উল্টো পথে গাড়ি, দেশটা কি সঠিক পথে চলছে?

উল্টো পথে চলা গাড়ির বিরুদ্ধে অভিযান
উল্টো পথে চলা গাড়ির বিরুদ্ধে অভিযান

সম্প্রতি ঢাকায় উল্টো পথে চলা গাড়ির চালক ও মালিকদের শাস্তি দিয়ে ট্রাফিক পুলিশ একটি সাহসী কাজ করেছে। তবে পুলিশকে সাহস জোগাতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের কিছুটা ভূমিকা ছিল বলে গণমাধ্যমে এসেছে।

তিনি দুদকের দায়িত্ব নেওয়ার পর দুদক নড়েচড়ে বসেছে। কিন্তু তারপরও অনেক প্রশ্নের জবাব মিলছে না। প্রতিষ্ঠানটি যখন বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই ওরফে বাচ্চুকে নিয়ে লুকোচুরি খেলে কিংবা অন্যান্য রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের অর্থ লোপাটকারীকে ছাড় দেয়, তখন প্রশ্ন জাগে, আসলেই দুদক প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজদের ধরতে চায় কি না। 

উল্টো পথে চলা গাড়ির বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানে প্রতিমন্ত্রী, সচিব থেকে শুরু করে আইনের রক্ষক পুলিশ, বিবেকের কণ্ঠস্বর আইনজীবী-সাংবাদিকেরাও ধরা খেয়েছেন। আশা করি, ভবিষ্যতে তাঁরা এ ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকবেন।   

কেবল গাড়ি নয়, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে সবকিছুই উল্টো পথে চলছে। কিছুদিন আগে বিদেশে অর্থ পাচার কিংবা পাচার করা অর্থে কানাডা, আবুধাবি ও মালয়েশিয়ায় দ্বিতীয় বাড়ি বা সেকেন্ড হোম বানানোওয়ালাদের বিরুদ্ধে দুদক কী ব্যবস্থা নিয়েছে, জানতে চাইলে দুদক চেয়ারম্যান বলেছিলেন, কেবল সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি তদন্ত করাই তাঁদের দায়িত্ব। বেসরকারি পর্যায়ে যেসব দুর্নীতি হয়ে থাকে, সেগুলো দেখার এখতিয়ার তাঁদের নেই। কিন্তু একজন সাবেক আমলা হিসেবে তিনি নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে সরকারি কর্মকর্তাদের যোগসাজশ ছাড়া বেসরকারি খাত দুর্নীতি করতে পারে না। এমনকি ব্যাংকিং চ্যানেলে ওভার ভয়েসের মাধ্যমে অসাধু ব্যবসায়ীরা যে বিদেশে অর্থ পাচার করেন, তা রোধেও আইনি ব্যবস্থা আছে।

মুখ দেখে অভিযোগ আমলে নিলে কিংবা বড় দুর্নীতিবাজদের ছাড় দিয়ে ছোটদের পাকড়াও করলে রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি বন্ধ বা হ্রাস হবে না। হালে দুদক হাওরে বাঁধ কেলেঙ্কারির হোতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে একটি পুণ্যের কাজই করেছে। আমরা আস্থা রাখতে চাই, একইভাবে দুদক ২০১০ সালের শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, হল-মার্ক, বেসিক ব্যাংক, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির হোতাদেরও পাকড়াও করবে। বাছাই করা মামলা ও বিচার যে দুর্নীতির গায়ে সামান্য আঁচড় লাগাতে পারে না, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে গৃহীত পদক্ষেপ তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

আমরা যদি ব্যাংকিং খাত কিংবা সড়ক-মহাসড়ক কিংবা প্রবাসী আয়ের দিকে তাকাই, তাহলে বলার উপায় নেই যে সবকিছু ঠিকঠাকমতো চলছে। চালের দাম বাড়ার জন্য নাহয় সরকার প্রাকৃতিক দুর্যোগের দোহাই দেবে। কিন্তু ঢাকাসহ সারা দেশের রাস্তাঘাটের এই দুরবস্থা কেন? কেন বছর না যেতেই মেরামত করা সড়কে খানাখন্দ তৈরি হয়? কেন দেড় বছরের উড়ালসড়কের কাজ শেষ করতে তিন বছর লাগে? এর পেছনের বড় ধরনের দুর্নীতি আছে বলেই মানুষ মনে করছে।

