উন্নত বিশ্বের মানুষ যখন চাঁদে ও মঙ্গল গ্রহে আবাস গড়ার স্বপ্ন দেখছে, তখন আমাদের রাজনীতিকেরা মধ্যযুগীয় ধ্যান-ধারণায় আচ্ছন্ন হয়ে আছেন। তাঁরা মুখে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া কিংবা নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি চালুর কথা বললেও মনে তীব্র হিংসা ও ঘৃণা পুষে রাখছেন। এক পক্ষ অন্য পক্ষকে খতম করে বিজয় অর্জন করতে চাইছে। কিন্তু যাঁদের নিয়ে নেতারা রাজনীতি করেন, সেই সাধারণ মানুষের সুবিধা-অসুবিধা এবং দুঃখ-কষ্টের কথা ভাবেন না।
২৪-২৫ অক্টোবরকে সামনে রেখে সাধারণ মানুষ গভীর উদ্বেগে আছেন। বিশেষ করে বছর শেষে ছেলেমেয়েদের পরীক্ষা নিয়ে অভিভাবকদের উত্কণ্ঠার শেষ নেই। ২৫ অক্টোবরের পর যদি দুই পক্ষই রাস্তায় থাকে, সংঘাত-সংঘর্ষ অনিবার্য। সেই পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতির চাকা বন্ধ হয়ে যাবে। জনগণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা নিশ্চল হয়ে পড়বে। বাবা-মা তাঁদের সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে সাহস পাবেন না।
কিন্তু এসব নিয়ে জনদরদি রাজনীতিকদের মধ্যে কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। তাঁরা ক্ষমতায় থাকার জন্য এবং ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য একে অপরের বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে নেমেছেন। ‘কেহ নাহি কারে ছাড়ে সূচ্যগ্র মেদিনী।’
সোমবার মহানগর বিএনপির যৌথসভায় দলের ভাইস চেয়ারম্যান ও ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা ২৫ অক্টোবরের সমাবেশে সর্বোচ্চ জনসমাগম নিশ্চিত করার পাশাপাশি ‘আক্রমণ প্রতিহত করতে প্রয়োজনে’ দা-কুড়াল নিয়ে প্রস্তুত থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি নেতাদের উদ্দেশে বলেন, ‘দুটি বিষয়ে প্রস্তুতি নিতে হবে। সভা সফল করা এবং আক্রমণের শিকার হলে প্রয়োজনে দা-কুড়াল যা যা আছে, সব নিয়ে প্রস্তুত থাকা। আমরা আগে আক্রমণ করব না।’
সাদেক হোসেন খোকা সমাবেশ সফল করতে দলীয় নেতা-কর্মীদের আহ্বান জানাতেই পারেন। তাই বলে দা-কুড়াল নিয়ে তাঁদের মাঠে আসতে বলবেন!
কোরবানির পশু জবাই করতে কিংবা বনের কাঠ কাটতে দা-কুড়াল লাগলেও রাজনীতিতে এর প্রয়োজন দেখি না। যেমন প্রয়োজন দেখি না লগি-বৈঠারও। সাদেক হোসেন খোকা তাঁর বক্তৃতায় ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরের লগি-বৈঠার আন্দোলনের প্রসঙ্গটিও টেনে এনেছেন।
আওয়ামী লীগের লগি-বৈঠার জবাবে বিএনপির নেতা দা-কুড়াল নিয়ে আসতে বলেছেন। বলা যায় একধাপ অগ্রগতি। মানুষ যখন আগুন জ্বালাতে জানত না, তখনই লগি-বৈঠার চল ছিল। তার পর অগ্নি যুগে দা-কুড়াল বানাতে শিখল। বনের পশুর হাত থেকে রক্ষার জন্য তারা দা-কুড়াল ব্যবহার করত। কিন্তু এখন খোকা সাহেবরা কার বিরুদ্ধে দা-কুড়াল ব্যবহার করতে চাইছেন? তিনি বলেছেন, ‘আমরা প্রথমে আক্রমণ করব না। কিন্তু আওয়ামী লীগ যদি আক্রমণ করে, আমরা তাদের ছেড়ে দেব না।’
এই আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ দেশকে কোথায় নিয়ে যাবে?
সাদেক হোসেন খোকা একজন মুক্তিযোদ্ধা। প্রায় নয় বছর ঢাকার মেয়র ছিলেন। চার-চারবার সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন। এমনকি একবার আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকেও পরাজিত করেছিলেন। একবার রাজাকারদের সমালোচনা করতে গিয়ে তিনি সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর আক্রমণেরও শিকার হয়েছিলেন। সাকা বলেছিলেন, ‘এত দিন শুনেছি কুকুরে লেজ নাড়ায়, এখন দেখছি লেজই কুকুরকে নাড়াচ্ছে।’
সেই মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকার মুখে দা-কুড়ালের রণহুংকার! এর আগে জুলাইয়ে হেফাজতকে তোষণ করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, লগি-বৈঠার চেয়েও কঠিন আন্দোলন করা হবে। তাহলে কি খোকা সাহেব লগি-বৈঠার সেই সহিংস ঘটনাকে আন্দোলন বলে স্বীকার করছেন? হেফাজতের দাবি পূরণ করে হাসিমুখে ফেরত পাঠানোর কথাও বলেছিলেন তিনি।
তবে সাদেক হোসেন খোকার এই ‘সহিংস’ বাক্যবাণের জন্য সরকারি দলও কম দায়ী নয়। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা প্রায় প্রতিদিন বিএনপিকে দেশছাড়া, ঘরছাড়া করার হুমকি দিয়ে চলেছেন। আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম সম্প্রতি দলীয় সভায় বলেছেন, ২৫ অক্টোবরের পর বিএনপি নেতাদের খুঁজেও পাওয়া যাবে না। এর আগে তিনি মন্তব্য করেছিলেন, বাটি চালান দিয়েও বিএনপিকে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
আওয়ামী লীগের নেতারা যখন নিজেদের জনপ্রিয়তার ব্যাপারে এতই আস্থাবান, তখন তাঁরা কেন একতরফা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কেন বলছেন, কে নির্বাচনে এল, না এল তা নিয়ে তাঁরা ভাবছেন না। নির্বাচনের ব্যাপারে বিএনপি যতই নমনীয় মনোভাব দেখাচ্ছে, আওয়ামী লীগ ততই কঠোর অবস্থান নিচ্ছে। তাদের ধারণা, বিএনপি কিছুই করতে পারবে না। যুক্তির খাতিরে যদি ধরে নিলাম বিএনপি কিছুই করতে পারল না। তারা রাজপথের যুদ্ধে পরাজিত হলো। গণভবন, বঙ্গভবন ও জাতীয় সংসদের পর রাজপথও আওয়ামী লীগের দখলে চলে গেল। তাহলেও কী গণতন্ত্র বাঁচবে? বাঁচবে না। দেশে শান্তি আসবে? আসবে না। অতএব, এই লগি-বৈঠার পথ পরিহার করুন। দা-কুড়ালের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন। দেশের ১৬ কোটি মানুষের কথা ভাবুন।
সোহরাব হাসান
কবি, সাহিত্যিক