সকালবেলায়ই মেজাজটি তিরিক্ষে হয়ে গেল। উৎসটি হলো প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠার একটি খবরের বিন্যাস; অথবা পরিবেশনে অসামঞ্জস্য কিংবা শিরোনামে অসংগতি। বারান্দায় বসে সদ্য হকারের দেওয়া প্রথম আলো পড়ছিলাম। সামনে ধূমায়িত গরম চায়ের কাপ। প্রাতঃপান তথা মর্নিং টিতে চুমুক দেব আর পত্রিকার পাতায় চোখ বুলিয়ে নেব—এ আমার প্রায় অর্ধশতাব্দীর বেশি সময়ের অভ্যাস। সেই পাকিস্তান অবজারভার আমলে যখন বার্তা সম্পাদক (অনেকে পদবিটির আগে দুঁদে কথাটি যোগ করতেন), তখন থেকেই পত্রিকার পাতায় উকুন খোঁজার অভ্যাস। তখন পদাধিকারবলে কাজটি যথাযথ মনে হলেও এখন প্রথম আলো, যার কোনো পদেই আমি অধিষ্ঠিত নই, সেখানে কোনো কর্তৃত্ব প্রয়োগ করা শুধু বেমানান নয়, অবাঞ্ছিতও বটে। তবু কেন জানি প্রথম আলোতে সংবাদ পরিবেশন অথবা মন্তব্য প্রতিবেদন কিংবা সংবাদচিত্রের ব্যবহার অথবা পৃষ্ঠা সাজানোতে বিন্দুমাত্র খুঁত চোখে পড়লেই মেজাজটি তিরিক্ষি হয়ে ওঠে, দিনটিই মনে হয় খারাপ যাবে।
কেন এমনটি হয়? আমার সব ব্যাপার-স্যাপার ও মন-মেজাজের অন্ধিসন্ধি অজানা নয় আমার ৬০ বছরের সহধর্মিণী সেতারা মূসার, যিনি একসময় নিজেও সাংবাদিকতা করেছেন, আমি বাহ্যত প্রকাশ না করলেও মেজাজটি বুঝে ফেলেন। সেদিন আমার উত্তপ্ত মেজাজের আভাস পেয়ে হাতে ধরা প্রথম আলোটি নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে?’ আমি একটি খবর অথবা প্রতিবেদনটির দিকে তর্জনী নির্দেশ করে বললাম, ‘দেখো, দেখো, এটা কি এভাবে দেওয়ার কথা?’ অথবা বলতাম, ‘ইশ্, নিউজ সেন্স দেখেছ? খবরটি নিজেও বোঝেনি, পাঠককেও বোঝাতে পারেনি।’ ফোকলা দাঁতে হেসে তিনি বললেন, ‘তাতে তোমার হয়েছেটা কী।’
গিন্নির কথার উত্তর দেওয়ার আগেই অতি স্নেহভাজন সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম ওরফে মুকুলকে ফোন করে খবরটি উদ্ধৃত করে তার মুণ্ডুপাত শুরু করেছি। ঝাড়ি খেয়ে ওদিক থেকে মুকুল কী বলেছে, তা শোনার অবকাশ ছিল না, শুধু বকেই গেলাম। পরে শুনেছিলাম বিষয়টি নিয়ে পরবর্তী সময়ে সেদিন সকালের সম্পাদকীয় বৈঠকে ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে। যাকগে, একসময় ফোনটি রেখে দিলাম। তার পরই গিন্নির প্রশ্নটি ‘তাতে তোমার কী’ কথাটি নিয়ে ভাবতে লাগলাম। বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রথম আলোর ভালো-মন্দ, সাফল্য-ব্যর্থতা, গুণাবলি বা ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে আমার কেন মেজাজ তিরিক্ষে হয়? পত্রিকাটির কোনো বিশেষ বা অনুসন্ধানী খবর প্রকাশে বা সামাজিক উদ্যোগে মনে খুশির জোয়ার জাগে—এই প্রশ্নটির জবাব পেয়ে গেছি। উত্তরটি হলো, আমি প্রথম আলোকে ভালোবাসি, পত্রিকাটির ভালো-মন্দের সঙ্গে কেন জানি জড়িয়ে গেছি।
