১৯ জানুয়ারি নির্বাচন কমিশন উপজেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে প্রাথমিকভাবে ১০২টি উপজেলার নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করেছে। পরে ২৩ জানুয়ারি আরও ১১৭টি উপজেলার জন্য তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। উপজেলা পরিষদের মেয়াদ শেষের পথে, তাই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া জরুরি। কিন্তু নির্বাচনটি নিয়ে আমাদের মনে কিছু গুরুতর প্রশ্ন রয়েছে।
আমাদের প্রথম প্রশ্নটি হলো নির্বাচনপদ্ধতি-সম্পর্কিত। নির্বাচনটি কি দলীয় ভিত্তিতে হবে, না নির্দলীয়ভাবে হবে? বিদ্যমান বিধিবিধান অনুযায়ী, নির্বাচনটি নির্দলীয়। প্রসঙ্গত, অনেকেই নির্দলীয় নির্বাচনকে অরাজনৈতিক বলে দাবি করেন। এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা। কারণ, নির্বাচন একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, যা দলীয় ভিত্তিতে বা নির্দলীয়ভাবে অনুষ্ঠিত হতে পারে। তাই নির্দলীয় নির্বাচন রাজনীতিবিবর্জিত নয়।
অনেকে দলভিত্তিক স্থানীয় নির্বাচনের পক্ষে, কারণ তাদের কাছে রাজনীতি মানেই দল—দল ছাড়া তারা রাজনীতির কথা ভাবতেই পারে না। তাই দলীয় পরিচয়ের বাইরের নির্বাচনকে তারা ‘বিরাজনীতিকরণ’ বলে আখ্যায়িত করে। কিন্তু রাজনীতি একটি প্রক্রিয়া—সব স্বার্থসংশ্লিষ্টদের সম্পৃক্ত করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া, যা দলকে সম্পৃক্ত করেও হতে পারে, না করেও হতে পারে। বস্তুত ‘পলিটিকস’ বা রাজনীতি শব্দের উৎপত্তি গ্রিক শব্দ ‘পলিস’ থেকে, যার অর্থ নগরভিত্তিক রাষ্ট্র। তাই ‘পলিটিক্যাল অ্যাকটিভিটির’ বা রাজনৈতিক কার্যক্রমের উদ্দেশ্য দল সৃষ্টি নয়, দলীয় ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনাও নয়, বরং একটি অন্তর্ভুক্তিকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বিরোধ অবসান এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ। এর সঙ্গে দলের সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই, যদিও দল এখন রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। তাই নির্দলীয় নির্বাচনের অর্থ রাজনীতি বিসর্জন নয়।
রাজনৈতিক দলের মনোনয়নের ভিত্তিতে স্থানীয় সরকার নির্বাচন পরিচালিত না হওয়ার কারণে বিরাজনীতিকরণের অভিযোগ তোলা হলেও, বস্তুতপক্ষে আমাদের দেশে বিরাজনীতিকরণ হয়েছে মূলত ‘মনোনয়ন-বাণিজ্যে’র ফলে। অর্থ দিয়ে কিংবা অন্য কোনো সুযোগ-সুবিধার বিনিময়ে আমাদের দেশে মনোনয়ন, বিশেষ করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন ‘বিক্রি’ হয়। এ প্রক্রিয়ায় নিষ্ঠাবান রাজনীতিবিদেরা মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত হন। ফলে আমাদের জাতীয় সংসদ হয়ে পড়েছে এখন অনেকটা কোটিপতিদের ক্লাবে।
স্মরণ করা যেতে পারে, পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন পঞ্চায়েত মন্ত্রী আনিসুর রহমানের সঙ্গে বৈঠক শেষে ২০১০ সালের ৪ আগস্ট আমাদের স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম আসন্ন পৌরসভা নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে আনিসুর রহমান দলভিত্তিক স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পক্ষে-বিপক্ষে অনেক যুক্তি দেন। বস্তুত এ সিদ্ধান্তের পক্ষে-বিপক্ষে অনেক কথা রয়েছে।
