আসামের নয়নমণি ও সবিতা চেটিয়া কোথায়

ভারতের উত্তর–পূর্ব প্রদেশ আসামের রাজধানী গুয়াহাটি থেকে ৬০০ কিলোমিটার দূরে একটি প্রশিক্ষণ শিবিরে সশস্ত্র উলফা সদস্যরা
ফাইল ছবি: এএফপি

আসামে অতীতে নিষিদ্ধ সংগঠন ‘ উলফার’র প্রায় সব সংবাদে বাংলাদেশকে জড়ানোর চেষ্টা হতো। সেই ‘ঐতিহ্যে’ বড় বিরতি চলছে বহুদিন। এর মাঝে উলফাও পুরোনো সাংগঠনিক ভিত্তি হারিয়ে ফেলেছে বলে ধরা হয়। কিন্তু সম্প্রতি কয়েকজন তারকা নারী বক্সারের আলফায় যোগ দেওয়ার খবরে আসামজুড়ে আলোড়ন উঠেছে। ব্যতিক্রমী ঘটনা হিসেবে এটা নজর কেড়েছে পুরো উত্তর-পূর্বাঞ্চলে।

নারী বক্সাররা যখন ক্যারিয়ার ছেড়ে জঙ্গলমুখী

আসামে বক্সিং ও কিকবক্সিং—উভয়ই খেলা হিসেবে জনপ্রিয়। ছোট্ট রাজ্য হলেও আসাম অনেক নামকরা বক্সারের জন্ম দিয়েছে। নয়নমণি ও সবিতা চেটিয়া সেই তালিকায় নবীন সংযোজন। দুজনই আলোচিত কিকবক্সার। নয়নমণি আসামে কিকবক্সিংয়ের সুপরিচিত প্রশিক্ষকও। এই দুজনসহ অসমিয়া পাঁচ তরুণী গভীর জঙ্গল থেকে নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই মর্মে ভিডিও ছেড়েছেন, তাঁরা উলফা শিবিরে যোগ দিতে যাচ্ছেন।

নয়নমণির বাড়ি আপার আসামের সর্বোত্তর-পূর্ব জেলা তিনসুকিয়ায়। এটা অরুণাচল ও চীন-মিয়ানমারসংলগ্ন। নয়নমণির সঙ্গে পালিয়েছেন সবিতা চেটিয়া। তাঁর বাড়ি তিনসুকিয়ার পাশের দেমাজি। ভিডিওতে তৃতীয় আরেকজনকে শনাক্ত করা হয়েছে শর্মিষ্ঠা সাকিয়া হিসেবে। যাঁর বাড়ি দেমাজির পাশের লখিমপুর। বাকি দুজন মাজুলি ও মরিগাঁওয়ের বলে ধারণা করা হচ্ছে। এসবই অসমিয়াপ্রধান জেলা। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, এক যুবকসহ কিকবক্সাররা গভীর জঙ্গল আর ছোট ছোট পাহাড়ি নদীর ধারা পার হয়ে অজানার পথে এগোচ্ছেন। নারী বক্সারদের উলফায় যোগ দেওয়ার এ রকম ঘটনা কয়েক বছর আগেও একবার ঘটে।

আসামের সশস্ত্র ঘটনার সংবাদে এখন আর বাংলাদেশ থাকছে না

উলফা বিবৃতি দিয়ে নয়নমণি ও সবিতার ব্যাপারে কিছু বলেনি এখনো। ঘরছাড়া তরুণীরাও স্পষ্ট করে বলেননি, তাঁরা আলফার ঘাঁটিতে পৌঁছে গেছেন কি না। তাঁদের শেষ অবস্থানের নিশ্চিত সংবাদ পেতে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে সবাইকে। তারপরও এ ঘটনা উলফাকে ভালোভাবেই আলোচনায় আনল। রাজ্যের তারুণ্যকে যে তাঁরা এখনো আকর্ষণ করতে পারেন, সেই বার্তা আছে এতে। যদিও বহু–বহুদিন আলফার সংগঠন ও তৎপরতায় ভাটার টান চলছে। আসামের তরুণ-তরুণীদের মন থেকে যে বিচ্ছিন্নতার বোধ একেবারে ধুয়েমুছে দেওয়া যায়নি, সে লক্ষণ মেলে তারকাজীবন ছেড়ে তরুণীদের এভাবে জঙ্গলমুখী হওয়ার ঘটনায়।

নয়নমণির স্বামী আসামে পুলিশের চাকরি করেন। তাঁদের চার-পাঁচ বছর বয়সী সন্তানও আছে। অথচ রাজনৈতিক ও জাতিগত আবেগ তাঁকেও ঘরছাড়া করেছে। অক্টোবরের শেষ দিকে তিনসুকিয়া থেকে নারী বক্সারদের মতোই নিখোঁজ হয়েছেন অপর তিন তরুণ। এসব নিখোঁজ সংবাদের তাৎপর্য আসামের রাজনীতিসচেতন ব্যক্তিদের জানা। তবে এ রকম সংবাদে এখন আর কোনোভাবে বাংলাদেশ থাকে না।