একসময় যেখানে সাংবাদিকতার জীবনে বেড়ে উঠেছি, সেই অবজারভার যেমন ২১ বছর আমার রক্তে আর হাড়-মাংসে মিশে গিয়েছিল, তেমনি প্রথম আলো গত ১৫ বছরে অন্তরে জায়গা করে নিয়েছে। তাই তো পত্রিকাটির সামান্য পথচ্যুতি অথবা সাংবাদিকতার নিয়মবাঁধা গণ্ডির বাইরে গেলে আমার মেজাজ গরম হয়, যেমন—৪০ বছর আগে অবজারভার-এর বার্তা সম্পাদকের হতো। কেন জানি তখনকার মানদণ্ডে এখন শতকরা ১০০ ভাগ ত্রুটিহীন সাংবাদিকতা আশা করি প্রথম আলোর কাছে; কি সংবাদ পরিবেশনে অথবা মতামত প্রকাশ অথবা প্রচার-প্রচারণায়।
আমার একটি নিবন্ধ প্রতিবেদন লিখতে তিন দিন লাগে। প্রথম দুই দিন বাড়িতে বসে লিখে, তৃতীয় দিন প্রথম আলোর ষষ্ঠ তলায় কোনো খোপে বসে প্রতিবেদনটির খোলনলচে পাল্টাতে থাকি। প্রথম আলোতে পর পর তিন দিন লেখাটির পুনর্বিন্যাস-প্রক্রিয়ার ফাঁকে সম্পাদকীয় বিভাগের প্রত্যেকের খোঁয়াড়ে ঢুকে লেগ-পুলিং তথা কথার খোঁচাখুঁচি করে আসি। প্রতিবেদনটি লেখালেখির চেয়েও এই খোঁচাখুঁচি আমি অধিকতর উপভোগ করি। বস্তুত ওইটি আমার কোনো লেখার ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণাও বটে। তার মানে আমি পত্রিকাটির নিছক একজন লেখক নই, সম্পাদকীয় বিভাগের প্রত্যেকের সঙ্গে আমার আত্মার যোগসূত্র গড়ে উঠেছে।
প্রথম আলোর বার্তা বিভাগের সঙ্গে আমার সরাসরি যোগাযোগ কিঞ্চিৎ কদাচিৎ ঘটে থাকে। বার্তা পরিবেশকদের অনেককেই চিনি না, এতৎসত্ত্বেও তারা আমাকে চেনে নানা সূত্রে। আমি তাদের জানি প্রতিবেদন পড়ে, সংবাদচিত্র দেখে। এই চেনাচিনিতে অলক্ষ্যে অতীতের একজন বার্তা সম্পাদক উঁকি মারে। অথচ এদের কার্যক্রমেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমার মেজাজ চড়ে যায়, মুকুলকে সকালবেলা টেলিফোন করে ঝাড়ি মারি। এতৎসত্ত্বেও বার্তা বিভাগের তথা বার্তা সম্পাদকের ও সহসম্পাদক, অনুবাদকদের আমার প্রতি যে সম্মানবোধ, অগাধ আস্থা, তার একটি উদাহরণ পেশ করছি।
বছর কয়েক আগের কথা, রাত ১০টার দিকে প্রথম আলোর বার্তা সম্পাদক টেলিফোন করে যা বলল, শুনে আমি তো হতবাক। কোনো একটি চাঞ্চল্যকর খবর শুনিয়ে আমার কাছে জানতে চাইল, ‘এটি কীভাবে পরিবেশন করা যায়, শিরোনাম কী হতে পারে।’ প্রথম পাতায় অবস্থান কোথায় হবে। আমি বললাম, ‘এ তো তোমার সম্পাদকের বলার কথা।’ উত্তর এল, ‘তিনি এখন আমেরিকায়। তিনিও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না, আপনার কাছ থেকে নির্দেশনা পেতে বলেছেন।’ আমি ভাবলাম, ‘একি অবাক কাণ্ড রে বাবা।’ যা-ই হোক, প্রথম আলোর বার্তা সম্পাদককে যথাযথ উপদেশ দিলাম। তার পরেই অনুরোধ, ‘এর ওপর এখনই আপনাকে ছোট্ট একটি মন্তব্য প্রতিবেদন দিতে হবে।’ আমি ভাবি, ‘বলে কী?’ যা-ই হোক, বার্তা সম্পাদকের অনুরোধ রক্ষা করে ভাবতে বসলাম, আমাকে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান কতখানি মর্যাদা দেন, কতখানি আপন ভাবেন বলেই তাঁর পত্রিকার অভ্যন্তরীণ কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে আমাকে নির্ভরশীল মনে করলেন!