চলতি সপ্তাহে আরেকটি উদ্বেগজনক খবর। গত ছয় বছরের মধ্যে প্রবাসী আয় সর্বনিম্ন। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রবাসী আয় কমেছিল সাড়ে ১৪ শতাংশ। ওই বছর প্রবাসীরা পাঠান ১ হাজার ২৭৬ কোটি ডলার। আর আগের বছর (২০১৫-১৬) প্রবাসী আয় ছিল ১ হাজার ৪৯৬ কোটি ডলার। আর চলতি অর্থবছরে কমেছে আড়াই শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের হিসাবমতে, বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস প্রবাসী আয়, যা মোট ঋণ ও বৈদেশিক বিনিয়োগের চেয়ে বেশি। আমাদের আমদানি ও রপ্তানিতে যে বিশাল ফারাক, তার পুরোটাই মিটিয়ে থাকে এই প্রবাসী আয়। ভবিষ্যতে প্রবাসী আয় আরও কমে গেলে বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডারেও টান পড়বে।

আমরা যখন মহাসমারোহে উন্নয়নের ঢাক পেটাচ্ছি, তখন কাছের বা দূরের দেশগুলোর দিকে কি একবার তাকিয়ে দেখছি? দুই কোটি লোকের ঢাকা যদি পৃথিবীর দ্বিতীয় বা তৃতীয় বসবাসের অযোগ্য শহর হয়ে থাকে, তাহলে উন্নয়নটা হলো কোথায়?
স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর যদি চার কোটি মানুষ নিরক্ষর থাকে (গণশিক্ষামন্ত্রীর তথ্য অনুযায়ী সাক্ষরতার হার ৭১ শতাংশ), আড়াই কোটি মানুষ অপুষ্টিতে ভোগে তাহলে কীভাবে দাবি করতে পারি দেশ সঠিক পথে এগোচ্ছে?

বৈশ্বিক মানবসম্পদ সূচকে গত বছরের তুলনায় সাত ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ।  ১৩০টি দেশের মধ্যে এবার বাংলাদেশের অবস্থান ১১১তম। জাতিসংঘের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সলিউশনস নেটওয়ার্ক ২০১৭ সালের যে অগ্রগতি প্রতিবেদন দিয়েছে, তাতে এসডিজি সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫৭টি দেশের মধ্যে ১২০তম। সার্বিক মান ১০০-এর মধ্যে ৫৬ দশমিক ২। পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়ার গড় মান ৬৩ দশমিক ৩। আর অর্থনৈতিক সক্ষমতায় এবার বাংলাদেশ সাত ধাপ এগিয়েছে বলে বিশ্ব অর্থনীতি ফোরাম যে সনদ দিয়েছে, তাতেও দেখা যাচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র পাকিস্তানই আমাদের পেছনে। ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা এমনকি ভুটানেরও পেছনে বাংলাদেশ।

দেশের মানুষ বহুমুখী সমস্যার মুখোমুখি। কয়েক মাসের ব্যবধানে ৪৫ টাকা কেজির চাল ৭০ টাকা হয়েছে। গরুর মাংসের কেজি ৫০০ টাকা। ৫০ টাকার নিচে কোনো সবজি পাওয়া যায় না। সরকার দফায় দফায় পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাসের দাম বাড়াচ্ছে। লাখ লাখ শিক্ষিত তরুণ বেকার। অনেকে বিপথগামী। কিন্তু প্রধান দুই দলের নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতি শুনলে বা পড়লে মনে হয়, মিয়ানমার
থেকে প্রাণের ভয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থী ছাড়া দেশে দ্বিতীয় সমস্যা নেই।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য
প্রায় প্রতিদিনই পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে। তাঁরা রোহিঙ্গাদের নিয়ে রাজনীতি করলেও সমস্যার ভয়াবহতা বুঝতে চাইছেন না বা বুঝতে পারছেন না। বিশেষজ্ঞদের মতে, একাত্তরের পর বাংলাদেশ এত বড় কঠিন সমস্যায় আর পড়েনি। এ সময়ে আমাদের জাতীয় ঐক্য সবচেয়ে জরুরি। অথচ রাজনৈতিক দলগুলো বিবাদে লিপ্ত হচ্ছে। সরকারি দলের নেতা–মন্ত্রীরা মনে করছেন, কথা বললেই তঁারা হেরে যাবেন।

একসময় বলা হতো বাংলাদেশ পৃথিবীর এক নম্বর সমগোত্রীয় দেশ। এখানে ৯৮ শতাংশ মানুষ একই ভাষায় কথা বলে এবং ৯০ শতাংশ মানুষ একই ধর্মাবলম্বী। অথচ আমাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে বিভেদ ও বিদ্বেষ। আমরা ধর্মকে কেবল রাজনীতির হাতিয়ার করিনি, তাকে ধর্মবিশ্বাসের কাতারে নিয়ে এসেছি। যে আমার রাজনীতি করবে না, সে আমার শত্রু এবং দেশদ্রোহী। দেশের দুটি প্রধান দলের রাজনৈতিক দর্শন যদি এমন হয় এবং একে অপরকে ঘৃণা করতে থাকে, তাহলে দেশ, গণতন্ত্র কোনোটাই নিরাপদ নয়। বর্তমান রাজনৈতিক বৈরিতার জন্য কার কতটুকু দায়, সেই বিতর্কের চেয়েও জরুরি হলো এই অপসংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা।