একই দিনে মনিপুরে বড় হানা

আসাম থেকে তরুণ-তরুণীদের নিখোঁজের নবতরঙ্গের মধ্যেই মনিপুরে সম্প্রতি সপরিবার খুন হলেন ৪৬ আসাম রাইফেলসের এক কমান্ডিং কর্নেল। সঙ্গে আরও চার সৈনিক। আসাম ও মিজোরামসংলগ্ন চুরাচান্দপুরে এ আক্রমণ হয়েছিল। যেদিন নয়নমণি ও সবিতা চেটিয়াদের ভিডিও ভাইরাল হয়, সেদিনই কর্নেল বিপ্লব ত্রিপাঠিকে হত্যার ঘটনা ঘটে। আপাতদৃষ্টে দুই ঘটনার কোনো সম্পর্ক নেই। মনিপুরের অ্যামবুশ নাগাদের সহায়তায় পিএলএ নামে পরিচিত স্থানীয় মৈতি গেরিলাদের কাজ বলছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম। কিন্তু রাজ্যগত ফারাক সত্ত্বেও এ ঘটনায় আলফার সহযোগিতা আছে বলে মনে করা হয়। সঙ্গে এ–ও মনে হচ্ছে, উত্তর-পূর্ব ভারতের গেরিলারা এখনো পরিকল্পিত অপারেশনের সামর্থ্য রাখে। ওই এলাকায় কেন্দ্রীয় বিভিন্ন বাহিনীর ব্যাপক উপস্থিতির মধ্যে এ রকম খুনোখুনি হতে পারল, যা এসব রাজ্যের নিরাপত্তা পরিস্থিতির পুরোনো দুর্বলতা সামনে আনল আবার। একই সঙ্গে স্থানীয় জাতিগুলোর দাবিদাওয়ার রাজনৈতিক নিষ্পত্তির জরুরি প্রয়োজনীয়তার কথাও জানাল নতুন করে। ভারতের দিক থেকে এটা বিশেষভাবে জরুরি হয়ে উঠেছে চীনের সঙ্গে সম্পর্কের ক্রমাবনতির কারণেও।

উলফায় যোগ দিতে যাচ্ছেন বলে ঘোষণা দিয়ে খবর হয়েছেন ভারতের জাতীয় পর্যায়ের দুই কিকবক্সার নয়নমণি ও সবিতা চেটিয়া

চীনের সঙ্গে আবারও উত্তেজনা অরুণাচলে

আসাম ও অরুণাচল চীন–লাগোয়া। অরুণাচলকে চীন তার বলেও দাবি করে। অরুণাচল নিয়ে চীনের সঙ্গে পুরোনো এই কাজিয়া হঠাৎ নতুন জ্বালানি পেয়েছে স্যাটেলাইট এক ছবির মাধ্যমে। যেখানে দেখা যাচ্ছে, অরুণাচলের ভেতরে চীন রীতিমতো অনেক বাড়িঘরের এক ‘গুচ্ছগ্রাম’ বানিয়েছে। ভারত সরকারের ভাষ্য, চীনের এই ‘গ্রাম’ ‘লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল’-এর বাইরে। কিন্তু ভারতের জাতীয় কাগজগুলো স্যাটেলাইট যেসব ইমেজ ছাপছে, তাতে মিলছে ভিন্ন তথ্য। এনডিটিভি বলছে, চীনের গ্রামটি ভারতের দাবি করা সীমানার ছয় মাইল ভেতরে। এর আগে ২০১৯ সালেও শুভনশ্রী জেলায় চীনের গড়া আরেকটি গ্রামের অস্তিত্ব মিলেছিল। তখনো উভয় দেশ সীমানা নিয়ে তর্কবিতর্ক করেছে।

এ রকম বিতর্কের মীমাংসা তাৎক্ষণিকভাবে সহজ নয়। ভারত-চীনের মধ্যে প্রায় ৩ হাজার ৫০০ কিলোমিটার বিবাদিত সীমান্ত আছে। যেহেতু এ রকম নাজুক সীমানা নিয়ে দুই দেশে সামরিক টানাপোড়েন চলছে এবং চীনের সহানুভূতি থেকে উত্তর-পূর্ব ভারতের গেরিলাদের দূরে রাখা ‘জাতীয় স্বার্থে’ই দরকার, সে কারণে স্থানীয় সশস্ত্র ভিন্নমতাবলম্বীদের সঙ্গে নয়াদিল্লির বোঝাপড়ার তাগিদ দিচ্ছেন বহুকাল বহু সামরিক পণ্ডিত। সে রকম আলোচনা চলছেও বিভিন্ন রাজ্যের বিভিন্ন গেরিলা সংগঠনের সঙ্গে।

