কয়েক দিন ধরে লক্ষ করছি, ইসরায়েল গাজাসহ জেরুজালেমে ফিলিস্তিন জনগণের ওপর পাশবিক তাণ্ডব চালাচ্ছে। কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত না করাই মানবতার ধর্ম কিন্তু ইসরায়েলের নিরাপত্তা বাহিনী পবিত্র রমজান মাসে আল-আকসা মসজিদে ঢুকে ধর্ম পালনকারী নিরীহ নারী, পুরুষ ও শিশুদের ওপর যে অত্যাচার করেছে এবং করেই চলেছে, সেই অনুভূতি থেকে লেখা।
আমার মনে আছে, সেটা ২০০২ সালের কথা, জার্মানির স্কুলে গোলাগুলির একটি দুর্ঘটনা ঘটে। সেই দুর্ঘটনায় প্রায় ১৬ জন ছাত্র-শিক্ষক নিহত হন। একসঙ্গে এতগুলো নিষ্পাপ প্রাণের এভাবে অকালমৃত্যু সারা বিশ্বকে নাড়া দেয় এবং ব্যথিত করে। জার্মান সরকার তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করে। পাশাপাশি পৃথিবীর অনেক দেশ জার্মান সরকার ও জনগণের সঙ্গে একাত্মতা জানিয়ে শোক পালনসহ জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখার মতো কার্যক্রম হাতে নেয়। কারণ, মানবতা নিষ্পাপ শিশুসহ নিরপরাধ মৃত্যু মেনে নিতে পারেনি।
২০০২ সাল থেকে ২০২১ সালের চলতি মাস পর্যন্ত অন্তত কয়েক হাজার নিষ্পাপ ফিলিস্তিন শিশু ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছে। কটা দেশ শোক দিবস পালন করেছে বা পতাকা অর্ধনমিত করেছে? করেনি, এর কারণ হলো তিনটি:
নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন: গণমাধ্যম ও বিভিন্ন সংস্থা ফিলিস্তিনিদের এমনভাবে উপস্থাপন করেছে, কোনো নিষ্পাপ নিরপরাধ শিশু-কিশোর ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে মারা গেলে বিশ্ববিবেকের বড় অংশের কাছে খারাপ লাগে না। ব্যাপারটা এমন যে এই শিশুরা ভবিষ্যতের সন্ত্রাসী। তারা মারা গেলে ততটা খারাপ লাগার কিছু নেই, যেমনটা জার্মান শিশুদের বেলায় ছিল।
অনুধাবনের জড়তা বা নিষ্ক্রিয়তা: চোখ-সয়া বা গা-সয়া হয়ে গেছে। ব্যাপারটা তো এমনই হয়, হচ্ছে, হওয়ারই কথা, হয়ে আসছে—এ আবার নতুন কী। এটা অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, এটা ইসরায়েলের নিজস্ব ব্যাপার।
বিতর্কিত হওয়ার ভয় (ইহুদিবিদ্বেষী প্রমাণিত হওয়ার ভয়): আন্তর্জাতিকভাবে পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট হওয়ার ভয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, দেশ, জাতি, সংস্থা কথা বলে না। এটা কতটা প্রভাবিত করে তার দুটি উদাহরণ দিচ্ছি।
সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত জার্মান স্বনামধন্য লেখক গুন্টার গ্রাস ২০১২ সালে মধ্যপ্রাচ্যে ‘নিউক্লিয়ার ইহুদি রাষ্ট্র’ ইসরায়েল নিরাপত্তার জন্য হুমকি ও ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে যে অন্যায় করছে, এ নিয়ে কবিতা এবং তাঁর মতামত প্রকাশ করলে ইসরায়েল ফুঁসে ওঠে। ক্ষমা প্রার্থনা করতে চাপ সৃষ্টি করে। ইসরায়েল তাঁকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে। ‘ইহুদি লবি’ মোটামুটি তাঁকে কোণঠাসা করে ফেলে। বিশ্বে একজন বিতর্কিত বুদ্ধিজীবী/সাহিত্যিকের কাতারে ফেলে দেয়।