আমরা এসব কথা যখন বলছি, তখন নিশ্চয়ই ২১ আগস্টের নারকীয় হামলার কথা ভুলে যাচ্ছি না। সেদিন যেই দুর্বৃত্তরা গ্রেনেড হামলা চালিয়ে মানুষ হত্যা করেছিল, একটি দলের নেতৃত্বকে শেষ করে দিতে চেয়েছিল, যারা তাদের ঘৃণ্য অপরাধ ঢাকতে জজ মিয়া নাটক বানিয়েছিল, তাদের বিচার ও কঠোর শাস্তি হোক। তাই বলে দুই দলের নেতাদের মধ্যে কথাবার্তা হবে না কেন? তাঁদের মধ্যে সামাজিক, পারিবারিক ও ব্যবসায়িক সম্পর্ক থাকতে পারলে রাজনৈতিক সম্পর্ক কেন থাকবে না?

অাওয়ামী লীগ নেতাদের মনে রাখতে হবে, সমস্যার সমাধান না হলে শেষ বিচারে ব্যর্থতার দায় সরকারের ওপরই বর্তাবে। তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম বিএনপির পরামর্শক্রমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মস্কো, বেইজিং ও দিল্লিতে ঝটিকা সফরে গিয়ে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করে ফেললেন, তাহলে কে লাভবান হবে? সরকারই লাভবান হবে।

আমরা মানবিক কারণে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছি, দেব। কিন্তু অনন্তকাল তো আমরা তাদের ভার বহন করতে পারব না। সরকারকে পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা ‍+ ১৬ কোটি মানুষের সমস্যা নিয়ে ভাবতে হবে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য যেন ১৬ কোটি মানুষ মনোযোগ না হারায়। সরকারকে মনে রাখতে হবে, রোহিঙ্গা শরণার্থী নিয়ে দেশের বাইরে ও ভেতরে যে আবেগ-উচ্ছ্বাস তৈরি হয়েছে, তা বেশি দিন থাকবে না। প্রয়োজনীয় সাহায্য–সমর্থনও পাওয়া যাবে না। তীব্র প্রতিযোগিতামূলক এই বিশ্বে সবাই নিজের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত। নয় লাখ (আগের চার লাখসহ)রোহিঙ্গা শরণার্থীর দায় বয়ে বেড়াতে হবে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল এবং জনসংখ্যার ভারে প্রায় ন্যুব্জ বাংলাদেশকেই।

বাংলাদেশের তুলনায় ভারত অনেক শক্তিশালী দেশ। তারপরও সেখানে প্রায় ৭০ বছর ধরে কয়েক লাখ তিব্বতি শরণার্থী আছে। বিশ্ব সম্প্রদায় তা নিয়ে মাথা ঘামায় না। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তিব্বতি নেতা দালাই লামার সঙ্গে বৈঠকের আগে চিন্তা করেন চীনের প্রতিক্রিয়া কী হবে। দেশে দেশে ফিলিস্তিনিরা ৫০ বছরের অধিক সময় ধরে উদ্বাস্তু জীবনযাপন করছে, কটি দেশ তাদের প্রতি সহায়তায় হাত বাড়িয়েছে? আগে আরব দেশগুলো ফিলিস্তিনিদের পাশে ছিল। এখন তারা শিয়া-সুন্নি আত্মঘাতী লড়াইয়ে মত্ত।

আমরা যদি দ্রুত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফেরত পাঠাতে না পারি, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, পরিবেশ ও আইনশৃঙ্খলার ওপর যে বিরাট চাপ পড়বে, তা বহনের ক্ষমতা আমাদের নেই। ইতিমধ্যে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে বিভিন্ন স্থানে নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘুদের হয়রানি ও হামলার খবর পাওয়া যাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের সমর্থনে আয়োজিত সমাবেশে মানববন্ধনে উসকানিমূলক কথাবার্তাও বলছেন কেউ কেউ। এখনই সজাগ না হলে বড় ধরনের বিপদ হতে পারে।

আবার শুরুর কথায় ফিরে আসি। উল্টো পথে গাড়ি চললে সঠিক পথে আনা কঠিন নয়। রাস্তা বন্ধ করে কিংবা গাড়ির চালক ও মালিককে জরিমানা করে সঠিক পথে আনা যায়। কিন্তু কোনো দেশ যদি উল্টো পথে চলে, রাষ্ট্রীয় নীতি ও রাজনীতি যদি ঠিক না থাকে, তাহলে দেশকে সঠিক পথে আনা খুবই দুরূহ।

সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।

sohrabhassan55@gmail.com