বহুবার লিখেছি, বলেছি, ভোরের কাগজ-এ মতিউর রহমান আমাকে কীভাবে কলামিস্ট বানানোর অসাধ্য সাধন করলেন। একদিন ভোরের কাগজ-এ প্রতিবেদন জমা দিতে গেলে অনেক কালের পরিচিত (সেই অবজারভার-চিত্রালীর আমল থেকে) সাংবাদিক আবদুল হাই বললেন, ‘মতি আর ভোরের কাগজ-এ নেই।’ কেন নেই, তা নিয়ে কিছু খোঁজখবর করে বাসায় ফিরতেই মতির টেলিফোন, ‘মূসা ভাই, আপনি কি আজ দুপুরে আমার সঙ্গে শেরাটনে লাঞ্চ করবেন?’ কারণ জিজ্ঞাসা করলাম না, দুপুরে চুপচাপ লাঞ্চ খাওয়ার পর মতি জানালেন, ‘মূসা ভাই, আমি নতুন পত্রিকা প্রকাশ করছি, আপনার সহযোগিতা চাই।’ সেদিন থেকেই আমি আলোর পথের সহযাত্রী হয়ে অন্তরঙ্গ হয়ে গেলাম সম্পাদক ও পত্রিকা—উভয়ের সঙ্গে। প্রথম আলোর বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে পত্রিকাটি এখন মধ্যগগন থেকে উত্তাপ ছড়াচ্ছে। এই উত্তরণ ও উত্থানে আমার কিছু অবদান আছে, ভাবতেই আবেগাপ্লুত হয়ে যাই।
এই উত্থান বা ক্রমারোহণ করতে গিয়ে প্রথম আলো শুধু সংবাদ ও মন্তব্য প্রতিবেদনে বৈচিত্র্য আনেনি, সম্পাদক ও নিত্যনতুন ধারণার উদ্ভাবক মতিউর রহমান সংবাদপত্র তথা মিডিয়ার একটি দায়বদ্ধতাকে সামনে নিয়ে এসেছেন। এই দায়বদ্ধতা হচ্ছে সামাজিক দায়িত্ববোধ, পত্রিকাটি রাজনৈতিক পরিবেশ-পরিস্থিতিতে যেমন পরোক্ষ ভূমিকা রাখছে, একইভাবে সমাজ বদলানোর দায়ভার নিয়েছে, যা আলোচিত, সমালোচিত ও প্রশংসিত হচ্ছে। অন্যান্য পত্রিকা থেকে এখানেই প্রথম আলোর ভিন্নতা। বলতে বাধা নেই, প্রথম আলো সামাজিক দায়বদ্ধতা বিষয়টিকে বস্তুত নিজেদের প্রচার ও প্রচারণার স্বার্থেই ব্যবহার করছে—এমন ধারণাও কারও কারও আছে। তাঁরা সাংবাদিক ও গণমাধ্যম যে অতীতেও নিজেদের জগৎ বা গণ্ডির বাইরে সমাজ পরিবর্তনে, জনহিতকর ও জনস্বার্থে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে, তা জানেন না। তাঁদের জ্ঞাতার্থে ইতিহাসের পেছনের পাতা ওল্টাতে হচ্ছে।
বিগত শতাব্দীর ছিচল্লিশের হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার পর দৈনিক আজাদ ‘বিহার রিলিফ ফান্ড’ মাধ্যমে দাঙ্গাপীড়িতদের জন্য অর্থ-সাহায্য সংগ্রহ করেছিল। সেই অর্থে বিহারে স্বেচ্ছাসেবক দল পাঠিয়েছিল। সেদিন কেউ প্রশ্ন করেনি, এ তো পত্রিকার কাজ নয়। প্রচার বৃদ্ধির কৌশল নয়, পাকিস্তান আমলে চৌষট্টির দাঙ্গার পর দুটি আইয়ুব-সমর্থক পত্রিকা বাদে সব পত্রিকায় সম্মিলিত আবেদন ছাপা হলো, পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও—ইস্ট পাকিস্তান রেসিস্ট। এটা কোনো খাঁটি সংবাদ নয়, প্রতিবেদনও নয়, এ ছিল একটি সামাজিক আন্দোলনে গণমাধ্যমের দায়বদ্ধতা থেকে উত্তরণের ভূমিকা। শুধু পত্রিকার পাতায় আবেদন নয়, রাজনীতি ও সাম্প্রতিকতাবিরোধীদের সঙ্গে মিছিলে সাংবাদিকদের মিছিল করলেন।
