালনার দায়িত্বে থাকত দীর্ঘাঙ্গী সুবল দাস, রিহার্সেল হতো মগবাজারের তখনকার ওয়াইএমসিএ ভবনে। স্বাধীন বাংলা বেতারের কণ্ঠযোদ্ধা সুবল দাসের রিহার্সেল ছিল দেখার মতো, তিনি হাত শূন্যে ছুড়ে ছুড়ে দেশাত্মবোধক গান গাইতেন। সব শিল্পীকে সেভাবেই অনুকরণ করতে হতো।
ভক্তদের কিশোর সবার ওপরে স্থান দিতেন। ঘরের বাইরে গেলে তাঁর সঙ্গে থাকা ভিআইপি বা বন্ধুদের এড়িয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশতেন। ছবি তোলা বা অটোগ্রাফের বায়নায় বিরক্ত হতেন না। স্টেজে স্মার্ট আর গুরুগম্ভীর থাকলেও পাবলিকের মন জয় করতেন নরম ব্যবহার দিয়ে। তাঁকে কখনো রাগতে দেখিনি। কঠিন সমস্যা মোকাবিলা করতেন ঠান্ডা মাথায়। সুপরামর্শ দিতেন সবাইকে। বন্ধু, দুস্থ শিল্পী যন্ত্রীদের বিপদে আপদে সহায়তা করতেন।
তখনো বিয়ে করেননি। একদিন শুক্রবার বললেন, ‘চলো মিরপুরের সেনপাড়া পর্বতা এলাকায় একটা জায়গা দেখে আসি।’ ১০ নম্বর ফলপট্টি থেকে বাম দিকের গলিতে ঢুকে পানিতে ডোবা প্লট। অবশ্য পানি ছিল বর্ষার কারণে। পরে সেখানেই বাড়ি বানালেন। অনেক পরে জন্মভূমি রাজশাহীতে পদ্মা আবাসিকে একটি অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছিলেন। রাজশাহী গেলে নিজের অ্যাপার্টমেন্টেই থাকতেন। ২০১৯ সালে সিঙ্গাপুরে যখন চিকিৎসা খরচের ব্যয়ভার আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছিল, তখন তিনি চিকিৎসার খরচ জোগাতে সাধের অ্যাপার্টমেন্টটি বিক্রি করে দিলেন।
পরে অবশ্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিঙ্গাপুরে এন্ড্রু কিশোরের চিকিৎসার ব্যয়ভার বহনের দায়িত্ব নিলে তাঁর পরিবার হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। চিকিৎসা শেষে সিঙ্গাপুরের বাসায় ফেরার পর অসম্ভব রকম উৎফুল্ল হয়ে ভিডিও ফোন করলেন আমাকে। অনেকক্ষণ ধরে বাড়িটির ঘর, রান্নাঘর, বারান্দা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন। গলায় উচ্ছ্বাস, বললেন আর কিছুদিন পরই বাংলাদেশে ফিরে যাব। আমরা বন্ধুরা খুশি হয়েছিলাম। হঠাৎ করে সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার।
ফকিরেরপুলের বাড়িতে মাঝেমধ্যে রাজনৈতিক আড্ডা বসত। এরশাদবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা মাঝেমধ্যে এই বাড়িতে আসতেন। ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি শিক্ষা ভবনের সামনে পুলিশের গুলিতে বহু ছাত্র হতাহত হওয়ার পর, সেই সময়কার ছাত্রনেতা, বর্তমানে রাজশাহীর এমপি ফজলে হোসেন বাদশা সন্ধ্যার দিকে গ্রেপ্তার এড়াতে আমাদের বাসায় এলেন। ওই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিহত ছাত্রদের জানাজা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আমি, কিশোরদা, গনি ভাই, এনামুল ভাই, ছবি ভাই প্রমুখ রমনা পার্কের ভেতর দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। পথিমধ্যে পুলিশের ধাওয়া খেয়ে আমরা ফিরে এসেছিলাম।
১৯৮৪ সালের জুন মাসে বিদেশে আসার আগ পর্যন্ত ঢাকায় ফকিরেরপুলের বাড়িতে তিনটি বছর এন্ড্রু কিশোরের সঙ্গে একসঙ্গে কাটিয়েছি। কত শত স্মৃতি। ২০১৬ সালে দেশে গিয়ে দেখি কিশোরদা রাজশাহীতে। বললেন, ‘চলো কাল পুঠিয়াতে মাছ ধরতে যাব।’ দল বেঁধে সারা দিন অনেক হইহুল্লোড়। এই তো গত বছর জার্মানিতে ফেরার সময় আমার হাতে কালোজিরার আচার ধরিয়ে দিলেন। সেই আচার আজও আমার রান্নাঘরে।
মানুষের মন ছুঁয়ে যাওয়া শিল্পী হওয়ার পেছনে ছিল এন্ড্রু কিশোরের অদম্য অধ্যবসায় আর তাঁর পেশাদারি শিল্পীসত্তা। সবকিছুতেই তাঁর ছিল পরিমিত আচরণ। খাওয়াদাওয়া, কথাবার্তা, আড্ডা—সবই করতেন তবে শিল্পীসত্তাকে সবার ওপরে স্থান দিয়ে। সাংবাদিক বা টেলিভিশনের পেছনে ঘোরাঘুরি তাঁর অপছন্দ ছিল। বলতেন, ‘ভালো গাইতে পারলে শিল্পীকে এমনিই মানুষ কাছে টানবে।’ মানুষ তো ফুরিয়ে যায়, শেষ হয়ে যায়। তবে তার কৃতি তাকে অমর করে রাখে, হৃদয়ে গেঁথে রাখে।
রাজশাহীর যে মাটিতে তাঁর জন্ম হয়েছিল, যে মাটি থেকে তাঁর সুপারস্টার হওয়ার গল্পগাথা শুরু হয়েছিল, সেই মাটি তাঁকে আজ পরম আদরে গ্রহণ করবে। সারা দুনিয়ার বাঙালির চোখের মণি এন্ড্রু কিশোর রাজশাহীতে চিরশয্যায় শায়িত হবেন। তবে তিনি বেঁচে থাকবেন আমাদের হৃদয়ের মাঝে।
সরাফ আহমেদ: প্রথম আলোর জার্মানি প্রতিনিধি
Sharaf.ahmed@gmx.net