আর ২১ দিন বেঁচে থাকলে ৯৫ বছর বয়সে পদার্পণ করতেন। বিধাতা তাঁকে সে সময়টুকু দেননি। গত ২০ আগস্ট দুনিয়া থেকে চিরবিদায় নিলেন ইসরায়েলি শান্তিবাদী সংগ্রামী ও সাংবাদিক ইউরি অ্যাভনেরি। সেই সঙ্গে ফিলিস্তিনিরা হারাল তাদের মুক্তিসংগ্রামের একনিষ্ঠ ও বলিষ্ঠ এক সমর্থককে। শুধু ফিলিস্তিনিরাই নয়, শান্তিবাদী ইসরায়েলিরাও হারাল তাদের এক শক্তিমান প্রাণপুরুষকে। জায়নবাদী ইসরায়েলি রাষ্ট্র স্থাপনের এক সৈনিক হিসেবে যুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিলেন অ্যাভনেরি। অথচ সেই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে ক্রমাগত এর সমালোচনায় মুখর হন। তাঁর সমালোচনা ছিল রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে, বিশেষত আরবদের বঞ্চিত-নিপীড়িত করার ও ফিলিস্তিনিদের ভূখণ্ড ক্রমান্বয়ে দখল করে তা (পশ্চিম তীর ও গাজা) বছরের পর বছর অবরুদ্ধ করার বিরুদ্ধে। ইসরায়েলি পার্লামেন্টের সদস্য হিসেবে এবং পরে সাংবাদিকতা ও নিরন্তর লেখালেখির মধ্য দিয়ে আমৃত্যু তিনি এই প্রতিবাদ চালিয়ে গিয়েছেন। ফলে ইউরি অ্যাভনেরি জায়নবাদী ইসরায়েলি ও জাতীয়তাবাদী ইহুদিদের চোখের বিষ হয়ে উঠেছিলেন।
মাত্র ১৪ বছর বয়সে সন্ত্রাসবাদী ইহুদি সংগঠন ইরগুনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। সেটা ছিল ১৯৩৮ সাল, যখন ফিলিস্তিন ছিল কার্যত ব্রিটিশ শাসনাধীন। একে বলা হতো ম্যানডেটেড প্যালেস্টাইন। ১৯৩৩ সালে ফিলিস্তিনে অভিবাসী হওয়া জার্মান এক ইহুদি পরিবারের সন্তান তিনি। নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নকে কৈশোর থেকে লালন করলেও সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের প্রতি পুরোপুরি সমর্থন দিতে পারেননি। তাই ১৯৪২ সালে ইরগুন ত্যাগ করেন। এর কয়েক বছর পর থেকে লেখালেখির শুরু। ১৯৪৮ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে তিনি অংশ নেন নবঘোষিত ইসরায়েল রাষ্ট্রকে রক্ষার দায়িত্ব হিসেবে। তিনি ছিলেন একজন স্কোয়াড কমান্ডার। সৈনিক হিসেবে সংবাদপত্রে লেখালিখি নিষিদ্ধ থাকলেও অ্যাভনেরি তা উপেক্ষা করে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ইসরায়েলের সবচেয়ে পুরোনো পত্রিকা হারেৎসে নিয়মিত লিখতে থাকেন। পরে সেগুলো বই আকারে বের হয়। যুদ্ধ চলাকালে দুবার আহত হন।
এ সময়ই অ্যাভনেরি ফিলিস্তিনি জনগণ বা জনসমাজ সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে ও বুঝতে পারেন। তাঁর মাঝে এ উপলবিদ্ধও আসে যে ইহুদি ও আরবদের মিলেমিশে থাকাই উত্তম। তাঁর কাছে গোটা মধ্যপ্রাচ্য ‘সেমিটিক অঞ্চল’ হিসেবেই অধিকতর গ্রহণযোগ্য ছিল। কেননা, এই অঞ্চলের ইহুদি, খ্রিষ্টান ও মুসলমান সবাই সেমিটিকভাষী। উল্লেখ, সেমিটিক বলতে মোটা দাগে আরবি, আমহারিক, হিব্রুসহ আরও কয়েকটি ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীকে বোঝান হয়। অ্যাভনেরি সে সময়ই ‘এক দেশ, দুই রাষ্ট্র—ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন, জেরুজালেম যৌথ রাজধানী, উন্মুক্ত সীমান্ত, যৌথ অর্থনীতি’—এই ধারণা প্রচার শুরু করেন। ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর জায়নবাদের সমাপ্তি ঘটেছে, তিনি এটা মনে করতেন। তাই আমৃত্যু তিনি জায়নবাদের বিরোধিতা করে গেছেন, ইসরায়েলকে ইহুদি রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নিতে পারেননি। এটা ঠিক, ফিলিস্তিনের ভূমিতে বলপূর্বক ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের গোড়াপত্তনকে তিনি সমর্থন করেছেন এবং নিজেদের রাষ্ট্র মনে করেছেন। তবে এই রাষ্ট্রে অ-ইহুদি, বিশেষত আরবদেরও সমঅধিকার রয়েছে বলে তিনি মনে করতেন।