২০১৭ সালের নির্বাচনে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট পদ প্রার্থী লিপেন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ফ্রান্সে ইহুদিদের অ্যারেস্টের সঙ্গে ‘রাষ্ট্র ফ্রান্স’ দায়ী ছিল না, বরং তখন যারা সরকারে বা প্রশাসনে ছিল, তারাই দায়ী ছিল, এই উক্তি করায় এবং অতীতে তাঁর রাজনীতিবিদ পিতা ‘হলোকাস্ট’ নিয়ে যে মন্তব্য করেছিলেন, সব মিলিয়ে ইসরায়েল ও ‘ইহুদি লবি’ ভীষণ খেপে যায়। সত্যিকার অর্থে লিপেনের ‘পলিটিক্যাল কফিনে’ ‘ইহুদিবাদী লবি’ শেষ পেরেক মেরে দেয়। অবশ্যই লিপেনের অন্য প্রতিদ্বন্দ্বী এমানুয়েল মাখোঁ দ্রুত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে নিহতদের (হলোকাস্টের শিকারসহ) মেমোরিয়ালে সম্মান জানাতে ছুটে যান। এমানুয়েল মাখোঁ এখন ফরাসি প্রেসিডেন্ট। মোদ্দা কথা, ইহুদিবাদীরা সারা পৃথিবীতে, বিশেষ করে উন্নত বিশ্বে অনেক প্রভাবশালী। তাদের বিপক্ষে দাঁড়ানো ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়।
তাহলে এভাবেই চলবে? হ্যাঁ। যত দিন বাইরের (পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে থেকে) ইহুদিরা বসতি স্থাপন করতে ইসরায়েলে আসবে, তত দিন এমনই চলবে। এই মাইগ্রেশন প্রধানত হচ্ছে ইহুদিবাদী মতবাদ বা নিজস্ব ইসরায়েল রাষ্ট্র ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মতাদর্শের কারণে। অর্থনৈতিক বা অন্যান্য কারণ কিন্তু গৌণ। যারা বসতি স্থাপন করতে আসছে, তারা সংখ্যাগুরু সমাজে সংখ্যালঘুদের বৈষম্যের মানসিকতার ট্রমা সঙ্গে নিয়ে আসছে। সব মিলিয়ে সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার স্বাধীনতা ও সুখবোধ এবং এই আধিপত্য ধরে রাখতে না পারলে আবার সংখ্যালঘু হয়ে যাওয়ার ভয় থেকে একটা অস্বাভাবিক আক্রমণাত্মক মানসিকতা তৈরি করে।
এরপর প্রতিনিয়ত আগমনকারী এসব বসতি স্থাপনকারীর দখলি এলাকায় বা ফিলিস্তিনে বসবাসকারী আরবদের সঙ্গে বসবাস করলেও সহানুভূতি বিকাশ হয় না। তা ছাড়া ইহুদিবাদী মতবাদ ফিলিস্তিন তাদের জন্মভূমি এবং ফিলিস্তিনরা বা আরবরা (ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের উদ্দেশ্যমূলকভাবে ‘আরব’ বলে) তিন হাজার বছর ধরে তাদের আবাসস্থল দখল করে আছে, এই বদ্ধমূল ধারণা তৈরি করে দেয়। সুতরাং ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা অত্যাচার করতে গিয়ে কোনো নৈতিক দ্বিধায় ভোগে না। আমার ইসরায়েলি সহপাঠী ‘অ্যারন’কে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তোমরা ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে এমন অমানবিক আচরণ কেন করো? অ্যারনের উত্তর, আরবদের বেলায় অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও অমানবিক আচরণ ছাড়া অন্য পন্থা কাজে দেয় না। পরে অ্যারন ইসরায়েলের ন্যাশনাল রিজার্ভ ফোর্স কমান্ডারের দায়িত্ব পেয়েছিল।