ভারত, উলফা কিংবা অন্যান্য শক্তি কীভাবে আসাম, মনিপুর ইত্যাদি এলাকার সার্বভৌমত্বের ফয়সালা করবে; সেটা একান্ত তাদের বিষয়। ঢাকার জন্য আপাতত এটা ভালো লক্ষণ, বাংলাদেশকে এখন আর এসবে জড়ানো হয় না। ভারতের নীতিনির্ধারক এবং সে দেশের প্রচারমাধ্যমের এই শুভবোধ বাংলাদেশের জন্য বিশেষ স্বস্তির।

চলছে ‘যুদ্ধবিরতি’ও

নারী কিকবক্সারদের আলফামুখী হওয়ার ভিডিও এমন সময় আসামে ‘হিট’ করল, যখন এই গেরিলা দলের সঙ্গে ভারত সরকারের আরেক দফা আলোচনার তোড়জোড় চলছে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিমান্ত বিশ্বশর্মা এ আলোচনায় মধ্যস্থতা করছেন। উলফা তাঁর মধ্যস্থতা মানছে। তবে তারা চাইছে, আলোচনায় আসামের সার্বভৌমত্বের বিষয় যুক্ত হোক। কেন্দ্রীয় সরকারের তাতে সায় নেই। এ দূরত্বের কারণে আলোচনার উদ্যোগ তেমন বেগ পাচ্ছে না। এর মধ্যেই নয়নমণিদের ভিডিও উলফার দিক থেকে এক ‘হিসেবি চাল’ হয়েছে বলে স্থানীয় সাংবাদিকদের ধারণা। অজ্ঞাত আশ্রয় থেকে পরেশ বড়ুয়া তাঁর সামাজিক শক্তির জায়গাটা দেখালেন হয়তো এর মাধ্যমে। তিনি এ সংগঠনের একাংশের ‘চেয়ারম্যান’ এখন। অপর অংশ সশস্ত্র আন্দোলন ছেড়ে প্রকাশ্যে আছে। বড়ুয়া আছেন ভারতীয় পত্রপত্রিকার অনুমানে মিয়ানমারের কোথাও। ভারত সরকারের এমনও দাবি আছে, তিনি চীনের আশ্রয়ে সেখানকার ইউনান প্রদেশে থাকেন।

পরেশ বড়ুয়া যেখানেই থাকুন, তাঁদের তরফ থেকে ভারত সরকারের সঙ্গে ‘যুদ্ধবিরতি’ কাজ করছে এ মুহূর্তে। উলফা তিন মাস পরপর অস্ত্র সংবরণের ঘোষণা দেয়। সর্বশেষ ঘোষণার মেয়াদ আছে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এ যুদ্ধবিরতির মধ্যে ভারতের ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি ‘রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে’র জন্য পরেশ বড়ুয়ার নামে চার্জশিট দাখিল করেছে। উলফা তারই উত্তর দিয়েছে হয়তো বক্সারদের দলে টেনে। উলফার সঙ্গে আলোচনায় অচলাবস্থা এবং নারী বক্সারদের জঙ্গলমুখী হওয়া একই সমস্যারই দুটি দিক। এ অঞ্চলে পূর্বের দশকগুলো থেকে এ দশকে পারস্পরিক সংঘর্ষ কমে এলেও বিচ্ছিন্নতার আন্দোলনগুলোর চূড়ান্ত মীমাংসা যে ঝুলে আছে, তার ইঙ্গিত এসব টুকরো খবরাখবর।

তবে ভারত, উলফা কিংবা অন্যান্য শক্তি কীভাবে আসাম, মনিপুর ইত্যাদি এলাকার সার্বভৌমত্বের ফয়সালা করবে; সেটা একান্ত তাদের বিষয়। ঢাকার জন্য আপাতত এটা ভালো লক্ষণ, বাংলাদেশকে এখন আর এসবে জড়ানো হয় না। ভারতের নীতিনির্ধারক এবং সে দেশের প্রচারমাধ্যমের এই শুভবোধ বাংলাদেশের জন্য বিশেষ স্বস্তির।

সীমান্ত জঙ্গলাকীর্ণ থাকায় এবং পুরোপুরি সুরক্ষিত করতে না পারায় অতীতে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী সশস্ত্র কর্মীরা এক দেশ থেকে আরেক দেশে ঢুকে পড়ত। এ রকম ঘটনার জন্য বছরের পর বছর ভারতের প্রচারমাধ্যমে বাংলাদেশবিরোধী প্রচার চলেছে অতীতে। বাস্তব তথ্য-প্রমাণের অভাবে এখন সেটা বন্ধ হলেও আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরার বাংলাভাষীদের ‘বাংলাদেশি’ প্রমাণের যে রেওয়াজ আছে; সেটাও বন্ধ হওয়া জরুরি। নয়নমণি ও সবিতা চেটিয়াদের আবেগ, ঝুঁকি ও সংগ্রাম যে একান্ত বাংলাদেশমুক্ত ঘটনাবলি; এ উপলব্ধি ঢাকা-নয়াদিল্লি-গুয়াহাটির সম্পর্ককে আরও স্বচ্ছন্দ হতে সাহায্য করবে।

আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ের গবেষক