একজন টাকাওয়ালার স্বপ্ন

‘এই যে, আপনাকে বলছি। শুনতে পাচ্ছেন?’

‘না না। আমার শোনার সময় নাই।’

‘ক্যানো? খুব ঝামেলায় আছেন বুঝি?’

‘ঝামেলা! না, ঝামেলা আবার কী! এসব তো পার্ট অব দ্য গেম। আমরা যে জীবন বেছে নিয়েছি, এসব তো আমাদের সকালবেলা উঠে দাঁত মাজার মতো, কুলি করলেই সব ঠিক।’

‘আচ্ছা আচ্ছা। তো আজকে এখন কী কুলি করতে হচ্ছে?’

‘আর বলবেন না। আমার ইউনিয়নে ২০ টন গম এসেছিল। সেসব থেকে এক টন তো আমি বিলি করার আদেশ দিয়েছি। এক টন মানে বুঝলেন তো? প্রায় এক হাজার কেজি। তো আমার এখানে গরিব মানুষ আছে এক লাখ। সবাইকে তো আমি দিতে পারব না। দান শুরু করতে হয় নিকটাত্মীয়র মধ্য থেকে। ১৯ টন সরিয়ে রাখলাম। তো সেইটা নিয়ে ঝামেলা। কে এক ছোকরা সেটা নাকি ফেসবুকে দিয়েছে। রিলিফের গম বাজারের আড়তে
কেন? দুর্নীতি আমি একা করছি? এই দেশে দুর্নীতি আজ প্রথম হচ্ছে?’

‘তা ঠিক। বঙ্গবন্ধু অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন এই ব্যাপারে। ব্রিটিশ আমলেও এমপি–এমএলএদের কেনাবেচা হতো। তরুণ শেখ সাহেব এমএলএদের পাহারা দিয়েও আটকে রাখতে পারতেন না। তারা বলে, টাকা যখন দিচ্ছে, নিই। ভোট না হয় ওদের দিলাম না। শেখ সাহেব লিখেছেন, “এর পূর্বে আমার ধারণা ছিল না যে এমএলএরা এইভাবে টাকা নিতে পারে। এরাই দেশের ও জনগণের প্রতিনিধি!’”

‘তাইলে বোঝেন। আমরা চিরকাল এই রকমই ছিলাম। আমরা জনগণের প্রতিনিধি। আমরাই জনগণ। কাজেই রিলিফের গম যদি আমি বিক্রি করে দিয়ে টাকাটা নিজের পকেটে ঢোকাই, তাহলে সেটা জনগণের পকেটেই ঢুকল।’

‘আকবর আলি খানের বইয়ে পড়েছি, মোগল আমলেও দুর্নীতি হতো, ব্রিটিশ আমলেও হতো। আপনারা আসলেই ঐতিহ্যের ধারক আর বাহক। তো সমস্যাটা কোথায় হলো?’

‘আর বলবেন না। একটা ছোকরা গম কেন আড়তে, আর আমার আত্মীয়স্বজন কেন পাচ্ছে, এসব নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছে।’

‘খুব বড় বেয়াদবি। আপনি কী করলেন? কুলি করে ফেললেন?’

‘হাত দুটো ভেঙে দিয়েছি। দেখি ব্যাটা ফেসবুক করে কোন...দিয়ে?’

‘কিন্তু ধরুন গরিব মানুষ কষ্ট পাচ্ছে। ভাত না পেয়ে স্কুলপড়ুয়া কিশোরী আত্মহত্যা করছে। আপনি গরিবের হক মেরে খাচ্ছেন, আপনার বিবেকে বাধে না?’

‘গরিবের হক কেন বলছেন? বললাম না, আমরা হলাম গরিবের প্রতিনিধি? আমরা খেলেই তো ওদের খাওয়া হয়ে যায়।’

‘আচ্ছা এই যে চুরিচামারি করে টাকা করছেন, আপনার রাতে ঘুম হয়?’

‘খুব ভালো ঘুম হয়। হবে না কেন?’

‘না, ধরেন এই যে করোনা। এ কিন্তু বড়লোকদেরও ছাড়ছে না। শুনেছেন তো, দেশের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ী গ্রুপ, যাদের কত হাজার কোটি টাকা আছে, টেলিভিশন আছে, ব্যাংক আছে, তাদের দুই ভাই আইসিইউতে ছিলেন। একজনের ভেন্টিলেটর খুলে আরেকজনকে দিতে হয়েছে। তো এক ভাই মারা গেছেন। বরিশালের এক ডাক্তার সাহেব। এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা এসেছেন করোনায় আক্রান্ত হয়ে। তিন বড় হাসপাতাল ঘুরে বেড পাননি। শেষে বাড্ডার এক হাসপাতালে ভর্তি হতে না হতেই মারা গেলেন। ধরেন পপুলার হাসপাতালের পপুলার গ্রুপ। আল্লাহ তাঁকে বেহেশত নসিব করুন, পপুলার গ্রুপের চেয়ারম্যান তাহেরা আক্তার করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। তো আপনার মৃত্যুচিন্তা হয় না? টাকা তো আপনাকে বাঁচাতে পারবে না।’

‘কেন হবে?’ 