প্রথমত, স্থানীয় সরকারের নির্বাচন নির্দলীয় হলে প্রার্থীর সংখ্যা বেশি হয় এবং ভোটারদের ‘চয়েজ’ বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরিধি বৃদ্ধি পায়। স্থানীয় পর্যায়ে অনেক সমাজসেবী আছেন, যাঁরা কোনো দলের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নন বা যুক্ত হতে চান না; যদিও এ ধরনের ব্যক্তির সংখ্যা দিন দিন সমাজে কমে যাচ্ছে। তাঁদের মধ্যে এমনও ব্যক্তি আছেন, যাঁরা অত্যন্ত যোগ্য, সম্মানিত ও স্থানীয় জনগণের আস্থাভাজন। দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচন হলে এসব ব্যক্তির নির্বাচিত হয়ে আসার সুযোগ সীমিত হয়ে পড়ে, ফলে তাঁরা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী ও সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদপ্রার্থীর সংখ্যা যেখানে ছিল ৪৬, সেখানে দলীয়ভিত্তিক মনোনয়ন দেওয়ার ফলে ২০১৩ সালের নির্বাচনে প্রার্থীর সংখ্যা এসে দাঁড়ায় সাকল্যে ১২-তে।
নির্দলীয় স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পক্ষে আরেকটি যুক্তি হলো, এর মাধ্যমে দলবাজির সর্বনাশা প্রভাব তৃণমূলে পৌঁছানোর প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করা সম্ভব। রাজনৈতিক দল গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু দলবাজি সম্পূর্ণই অনাকাঙ্ক্ষিত। বস্তুত রাজনৈতিক দল গণতন্ত্রের চালিকাশক্তি এবং দল ছাড়া গণতন্ত্র কার্যকর হতে পারে না। কিন্তু দলবাজি প্রতিফলিত হয় দলের প্রতি অন্ধ আনুগত্য, দলাদলি, দলীয়করণ ও দলীয় বিবেচনায় সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা সুযোগ-সুবিধা বিতরণ এবং এর বিরূপ প্রভাব অত্যন্ত মারাত্মক। পশ্চিমবঙ্গের ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতি, সিপিএম এবং তৃণমূল কংগ্রেসের ক্যাডারদের মধ্যে প্রতিনিয়ত মারামারি বহুলাংশে দলভিত্তিক স্থানীয় নির্বাচনেরই বিষফল বলে অনেক পর্যবেক্ষকের ধারণা। আমরা কি সেদিকে যেতে চাই?
দুর্ভাগ্যবশত দলবাজি ইতিমধ্যেই আমাদের গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। ফলে নব্বইয়ের শুরুতে একতাবদ্ধ হলেও আমরা আজ চরমভাবে একটি বিভক্ত জাতি। এই বিভক্তি ও পারস্পরিক হানাহানি জাতি হিসেবে আমাদের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করছে। কারণ ইতিহাসের শিক্ষা হলো, যে জাতি যত ঐক্যবদ্ধ, তারা তত উন্নত ও সমৃদ্ধ।
দলভিত্তিক নির্বাচনের মাধ্যমে শুধু প্রতিদ্বন্দ্বী দলের মধ্যেই নয়, দলের ভেতরেও কোন্দল সৃষ্টি হতে পারে, যার পরিণতি অশুভ না হয়ে পারে না। দল মনোনয়ন প্রদান থেকে বিরত থাকলে, দলের সর্বাধিক জনপ্রিয় ব্যক্তি নির্বাচিত হয়ে আসার সুযোগ পান, যেমন ঘটেছিল গত উপজেলা নির্বাচনে। এতে দল কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। পক্ষান্তরে, দলভিত্তিক নির্বাচনের আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের কারণে দলের মধ্যে ক্ষোভ-বিক্ষোভ ও অশুভ প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হতে বাধ্য।
দলভিত্তিক স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে যুক্তি হলো, এর মাধ্যমে দলীয় নীতি-আদর্শ বাস্তবায়নের পথ সুগম হয় এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিরা দলীয় শৃঙ্খলার অধীনে আসে ও অপকর্ম থেকে দূরে থাকতে বাধ্য হন। এটি অনেকটা খোঁড়া যুক্তি, কারণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দায়িত্ব সব নাগরিকের প্রতিনিধিত্ব করা, দলবিশেষের নয়। আর দলীয় শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে বাস্তবতা সম্পূর্ণ বিপরীত। আমাদের সমাজে অধিকাংশ অন্যায় ও গর্হিত কাজই পরিচালিত হয় সরাসরি দলীয় ছত্রচ্ছায়ায় অথবা দলীয় সমর্থনে। বস্তুত দলের, বিশেষ করে সরকারি দলের সমর্থন ছাড়া কেউই অপরাধ করে পার পায় না। এ ছাড়া আমাদের দেশে অপরাধীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক দলীয় অনুশাসনের প্রয়োগ অনুপস্থিত বললেই চলে। এ ছাড়া দলভিত্তিক নির্বাচন করতে হলে দলে গণতন্ত্র ও দায়বদ্ধতা থাকা আবশ্যক। আরও আবশ্যক দলীয় মনোনয়ন প্রদানের একটি স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি।
বর্তমানে উপজেলা পরিষদ সম্পূর্ণরূপে একটি অকার্যকর প্রতিষ্ঠান। সাংসদদের অযাচিত নিয়ন্ত্রণ ও কর্মকর্তাদের অসহযোগিতার ফলেই তা ঘটেছে। উপজেলা পরিষদ আইনে সাংসদদের উপদেষ্টা করে তাঁদের পরামর্শ মানা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। একইভাবে যে ১৭টি বিভাগ উপজেলা পরিষদে হস্তান্তর করার নির্দেশনা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জারি করা হয়েছে, তা আজও কার্যকর হয়নি। আমরা ভুলে গেছি যে স্থানীয় সরকারের উদ্দেশ্য হলো স্থানীয় পর্যায়েও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের তথা গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা।
আর নগ্নভাবে সংবিধান লঙ্ঘন করেই সাংসদেরা উপজেলার ওপর কর্তৃত্ব করছেন। কারণ, সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদে তাঁদের শুধু ‘আইন প্রণয়নের ক্ষমতা’ দেওয়া হয়েছে এবং সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদে স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের স্থানীয় উন্নয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আর সংবিধানের ৭(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রজাতন্ত্রের সব ‘ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে’।
উচ্চ আদালতও সাংসদদের স্থানীয় উন্নয়নকাজে জড়িত হওয়াকে অসাংবিধানিক বলে রায় দিয়েছেন। স্মরণ করা যেতে পারে, বর্তমান মন্ত্রিপরিষদের সদস্য আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর ‘জেলা মন্ত্রী পদ’ সৃষ্টির বিরুদ্ধে করা মামলায় বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ও বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীর ২০০৬ সালে এই রায় দেন [আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বনাম বাংলাদেশ, ১৬ বিএলটি (এইচসিডি) ২০০৮]। তাই উপজেলা আইনে সাংসদদের কর্তৃত্বের অবসান না ঘটালে, সংবিধান রক্ষার যুক্তিতে একটি বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত বর্তমান সরকার সংবিধানকেই পদদলিত করবে।
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর অতীতের একটি লেখার কথা বিনীতভাবে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। দারিদ্র্য দূরীকরণ: কিছু চিন্তাভাবনা (আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৯) গ্রন্থে তিনি লিখেছেন: ‘ইতিপূর্বে স্থানীয় সরকার গড়ার প্রচেষ্টা বিভিন্ন সময় দেখা গেলেও কার্যত তা কেন্দ্রীয় সরকারের সম্প্রসারিত শাখায় পর্যবসিত হয়েছিল এবং অনেক ক্ষেত্রেই স্থানীয় সরকারকে সরকারি দলের রাজনৈতিক প্রয়োজনে ব্যবহার করা হয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া যেমন একটি দিক, স্থানীয় সংগঠনের প্রতিনিধিদের অধিকার সম্প্রসারণও তেমনি গুরুত্বপূর্ণ দিক। আমি এখানে যে স্থানীয় সরকারের কথা বলছি, তা হবে স্থানীয় পর্যায়ে সব উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের চালিকাশক্তি।’ এ জন্য আইনের সংশোধন জরুরি।
পরিশেষে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন চলাকালে নির্বাচন কমিশন স্থানীয় পর্যায়ে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। কমিশনের কাছে আমাদের প্রশ্ন: আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে তারা কী ব্যবস্থা নেবে, যাতে গত নির্বাচনের সময়কার সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পুনরাবৃত্তি না ঘটে? আমরা আতঙ্কিত।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্যনাগরিক।