১৯৬৭ সালে আরবদের সঙ্গে যুদ্ধের পর পূর্ব জেরুজালেম, পশ্চিম তীর ও গাজা দখল করে নেওয়ার বিরুদ্ধে অ্যাভনেরি অবস্থান নিয়েছিলেন এবং ১৯৬৭-পূর্ব সীমান্তরেখা মেনে চলতে ইসরায়েল সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছিলেন। জাতিসংঘের বাঁটোয়ারা করে দেওয়া ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের মধ্যে ইসরায়েলের সীমান্তের চেয়ে কিছু বেশি এলাকা নিয়েছে কথিত সবুজরেখার সীমা। এ বিষয়ে তাঁর অবস্থানটা ছিল এ রকম যে ইসরায়েল যুদ্ধের মাধ্যমে এই বাড়তি ভূমি পেয়েছে আর আরবরা তা অস্ত্রবিরতির মাধ্যমে মেনে নিয়েছে। তাই এটাই ইসরায়েলের সীমান্ত। কিন্তু ১৯৬৭ সালে ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরায়েল আরও যেসব ভূখণ্ড দখল করে ধরে রেখেছে, সেগুলো কোনোভাবেই ইসরায়েলের নয়। এগুলো ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের, যা আজও মাথা তুলতে পারেনি ইসরায়েলি অবৈধ দখলদারি ও আগ্রাসনের কারণে। তিনি অধিকৃত ভূখণ্ডে ইহুদি বসতি স্থাপনের তীব্র বিরোধিতা করেছেন বরাবর।
ইউরি অ্যাভনেরিকে ইসরায়েলি সাংবাদিকতার অন্যতম পুরোধা বলা হয়। তিনি ও তাঁর তিন বন্ধু হ্রিব্রু ভাষার হাওলেম হাজেহ ম্যাগাজিন কিনে নেন এবং সেটিকে ট্যাবলয়েডে রূপান্তর করেন। এতে একদিকে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন, বিশেষত ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর অনিয়ম ও অত্যাচার-নির্যাতনের খবর থাকত। এই পত্রিকায় অ্যাভনেরি ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ও স্বতন্ত্র দেশের পক্ষে কথা বলেছেন। এ জন্য বিভিন্ন সময় তিনি হুমকির মুখে পড়েছেন, অপদস্থ হয়েছেন। একবার ইসরায়েলি সেনাসদস্যরা তাঁকে প্রহারও করে। ১৯৬৫ সালে এই পত্রিকার নামেই তিনি একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। এই দল থেকে নির্বাচন করে তিনি নেসেটের (ইসরায়েলি জাতীয় সংসদ) সদস্য হন। ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত প্রথম দফায় এবং দ্বিতীয় দফায় ১৯৭৭ থেকে আরও চার বছর নেসেটের সদস্য ছিলেন। এভাবে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে যোগ দিয়ে তিনি ১৯৭৫ সালে তিনি ‘ইসরায়েল-ফিলিস্তিন শান্তির জন্য ইসরায়েলি কাউন্সিল’ গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। এ জন্য মারধর ও লাঞ্ছনার শিকার হন, এমনকি ছুরিকাহত হন।
তবে ১৯৮২ সালের ৩ জুলাই লেবাননের রাজধানী বৈরুতে ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থার (পিএলও) প্রধান ইয়াসির আরাফাতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে অ্যাভনেরি নিজ দেশে ও ইহুদিদের কাছে চরমভাবে নিন্দা ও ঘৃণার পাত্র হয়ে ওঠেন। জায়নবাদীরা আরাফাতকে একজন সন্ত্রাসী ও খুনি হিসেবেই চিহ্নিত করেছিল। অ্যাভনেরিই প্রথম কোনো ইসরায়েলি, যিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইয়াসির আরাফাতের সঙ্গে দেখা করেছিলেন এবং তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। পিএলওকে নির্মূল করার জন্য ইসরায়েল ১৯৮২ সালে লেবাননে অভিযান চালায়। অ্যারিয়েল শ্যারন তখন ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর প্রধান। তাঁর নির্দেশে আরাফাতকে হত্যা করার জন্য ইসরায়েলি গুপ্তচরদের একটি দল তখন বৈরুতে ছক কষছিল। তারা অ্যাভনেরিকে অনুসরণ করে আরাফাতের গোপন আস্তানায় পৌঁছানোর পাঁয়তারা করে। প্রয়োজনে আরাফাতের সঙ্গে অ্যাভনেরিকে মেরে ফেলা হবে, এমনটাও ভাবা হয়েছিল। তবে পিএলওর যে দলটি অ্যাভনেরিকে নিয়ে গিয়েছিল, তারা টের পেয়ে সুকৌশলে ইসরায়েলি গুপ্তচরদের ভুল রাস্তায় পাঠিয়ে দেয়। তাই অপারেশন ‘সলট ফিশ’ আর কার্যকর হয়নি।