আমার এক ভারতীয় সহপাঠী বলেছিল, তুমি ইসরায়েলে ঘুরে আসার পর তাদের বর্ণনায় তোমার মনে হবে যে তাদেরও একটি বক্তব্য রয়েছে। আমার ৯-১০ দিনের শিক্ষা সফরে রামাল্লা, জেরিকো, হেবরন, জেরুজালেম ঘুরে ফিলিস্তিনিদের অসহায়ত্ব ও প্রতিনিয়ত যে অপমানকর পরিস্থিতির মাঝ দিয়ে যায়, তাদের যে মানবিক মর্যাদা ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে, এসব দেখে আমি খুব কষ্ট পেয়েছি। হেবরনে এক ফিলিস্তিনি আমার কাছে সাহায্য চাইল, সঙ্গে দু-তিনটা বাচ্চা। সে জানাল তার সাতটি বাচ্চা। আমি বললাম, তোমাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নেই, এমন অবস্থায় সাতটি বাচ্চা কেন? সে যে উত্তর দিল, তা মেনে নেওয়া ভীষণ কষ্টের। আর যা ছিল, ‘এরা সবাই থাকবে না।’ এদের ভেতর কেউ কেউ ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সের মোবাইল টার্গেটে পরিণত হবে।
তারপরও কোথায় যেন মনে হয়েছে ইসরায়েলিদের একটি বক্তব্য রয়েছে। আর আপনি যদি ইহুদি যুবক হন, যাদের অ্যারনের মতো মাথায় ঢুকে গেছে যে আরবরা অমানবিক আচরণ আর বর্বরতা ছাড়া সাড়া দেয় না, তাহলে এই নিষ্ঠুরতা থেকে মুক্তি কীভাবে হবে? আমরা হয়তো অনেকে জানি, ইসরায়েলি তরুণ-তরুণীদের দু-তিন বছর বাধ্যতামূলক সামরিক বাহিনীতে কাজ করতে হয় কিন্তু আমরা অনেকেই হয়তো জানি না যে একজন ইহুদি, তিনি বিশ্বের যেকোনো জায়গার ইহুদিই হোন না কেন, তাঁর জন্য ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীতে দু-তিন বছর দায়িত্ব পালন করা নৈতিকভাবে বাধ্যতামূলক। এটা একজন ইহুদি হয়ে ইহুদি রাষ্ট্র বা জাতিকে রক্ষা করার ব্রত। আর প্রতিনিয়ত এভাবে ফিলিস্তিনিদের অত্যাচারের মাধ্যমে ইসরায়েলি বাহিনীর সদস্যরা সে ব্রত পালন করে চলেছে।
ইসরায়েল ভ্রমণে আমাদের দলের সঙ্গে ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্স থেকে দুটি ছেলে ও দুটি মেয়ে সমন্বয়কারী হিসেবে ছিল, যাদের একজন ছিল ভেনেজুয়েলার, দুজন যুক্তরাজ্য থেকে আর একজন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এদের কারও পরিবার কোনো দিন ইসরায়েলে ছিল না। এরা ইহুদি মতাদর্শের জন্য কাজ করবে। অত্যাচারের মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের ঘরছাড়া করবে এবং কেউ ইচ্ছা হলে ইসরায়েলে থেকে যাবে বা কেউ পবিত্র দায়িত্ব পালন শেষে নিজের দেশে ফিরে যাবে। এরা কিন্তু বিদেশি বা ভাড়াটে যোদ্ধা নয়। বিদেশি বা ভাড়াটে যোদ্ধা হিসেবে কালো তালিকাভুক্ত হবে না, কোনো নিষেধাজ্ঞার বাধায় পড়বে না।
অথচ কোনো মুসলমান তরুণ-তরুণী সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান বা পশ্চিম আফ্রিকার সংঘাতপূর্ণ এলাকাগুলোতে ইহুদি তরুণ-তরুণীদের যেভাবে ইসরায়েল দীক্ষিত হতে যায়, সেভাবে হাজির হলে বিদেশি বা ভাড়াটে যোদ্ধা হিসেবে কালে তালিকাভুক্ত হয়ে যাবে। বড় বিচিত্র এই পৃথিবী। তবে আমার সব সময় মনে হতো, ইসরায়েল ক্ষুদ্র একটি দেশ, যার জনসংখ্যাও ক্ষুদ্র, তারা কীভাবে মধ্যপ্রাচ্যের এতগুলো সম্পদশালী এবং জনবহুল দেশের ওপর ছড়ি ঘোরায়। সৌদি আরবের সামরিক বাজেট প্রায় ৬২ বিলিয়ন ডলার, সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রায় ২৩ বিলিয়ন ডলার, ইরানের প্রায় ১৭ বিলিয়ন ডলার আর ইসরায়েলের সামরিক বাজেট ২০ বিলিয়ন ডলার। কেউ হয়তো বলবেন, আমেরিকা তাদের সঙ্গে আছে। মনে রাখবেন, গাড়ি ধাক্কা দিয়ে চালু করা যায় কিন্তু ধাক্কিয়ে গন্তব্যে নেওয়া যায় না। গাড়ি চালু হওয়ার পর নিজে চলার সক্ষমতা থাকতে হয়। সেটা কী? ২০১৪ সালে দুটি ঘটনায় বিষয়টি আমার কাছে মোটামুটি পরিষ্কার হয়ে যায়, যার একটি এখানে তুলে ধরছি।
যুক্তরাজ্যের রয়্যাল কলেজ অফ ডিফেন্স স্টাডিজে শিক্ষানবিশ অফিসার হিসাবে প্রশিক্ষণরত থাকা অবস্থায় মধ্যপ্রাচ্যে শিক্ষা সফরের অংশ হিসেবে আমরা ইসরায়েলের ডিফেন্স ফোর্স সদর দপ্তর পরিদর্শন করি। আমাদের ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্স সদর দপ্তরে চিফ অব জেনারেল স্টাফের সঙ্গে সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে মিটিং ছিল। লন্ডন থেকে আমাদের বলা হচ্ছিল, তোমরা যখন ইসরায়েলে অবস্থান করবে, তখন সময়ের দিকে খেয়াল রাখবে। যখন ব্রিটিশরা এটা বলছে মানে সময় নিয়ে ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। আমরা যথাসময়ে ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্স সদর দপ্তরে (বেশ উঁচু বিল্ডিং) প্রবেশ করে দেখলাম আমাদের জন্য লিফট নির্দিষ্ট করা আছে। আমরা যথাসময়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে গেলাম। ৯টা ৩০ মিনিটে চিফ অব জেনারেল স্টাফের দেখা নেই। ৯টা ৩৬ মিনিটে ভদ্রলোক হাঁপাতে হাঁপাতে ঢুকলেন। দম নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করলেন এবং বললেন, এটা শুধু ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সে সম্ভব। যেহেতু একটি লিফট নির্দিষ্ট করা ছিল, অন্য তিন-চারটি লিফটের ওপর বাড়তি চাপ, লম্বা লাইন। চিফ অব জেনারেল স্টাফ লাইনে। তিনি যখন দেখলেন ৯টা ২৫ মিনিট, তখন লাইন ভেঙে বের হলেন। একজন সৈনিক বলে উঠল, ‘স্যার, আমরা লাইনে আছি।’ যখন প্রায় ৯টা ৩০ মিনিট, আবার লাইন থেকে বের হয়ে বললেন, ‘আমার একটি কাজ আছে।’ অন্য একজন সৈনিক মন্তব্য করল, ‘স্যার, আমাদের প্রত্যেকেরই কাজ আছে।’
ওই দিন আমার সন্দেহ পরিষ্কার হয়ে গেল কেন ইসরায়েল ছড়ি ঘোরাচ্ছে? আপনি এখন বলুন, মধ্যপ্রাচ্যে কোন সৈনিক কেন, কোন অফিসার তার চিফ অব জেনারেল স্টাফকে এভাবে বলতে পারবে? কোন আমলা, কোন জেনারেল, কোন রাজাদের/যুবরাজদের/আমিরদের এভাবে ‘সত্যিটা’ বলতে পারবে? যেদিন পারবে, মনে রাখবেন, মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলিদের ছড়ি ঘোরানো সেদিন শেষ হয়ে যাবে। উপরন্তু ইসরায়েল একটি জ্ঞানভিত্তিক ও মেধাভিত্তিক দেশ। তারা মেধাকে ওপরে তুলে আনতে ভুল করে না।
পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নতুন ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের আগমন বা বসতি স্থাপন বন্ধ হয়ে যাওয়া বা ইসরায়েলে বসবাসকারী ইহুদি নাগরিকেরা যদি ইসরায়েলে বা ওই অঞ্চলকে অনিরাপদ মনে করে দেশান্তরিত হয়ে চলে যেতে থাকে। মধ্যপ্রাচ্য বা ওই অঞ্চলের দেশগুলো যেন কোনোভাবেই এই হুমকির কারণ না হয়, সে চেষ্টা ইহুদি মতবাদীদের বা তাদের ‘লবি’র সব সময় ছিল (বর্তমানে এ বিষয়ে তারা অনেকাংশে সফল)। ইরানের নিউক্লিয়ার বোমা বানানো নিয়ে ইসরায়েলের এত বিরোধিতা কেন? যদি ইরান নিউক্লিয়ার বোমা বানায়, তাহলে পরদিন ইসরায়েলে ব্যবহার করবে? না, তেমন হবে না। সেটা ইসরায়েলও জানে, তবে একটা ভয় কাজ করবে। ইসরায়েল একটি ধনী দেশ, তাদের জনগণের বড় একটা অংশ পশ্চিমা দেশ থেকে আসা ও সচ্ছল নাগরিক। যাদের এমন পারিপার্শ্বিক অবস্থা, তারা তাদের সন্তানদের আতঙ্কের পরিবেশে মানুষ করতে চাইবে না। ফলে তারা মাইগ্রেশন করবে, সেটা ইহুদিবাদী আন্দোলনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
ভবিষ্যৎ কী? বাস্তবতা কোনো কোনো সময় কল্পকাহিনিকে হার মানায়। আমার কথাগুলো তেমন শোনাতে পারে। মনে রাখতে হবে, ইসরায়েলে জনসংখ্যার গতিপ্রকৃতি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেখানে ‘হারেডিম’ ইহুদি ১২ শতাংশ (১৯৪৮/৪৯ সালে ২ শতাংশ ছিল) যারা ইহুদি রাষ্ট্রে বিশ্বাস করে না, জন্মনিয়ন্ত্রণে বিশ্বাস করে না (পরিবারে ছয়-সাতটি সন্তান), ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীতে যোগ দেয় না, তারা ইসরায়েল রাষ্ট্র বা ইহুদিদের নিজস্ব ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে মনে করে ধর্মবিরোধী। ২১ শতাংশ (বেসরকারিভাবে ২৪-২৫ শতাংশ) আরব (যারা ইসরায়েলের নাগরিক, অধিকৃত ফিলিস্তিন অঞ্চলের অধিবাসী নয়)।
এই দুই গোষ্ঠীর জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার অন্য ইহুদিদের তুলনায় অনেক বেশি। প্রায় ২৭ শতাংশ ইহুদি পরিবার (হারেডিম ব্যতীত) সন্তানহীন। হারেডিমসহ ইহুদিদের পরিবারের গড় সংখ্যা ৩ দশমিক ৫৪। গত ১০ বছরে মোটামুটি একই অবস্থায় আছে। সত্যি বলতে, নতুন নতুন ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের এনে ভারসাম্য রক্ষা করা হচ্ছে (যা মধ্যপ্রাচ্য এলাকাতে ইরানের নিউক্লিয়ার বোমা এসে গেলে ভীতি সঞ্চারের ফলে বাধাগ্রস্ত হতে পারে)। এসব নানা জটিলতায় ইহুদি সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষ চাপে রয়েছে। সঙ্গেই ক্ষমতা, লোভ, ঘরোয়া রাজনীতি, ভয়ের সংমিশ্রণে ইসরায়েল সরকার ফিলিস্তিন অধিকৃত অঞ্চলে, পশ্চিম তীরে নতুন করে বসতি স্থাপন করে চলেছে। এর ফলে ‘দুই রাষ্ট্র তত্ত্ব’-এর সম্ভাবনা ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসছে।
সত্যি বলতে, বর্তমানে পশ্চিম তীরের ম্যাপ দেখলে অনুমান করা যাবে ‘দুই রাষ্ট্র তত্ত্ব’তে ফিরে যাওয়া কার্যত অসম্ভব। ইসরায়েল কি এটা বোঝে না? বোঝে, তবে ঘরোয়া রাজনীতিতে যত বেশি জায়গা দখল করে বসতি স্থাপন করা হবে, তত বেশি রাজনৈতিক ফায়দা পাওয়া যাবে। এভাবে নেতানিয়াহু টিকে আছেন। দীর্ঘমেয়াদি অনিশ্চয়তার বিনিময়ে স্বল্পমেয়াদি প্রাপ্তি। তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে? ইসরায়েলের মোট জনসংখ্যা ৯০ লাখ, এর মাঝে হারেডিম ইহুদি ১২ শতাংশ, আরব ২৪ শতাংশ, মোট ৩২ লাখের কাছাকাছি। আর অধিকৃত এলাকাতে ৬০ লাখ ফিলিস্তিন (দুই রাষ্ট্রতত্ত্ব ব্যর্থ করার কারণে), অর্থাৎ ৯০ লাখের বেশি জনগণকে শাসন করবে পৌনে ৬০ লাখ ইহুদি ধর্মে বিশ্বাসী জনগণ, যেখানে সংখ্যালঘুরা সংখ্যাগুরুদের শাসন করবে। এটা নিশ্চিতভাবেই বর্ণবাদী শাসনে পরিণত হবে।
আর কি কোনো বিকল্প আছে? আছে। সেটা হলো, ইসরায়েলের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সুশীল সমাজ, সাধারণ জনগণ যখন এই ইহুদিবাদের বর্বরতা, ভূমি দখলের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে, যা ঘরোয়া রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে, তখন ফিলিস্তিনিদের প্রতি নির্মম আচরণ হ্রাস পাবে। এবার আমরা স্বল্পসংখ্যক হলেও ইসরায়েলের সাধারণ জনগণকে চলমান নির্মমতার বিরুদ্ধে রাস্তায় নামতে দেখেছি। বেশ কিছুদিন আগে থেকেই ‘ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স’ নামে ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্যদের দ্বারা ‘একটি আন্দোলন’ চলে আসছে, যার মাধ্যমে তারা চাকরিতে থাকাকালীন ফিলিস্তিনিদের ওপর যে অমানবিক নির্যাতন করেছে, তার স্বীকারোক্তি দিচ্ছে এবং এ অত্যাচার বন্ধের জন্য জনমত গড়ে তুলছে। সাধারণভাবে ইসরায়েলকে অথবা ইহুদিদের খারাপ ভাবলে সেটা চরম ভুল হবে। সব দেশের সাধারণ মানুষ একই রকম। তারা তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে শান্তি-সমৃদ্ধিতে থাকতে চায়। কোনো দিন শান্তি ফিরে এলে সমাজের শক্তিগুলো অঞ্চলের জন্য আশীর্বাদ হতে পারে। ভবিষ্যতে এসবের একটি সম্মিলিত প্রভাব দেখার অপেক্ষায় থাকলাম।
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘর্ষকে সব সময়ই ধর্মীয় সংঘাত হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। এটিকে শুধু ইহুদি-মুসলিম দাঙ্গা হিসেবে চিহ্নিত করার ফলে সংঘাতের মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু এই সংঘাতকে যদি ধর্মীয় আবরণমুক্ত করে মানবতার চরম বিপর্যয় বা মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে উপস্থাপন করা যায়, তাহলে ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এর অবস্থান পরিবর্তন হতে পারে।
আমাদের কি কিছু করার আছে? হ্যাঁ আছে। যখন পৃথিবীর বেশির ভাগ মূলধারার গণমাধ্যম চলমান অন্যায়কে না দেখার ভান করছে, তখন নাগরিক গণমাধ্যম, নাগরিক সাংবাদিকদের এই বর্বরতা, নিষ্ঠুরতা এবং অন্যায়কে তুলে ধরতে হবে, সোচ্চার হতে হবে। কারণ, মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের ভাষায়, ‘এক জায়গায় অবিচার সর্বত্র ন্যায়বিচারের জন্য হুমকিস্বরূপ।’
পরিশেষে, চলমান সংঘাত যদি নেতানিয়াহুর দুর্নীতি ইস্যু, তাঁর রাজনৈতিক টালমাটাল অবস্থা থেকে বেরিয়ে নিজের অবস্থানকে সুসংহত করার কৌশল হয়, তাহলে মন্দের ভালো। তবে যদি এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়েই ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্স লেবাননে ২০০৬ সালে হিজবুল্লাহদের কাছে অপদস্থ হয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে যে গৌরব হারিয়েছিল, তা পুনরুদ্ধার করার জন্য যদি গাজাতে হামাস নির্মূল অভিযানে নামে, তবে ফিলিস্তিনিদের জন্য অবর্ণনীয় দুর্দশা অপেক্ষা করছে।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. মাহফুজুর রহমান (এলপিআর)