এমনি আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়, সব মনে পড়ছে না। প্রথমটি যে ছিল দৈনিক আজাদ-এর মানবতার সেবা, যেমনটি আজ করেছে প্রথম আলো, অ্যাসিডদগ্ধদের একটি অভিশাপ থেকে মুক্তি দিয়ে সার্বিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। পত্রিকার পাতায় এখন অ্যাসিড নিক্ষেপের খবর অনেক কম দেখা যায়। এই মানবতাসংশ্লিষ্ট ভূমিকার কারণে পত্রিকাটি কি আর্থিক অথবা পরোক্ষভাবে লাভবান হয়েছে? এমনি আরেকটি ব্রত নিয়ে প্রথম আলো আমাদের বিপথগামী যুবাদের সামাজিক-পারিবারিক জীবনে ফিরিয়ে আনছে। তা হলো মাদককে ‘না’ বলুন। এই আবেদনটি পত্রিকার পাতায়, সভা-সেমিনার করে দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য কি ছিল যুবকদের মাঝে প্রথম আলোর পাঠক সৃষ্টি? মনে হয় না, কিংবা তা-ই যদি হয়, মন্দ কী? তারা পয়সা দিয়ে ইয়াবা না কিনে প্রথম আলো কিনছে, এমনটি যদি হয় ক্ষতি কী?
প্রথম আলো আমাদের গণমাধ্যম-জগতে যে এমনি অনেক সামাজিক সচেতনতার বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে যাচ্ছে, নিছক সংবাদ বিতরণ করে না। নোটবই পড়া ছাত্র এখন গণিত শেখার চর্চা করছে। কিশোর-কিশোরী বিদেশে যাচ্ছে প্রথম আলোর প্রচারে নয়, বাংলার খুদে প্রতিভাধরদের বিশ্বদরবারে পরিচিত করতে যোগ দিচ্ছে গণিত অলিম্পিয়াডে। চলমান বিতর্ক প্রতিযোগিতা ছেলেমেয়েদের সাধারণ জ্ঞানের ভান্ডার উন্মুক্ত করে দিয়েছে। প্রথম আলো এসবই করছে। সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়ে গণমাধ্যমের ভূমিকা পরস্ফুিট করতে।
মূল কথা হচ্ছে, প্রথম আলো শুধু একটি দৈনিক পত্রিকা নয়, ‘যা কিছু ভালো তার সঙ্গে বাস্তব ক্ষেত্রে প্রথম আলো’ সক্রিয় অংশগ্রহণ করছে। তার পরও ভয় হয়, ‘পত্রিকাটির প্রভাতে সূর্য ওঠা সফল হয়েছে।’ এখন দ্বিপ্রহরের মধ্যগগনে। কিন্তু অতীতে অনেক পত্রিকাকে মধ্যগগনে থেকে গনগন করে তাপ ছড়াতে দেখেছি। তারপর চলেছে তাদের অস্তাচলের পথে যাত্রা। প্রথম আলোর ক্ষেত্রে তেমনটি যেন না হয়, মতিউর রহমানকে এখন সেই চিন্তা করতে হবে। কারণ, যতই প্রথম আলো ‘বদলে যাও, বদলে দাও’ বলুক, রাষ্ট্র, সরকার, সমাজ ও জনমনে সবকিছু যে সেই প্রত্যাশা মিটিয়ে বদলাচ্ছে না। তার পরও পত্রিকা ও সম্পাদককে বলব, ‘ও আলোর পথযাত্রী! এ যে রাত্রি এখানে থেমো না!’
এবিএম মূসা: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।