অ্যাভনেরি এরপর থেকে নিয়মিত আরাফাতের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেছেন। কিন্তু ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী অ্যারিয়েল শ্যারন আরাফাতকে হত্যা করার জন্য মরিয়া ছিলেন। ১৯৮২ সালে লেবানন অভিযানে আরাফাতকে হত্যা করতে না পারার ব্যর্থতা তাঁকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। তাই ২০০১ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর শ্যারন সেই ব্যর্থতা মোচনের উদ্যোগ নেন। তবে আন্তর্জাতিকভাবে আরাফাতের অবস্থান, স্বীকৃতি ও গ্রহণযোগ্যতা বিবেচনায় সরাসরি হত্যাকাণ্ড না ঘটিয়ে প্রচণ্ড মানসিক চাপ প্রয়োগসহ ভিন্ন কৌশল নেয় ইসরায়েল। পশ্চিম তীরে রামাল্লায় আরাফাতের কার্যালয়ে দফায় দফায় সেনা অভিযান চালিয়ে তাঁকে অবরুদ্ধ করে রাখা ও সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। তখন দ্বিতীয় ইন্তিফাদা চলছে। এ রকম সময়ে একাধিকবার ইউরি অ্যাভনেরি ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত গুশ শালেমের শান্তিবাদী কর্মীরা মানবঢাল হিসেবে আরাফাতের কার্যালয়ে অবস্থান নেন শ্যারনের হাত থেকে তাঁর প্রাণ রক্ষার জন্য। এদিকে আরাফাত শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে একপর্যায়ে ২০০৪ সালের অক্টোবরে উন্নত চিকিৎসার জন্য প্যারিসে নেওয়া হয়। সেখানেই ১১ নভেম্বর তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়। আরাফাতের মৃত্যু নিয়ে নানা মত ও বিতর্ক আছে। তবে অ্যাভনেরি সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে তাঁকে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করা হয়েছে। কাজটা ইসরায়েলি চরেরাই করেছে। শুধু পিএলও বা ফাতাহ নয়, গাজার শাসকগোষ্ঠী হামাসের সঙ্গে সংলাপের পক্ষেও অবস্থান নিয়েছেন অ্যাভনেরি। অধিকৃত গাজায় একাধিকবার সফর করেছেন, গাজাবাসী ও হামাসের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছেন।
আসলে অ্যাভনেরির জীবন ও কর্ম ফিলিস্তিন-ইসরায়েল ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। তাঁর জীবনরেখা জানা মানে এই ইতিহাস জানা ও বোঝা। তাঁর লেখাগুলো ফিলিস্তিন-ইসরায়েলের সাত দশকের বেশি সময়ের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের এক জীবন্ত ছবি। ইতিহাসের অনেক অপ্রিয় ঘটনা, যা জায়নবাদীরা লুকাতে ও মুছে ফেলতে চেয়েছে, তা তিনি লিখে রেখে গেছেন ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য। যদিও তিনি সব সময় একই পুরোপুরি একই পথ ও মতে থাকেননি, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন এসেছে। তবে মধ্যপ্রাচ্য যেন শান্তিময়, ফিলিস্তিনিরা যেন স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র পায় আর ইসরায়েল যেন একটি দায়িত্বশীল রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকে। মৃত্যুর আগে তাঁর শেষ লেখাটি ছিল ইহুদি জাতিরাষ্ট্র হিসেবে সাংবিধানিকভাবে ইসরায়েলের স্বীকৃতির বিরোধিতা। ইসরায়েল রাষ্ট্র ১৯৪৮ সালে ১৪ মে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল স্বাধীনতার ঘোষণার ওপর, যেখানে একটি ‘ইহুদি ও গণতান্ত্রিক’ রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয়েছিল। তখন কোনো সংবিধান প্রণয়ন করা সম্ভব ছিল না, আর আজও কোনো লিখিত সংবিধান নেই ইসরায়েলের। সংবিধানের বদলে স্বাধীনতার ঘোষণার আলোকে কিছু মৌলিক আইন দিয়ে পরিচালিত হয় দেশটি। এ বছর জুলাই মাসের শেষ দিকে ‘জাতিরাষ্ট্র’ শিরোনামে আরেকটি মৌলিক আইন অনুমোদনের মধ্য দিয়ে ইসরায়েল শুধু ইহুদি সম্প্রদায়ের জাতিরাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে আইনি স্বীকৃতি পায়। অ্যাভনেরি এর নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে তাঁর গুশ শালেমের ব্লগে লেখেন, ‘আমরা কি এটা উপলব্ধি করি যে এসব আরব, বিশেষত ফিলিস্তিনির সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা আমাদের প্রজন্মের প্রধান কাজ?’
মৃত্যুর সপ্তাহখানেক আগে জীবনের শেষ লেখায় এটাই ছিল অ্যাভনেরির শেষ প্রতিবাদ।
আসজাদুল কিবরিয়া: সাংবাদিক
asjadulk@gmail. com