‘এই যে ধরেন আমাদের বড়লোকদের কেউ কেউ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন। টাকাটা দেশে থাকলে তো দেশের মানুষের কর্মসংস্থান হতো। দেশের উন্নয়নে কাজে লাগত। টাকা বিদেশে পাঠিয়ে দিলেন। তো ওরা যখন মারা যাবে, তখন তো ওদের এই সাড়ে তিন হাত কবরেই নামাবে। কী লাভ এত চুরি করে?’

‘এইটা তো সোজা হিসাব। আপনার টাকা নাই, আপনি রাস্তার ধারে মারা গেলেন। আমার টাকা আছে, আমি এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে চড়ে মারা যাব। কোনটা ভালো? আপনার টাকা নাই, আপনি মারা গেলেন। আপনার দারা–পুত্র–পরিবার গাঙের জলে ভাসতে লাগল। আমার টাকা আছে, আমি মারা গেলাম। আমার স্ত্রী–পুত্র–কন্যা আরামে থাকল।’

‘আরামে থাকবে? নাকি আপনার লাশ দাফনের আগেই সম্পত্তি নিয়ে মারামারি শুরু করবে? আপনার ছেলেমেয়ে ভালো আছে, নাকি ড্রাগ নিচ্ছে, হোটেলে–মোটেলে গিয়ে নষ্টামি করছে? আপনি যখন মারা যাবেন, দেশের মানুষ কী বলবে? আপনার কবর দেখিয়ে বলবে, এই যে একটা লোক, আমাদের হকের গম চুরি করে খেয়েছে। আল্লাহ তুমি বিচার কোরো। যে মা আজ রাতে সন্তানদের ভাত দিতে পারছেন না, সন্তানেরা কাঁদছে, মা আর্তনাদ করে ডেকে উঠছেন, আল্লা রে, তাঁর কাঁদনে কি আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠছে না? আপনার মৃত্যুর পর ফেরেশতারা যখন আসবে, তখন কী জবাব দিবেন?’

‘টাকা আছে না আমার?’

‘মরার পরে টাকা দিয়ে কী হবে?’

‘গরিব হয়ে মরার চেয়ে বড়লোক হযে মরা ভালো না?’

‘সৎ উপায়ে বড়লোক হন। না হলে গরিবই থাকেন। মানুষের উপকার করেন। মানুষ আপনার জন্য দোয়া করবে। এই যে দেখেন বিল গেটস, বড়লোক হয়েছেন মাইক্রোসফট বানিয়ে। নিজের সম্পত্তির ৮০ ভাগ দান করে দিয়েছেন। এখনো বলছেন, টিকা আবিষ্কার করেন, কোটি কোটি টিকার খরচ আমি দেব। আর আপনি করোনোর দিনেও চুরি করছেন।’

‘আপনি এই সব বইলেন না তো। খ্যাক খ্যাক। সে কী! আমার আবার কাশি হচ্ছে কেন? এই কে আছিস! থার্মোমিটারটা আন তো। জ্বর এল নাকি?’

‘শোনেন, আপনার যদি এখন জ্বর হয়, কাশি হয়, শ্বাসকষ্ট হয়, কেউ আপনার পাশে আসবে না। আপনার লাশ পড়ে থাকবে। কেউ ধুতেও আসবে না। ওই মারকাজুল ইসলাম কিংবা পুলিশের লোকেরাই আপনাকে গোপনে কবরে শুইয়ে দিয়ে আসবে।’

‘না না, আমার টাকা আছে।’

‘চুরির টাকা। ব্যাংক লুটের টাকা। ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়া টাকা। মানুষের জমি দখল করার টাকা। এই টাকা আপনাকে মৃত্যুর আগেও বাঁচাবে না। মৃত্যুর পরেও শান্তি দেবে না। শাস্তি দেবে। আপনার কবরে জাহান্নামের আগুন জ্বলবে।’

 তিনি ডাকতে থাকেন, ‘এই কে আছিস...!’

আবার কাশি। কেউ আসে না। তাঁকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হয়েছে। ঢাকার এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালের গেটে অ্যাম্বুলেন্স ছুটছে। না। বেড নেই। তাঁর দম বন্ধ হয়ে আসছে...এই সময় আওয়াজ শোনা যায়, ‘অক্সিজেন নাই, নাকে টাকা গুঁজে দেব, মুখে গম ঢুকিয়ে দিব?’

তাঁর ঘুম ভেঙে যায়। (কাল্পনিক)

আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক