স্থানীয় সরকার

উপজেলা নির্বাচন ও ইসির প্রহসন

উপজেলা নির্বাচনে অনেক কেন্দ্রে সংঘর্ষ ঘটলেও ইসি ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে
উপজেলা নির্বাচনে অনেক কেন্দ্রে সংঘর্ষ ঘটলেও ইসি ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে

ব্যাপক অনিয়ম, কারচুপি ও সহিংসতার মধ্য দিয়ে পঞ্চম পর্বের উপজেলা পরিষদ নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ফুটেজ ও সংবাদপত্রের শিরোনাম থেকে নির্বাচনী অপরাধের ব্যাপ্তি ও নির্বাচনব্যবস্থার ওপর এর প্রভাব সম্পর্কে একটি সম্যক ধারণা পাওয়া গেছে। উদাহরণস্বরূপ, নির্বাচনের পরের দিনের প্রথম আলোর হেডলাইন ছিল: ‘নির্বাচনব্যবস্থা তছনছ, প্রশ্নের মুখে আওয়ামী লীগ’ (২ এপ্রিল ২০১৪)। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠান। কিন্তু এটি সুস্পষ্ট যে কমিশন তার দায়িত্ব পালনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে।
নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলে প্রথম দিকে সাফাই গাইলেও কমিশন এখন আইনের দুর্বলতার কারণে নির্বাচনে কিছু অনিয়ম হয়েছে বলে দাবি করছে। ক্রমবর্ধমান অনিয়মের মুখে কমিশনের সদস্যরা বলছেন, রিটার্নিং কর্মকর্তা নির্বাচনে অনিয়মের প্রতিবেদন না দিলে কমিশনের পক্ষ থেকে কিছুই করার থাকে না। অর্থাৎ, কমিশন সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর, যাঁরা উপজেলা নির্বাচনে রিটার্নিং ও প্রিসাইডিং কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন, সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল। কমিশন বস্তুত ‘পোস্ট অফিস’-এর ভূমিকা পালন করে। তাই কমিশন এখন নির্বাচনী ফলাফল বাতিল করার ক্ষমতা চাইছে, যে ক্ষমতা বর্তমানে তাদের নেই বলে তারা দাবি করছে (আলোকিত বাংলাদেশ, ৬ এপ্রিল ২০১৪)।
কমিশন নিজেদের ক্ষমতাহীনতার, বিশেষত তাদের ফলাফল বাতিলের ক্ষমতা নেই বলে যে দাবি করছে, তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। এ ব্যাপারে আমাদের উচ্চ আদালতের একাধিক সুস্পষ্ট রায় রয়েছে। তাই রিটার্নিং কর্মকর্তার অসহযোগিতার মুখে কমিশনের সদস্যদের পক্ষে কিছুই করার নেই—এই দাবির মাধ্যমে জনগণকে শুধু বিভ্রান্তই করছেন না, তাঁরা নিজেদের সততা, নিরপেক্ষতা ও যোগ্যতা সম্পর্কে জনমনে বিরাজমান ব্যাপক সন্দেহকে আরও ঘনীভূত করছেন।
এ কথা সত্য যে হালনাগাদকৃত উপজেলা পরিষদ নির্বাচন বিধিমালা, ২০১৩-এর ৩৯ ধারায় কতিপয় পরিস্থিতিতে প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে যেকোনো ভোটকেন্দ্রের নির্বাচন বন্ধ রাখবার ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। ভোট গ্রহণ বন্ধ করা হলে অবশ্য প্রিসাইডিং কর্মকর্তা তা রিটার্নিং কর্মকর্তাকে অবগত করবেন এবং রিটার্নিং কর্মকর্তা সেই ঘটনা অবিলম্বে নির্বাচন কমিশনকে অবহিত করবেন। আর ওই ভোটকেন্দ্রের ওপর সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকার সার্বিক ফলাফল নির্ধারণ নির্ভর করলে কমিশন ওই ভোটকেন্দ্রে পুনর্নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে।
এ ছাড়া নির্বাচন বিধিমালার ৫৫ ধারায় বলা হয়েছে, নির্বাচনী বিরোধের ক্ষেত্রে নির্বাচন ট্রাইব্যুনালে ‘নির্বাচনী দরখাস্ত দাখিল ব্যতীত, নির্বাচন সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না’। অর্থাৎ, নির্বাচন বিধিমালায় সুস্পষ্টভাবে কমিশনকে নির্বাচন স্থগিত বা বাতিল করার ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। প্রসঙ্গত, উপজেলা পরিষদ আইন, ১৯৯৮-এর ৬৩ ধারার ক্ষমতাবলে কমিশন নিজেই নির্বাচন বিধিমালা প্রণয়ন এবং তা সংশোধন করতে পারে। এর জন্য জাতীয় সংসদের অনুমোদনের প্রয়োজন হয় না। তাই কমিশন ইচ্ছা করলেই যেকোনো দিন বিধি সংশোধন করে নির্বাচন বাতিল করার সুস্পষ্ট ক্ষমতা গ্রহণ করতে পারে। উল্লেখ্য, ভারতীয় নির্বাচন কমিশনের বহু কথিত অতুলনীয় ক্ষমতার ব্যাপারে জনশ্রুতি থাকলেও বাস্তবে ভারতীয় নির্বাচন কমিশনের বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা নেই। ফলে আমাদের কমিশন ভারতীয় কমিশন থেকে অনেক বেশি ‘ক্ষমতায়িত’।
উপরন্তু, উপজেলা পরিষদ নির্বাচন বিধিমালায় নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচন বাতিল করার ক্ষমতা সুস্পষ্টভাবে না দেওয়া থাকলেও আমাদের উচ্চ আদালতের মতে, নির্বাচন কমিশনের সেই ক্ষমতা রয়েছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের একাধিক রায় রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, আলতাফ হোসেন বনাম আবুল কাশেম মামলার [৪৫ডিএলআর (এডি)(১৯৯৩)] রায়ে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সর্বসম্মত রায়ে বলেন: ‘“তত্ত্বাবধান, নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণে”র বিধানের অধীনে নির্বাচন কমিশনকে যে অন্তর্নিহিত ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে তার অর্থ হল যে, শুধুমাত্র সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে কমিশনের আইনি বিধিবিধানের সঙ্গে সংযোজনেরও ক্ষমতা রয়েছে।’ আইনি বিধিবিধান প্রণয়ন করার ক্ষমতা একমাত্র আইনসভার। কিন্তু সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের খাতিরে আমাদের সংবিধান নির্বাচন কমিশনকে সেই ক্ষমতাও দিয়েছে। অর্থাৎ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিধিবিধানের সীমাবদ্ধতা ও অস্পষ্টতা দূর করার ক্ষমতা কমিশনের রয়েছে। প্রসঙ্গত, অনিয়মের তদন্ত করা আইনি বিধিবিধানের সঙ্গে সংযোজন করার ক্ষমতার অংশ [আলতাফ হোসেন বনাম আবুল কাশেম]।
উল্লিখিত রায়ে আরও সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে: ‘নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়েছে এবং রিটার্নিং অফিসার বা প্রিসাইডিং অফিসার কর্তৃক কোনো গোলযোগের বা কারচুপির রিপোর্ট না দেওয়ার কারণে নির্বাচন কমিশনের হস্তক্ষেপ করার কোনো ক্ষমতা নেই বলে যে সাধারণ নিয়ম রয়েছে তা সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। উদাহরণস্বরূপ, যদি ইস্যুকৃত ব্যালট পেপার থেকে বা নিবন্ধিত ভোটার সংখ্যা থেকে ভোট প্রদানের হার বেশি হয়, তাহলে কমিশন হস্তক্ষেপ করতে পারে, সবকিছু শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছে বলে রিপোর্ট প্রদান সত্ত্বেও।’
নির্বাচন কমিশনের নির্বাচনী ফলাফল বাতিলের ক্ষমতা সম্পর্কে আমাদের উচ্চ আদালতে আরও রায় রয়েছে। নূর হোসেন বনাম মো. নজরুল ইসলাম মামলার [৪৫বিএলসি (এডি)(২০০০)] রায়ে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ কমিশনের নির্বাচনী ফলাফল বাতিলের এবং নতুন করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের নির্দেশ দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে বলে সুস্পষ্ট রায় দেন। ওই মামলার বিবরণী থেকে জানা যায়, ১৯৯৭ সালে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নূর হোসেন, মো. নজরুল ইসলামসহ ১৪ জন সিদ্ধিরগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। নির্বাচনে মো. নজরুল ইসলাম জয়লাভ করেন। নির্বাচনের দিন নূর হোসেনের নির্বাচনী এজেন্ট প্রথমে কর্তব্যরত ম্যাজিস্ট্রেট এবং পরবর্তী সময়ে দুটি কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তার কাছে নির্বাচনে অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ উত্থাপন করেন। একই দিন তিনি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছেও অনুরূপ অভিযোগ করেন। ম্যাজিস্ট্রেট ও প্রিসাইডিং কর্মকর্তা অভিযোগের প্রতি কোনোরূপ কর্ণপাত করেননি; বরং রিটার্নিং কর্মকর্তা সব কেন্দ্রের নির্বাচনী ফলাফল একত্র করে মো. নজরুল ইসলামকে বিজয়ী ঘোষণা করেন এবং ফলাফল গেজেটে প্রকাশের জন্য কমিশনে প্রেরণ করেন।
নূর হোসেনের নির্বাচনী এজেন্টের আরেকবার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন একজন ডেপুটি নির্বাচন কমিশনার দিয়ে তদন্ত করে অভিযোগকৃত দুটি কেন্দ্রে গোলযোগের প্রমাণ পায়, যার পরিপ্রেক্ষিতে কমিশন কেন্দ্র দুটির নির্বাচন বাতিল করে পুনর্নির্বাচনের নির্দেশ দেয়। পরবর্তী সময়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা কর্তৃক ঘোষিত নির্বাচিত চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলামের একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ‘নির্বাচন-পরবর্তীকালে অভিযোগ’ উত্থাপনের অজুহাতে কমিশনের নির্বাচনী ফলাফল বাতিলের সিদ্ধান্তকে অবৈধ বলে রায় দেন, যার বিরুদ্ধে নূর হোসেন আপিল বিভাগের শরণাপন্ন হন।
প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত আপিল বিভাগের চার সদস্যের বেঞ্চ হাইকোর্টের রায় খারিজ করে দেন। বিচারপতি এবাদুল হকের লিখিত এবং ১৯৯৮ সালের ১৩ এপ্রিল ঘোষিত রায়ে বিচারপতিরা বলেন: ‘আমরা এ কথা পুনর্ব্যক্ত না করে পারি না যে, নির্বাচন চলাকালে গোলযোগের, ব্যালট পেপার কারচুপির বা নির্বাচন সঠিক, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন হয়নি বলে রিপোর্ট বা অভিযোগ উত্থাপিত হলে, উক্ত রিপোর্ট বা অভিযোগের সত্যতা যাচাইপূর্বক কমিশনের ফলাফল বাতিল ও পুনর্নির্বাচনের নির্দেশ দেওয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক। কিন্তু নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হলে নির্বাচন-পরবর্তী অভিযোগের প্রেক্ষিতে নির্বাচনী ফলাফল বাতিল করার কমিশনের সিদ্ধান্ত সঠিক হবে না।’
এ প্রসঙ্গে আদালত এ এফ এম শাহ আলম বনাম মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য [৪১ডিএলআর(এডি) (১৯৮৯)] মামলার রায় উদ্ধৃত করেন, যে রায়ে আগে আপিল বিভাগ বলেন: ‘নির্বাচন নেই অর্থাৎ গণতন্ত্র নেই। গণতন্ত্র অব্যাহত রাখার জন্য নির্বাচন প্রয়োজন এবং বিকৃত অথবা ভোটারবিহীন নির্বাচন গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে।’ তাই বিধিতে প্রদত্ত কমিশনের রিভিউ করার ক্ষমতা সততা, সঠিক ও নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করার জন্য আবশ্যক। প্রসঙ্গত, গত ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত বিতর্কিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে আমাদের উচ্চ আদালতের এ মতামত অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য।
পরিশেষে শোনা যায় যে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম, কারচুপি ও সহিংসতার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন এলাকার রিটার্নিং ও প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের এসব অভিযোগের ব্যাপারে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছে।
আমরা জানি না, এর মাধ্যমে কমিশন কার চোখে ধুলা দেওয়ার চেষ্টা করছে! কারণ, অভিযোগ কিন্তু এসব কর্মকর্তার অনেকের বিরুদ্ধেই, যাঁরা হয় নিজেরাই বিভিন্ন ধরনের নির্বাচনী অপরাধের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত কিংবা তাঁরা এসব অপরাধের অভিযোগ আমলে নেননি। তাই আমরা মনে করি, কমিশনের এই উদ্যোগ আরেকটি প্রহসন বৈ কিছুই নয়!

ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।