পৃথিবীর সব দেশের মুসলমান আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে একটি নির্দিষ্ট সময়ে কাবাঘরের চারপাশে এবং মক্কার অপর কয়েকটি স্থানে সম্মিলিত কতগুলো ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনের মাধ্যমে হজ আদায় করেন। আল্লাহর কাছে নিজেকে আত্মসমর্পণের মুহুর্মুহু ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ ধ্বনিতে মক্কা থেকে ১৫ কিলোমিটার নিকটবর্তী সুবিশাল আরাফাতের ময়দান মুখরিত ও প্রকম্পিত করে বিশ্বের লাখ লাখ মুমিন বান্দা পবিত্র হজ পালন করেন। ভাষা, বর্ণ ও লিঙ্গের ভেদাভেদ ভুলে বিশ্বের প্রায় ১৭২টি দেশের ২৫-৩০ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান প্রতিবছর হজ পালনের লক্ষ্যে মিনা থেকে আরাফাতে গমন করেন। মূলত ৯ জিলহজ আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করাই হজ। নবী করিম (সা.) ফরমান, ‘আরাফাতে অবস্থান করাই হজ।’ (তিরমিজি)
হজের মাধ্যমে বিশ্ব মুসলিম ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধের স্বরূপ প্রকাশ পায়। এ মহামিলনকেন্দ্রে দুনিয়ার সব দেশ, অঞ্চল, জাতি-বংশ-বর্ণ এবং বিভিন্ন ভাষাভাষী ও আকার-আকৃতির মুসলমান স্রষ্টাপ্রেমে ব্যাকুল হয়ে কাফনসদৃশ সাদা পোশাকে সজ্জিত হয়ে একই বৃত্ত ও কেন্দ্রবিন্দুতে সমবেত হন। সমবেত কণ্ঠে বিশ্বের বিভিন্ন এলাকার নানা ভাষা, আকৃতি ও বর্ণের লাখ লাখ মুসলমান তালবিয়া পাঠরত অবস্থায় হজ পালনে শরিক হন। মক্কা থেকে হজের ইহরাম পরিহিত লাখ লাখ মুসলিম নর-নারী, যুবক ও বৃদ্ধ গভীর ধর্মীয় আবেগমিশ্রিত কণ্ঠে ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান নিয়ামাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা শারিকা লাকা’ অর্থাৎ আমি হাজির, হে আল্লাহ! আমি হাজির, আপনার কোনো শরিক নেই, আপনার মহান দরবারে হাজির, নিশ্চয়ই সব প্রশংসা, নিয়ামত এবং সব রাজত্ব আপনারই, আপনার কোনো শরিক নেই—এ হাজিরি তালবিয়া পাঠ করতে করতে মিনাতে এসে জোহর, আসর, মাগরিব, এশা ও ফজরের নামাজ আদায় করেন।
এরপর মিনা থেকে উচ্চ স্বরে তালবিয়া পাঠরত অবস্থায় আরাফাতের বিশাল প্রান্তরে হাজিরা উপস্থিত হন। জোহরের নামাজের আগে আরাফাত ময়দানের মসজিদে নামিরার মিম্বরে দাঁড়িয়ে হাজিদের উদ্দেশে হজের খুতবা দেওয়া হয়, যাতে আল্লাহভীতি বা তাকওয়া, মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, সংহতি, বিশ্বশান্তি ও কল্যাণের কথা ব্যক্ত করা হয়। খুতবা শেষে জোহর ও আসরের ওয়াক্তের মধ্যবর্তী সময়ে জোহর ও আসরের কসর নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করা হয়। সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত সব হাজি আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করে আল্লাহর জিকিরে মশগুল থাকেন। হজের দিনে সারাক্ষণ আরাফাতে অবস্থান করা ফরজ। আরাফাতের ময়দানে অবস্থানের প্রতিদানস্বরূপ আল্লাহ সেসব হাজিকে নিষ্পাপ ঘোষণা করেন। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে যে আল্লাহ তাআলা আরাফার দিনে ফেরেশতাদের ডেকে বলেন, ‘হে ফেরেশতারা! তোমরা লক্ষ করো, আমার বান্দারা কী প্রকারে বহু দূরদূরান্ত থেকে এসে আজ আরাফাত মাঠে ধুলাবালির সঙ্গে মিলিত হয়েছে। তোমরা সাক্ষী থাকো, যারা আমার ঘর (কাবা) জিয়ারত করতে এসে এত কষ্ট স্বীকার করছে, নিশ্চয়ই আমি তাদের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দিলাম।’ (বুখারি) ‘আরাফার দিন আল্লাহ এত অধিক পরিমাণ জাহান্নামিকে অগ্নি থেকে মুক্তি দেন, যা অন্য কোনো দিবসে দেন না।’ (মুসলিম)
হজের মৌসুমে মক্কা শরিফে বিশ্বের মুসলমান একতাবদ্ধ হয় এবং কাবাঘর তাওয়াফ, আরাফাতের ময়দানে অবস্থান, সাফা-মারওয়ায় দৌড়ানো ইত্যাদি ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা পালন করেন। এতে ঐক্যবোধ জাগরিত হয় এবং সামাজিক জীবনে এর প্রতিফলন দেখা যায়। হজ মানুষকে ইসলামের সাম্য, মৈত্রী, ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ শিক্ষা দেয়। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলমান সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সেলাইবিহীন একই ধরনের সাদা পোশাক শরীরে জড়িয়ে হজ পালন করেন। ফলে তাদের মধ্যে যাবতীয় বৈষম্য দূর হয় এবং সাম্যের অনুপম মহড়ার অনুশীলন হয়। হজের প্রতিটি অনুষ্ঠান পালনের ক্ষেত্রে হাজিরা একই সারিতে সমবেত হন। তাঁদের মধ্যে কোনো ধরনের ঝগড়া-বিবাদ থাকে না। সবাই এক আল্লাহর বান্দা ও রাসুলের উম্মত হিসেবে পরিচিত হন। এতে বিশ্বের সব মুসলমান একটি অখণ্ড উম্মাহ এবং সবাই পরস্পর ভাই ভাই প্রতীয়মান হয়। পারস্পরিক মেলামেশার ফলে একে অপরের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-কষ্ট অনুভব করতে শেখে এবং সহানুভূতি প্রকাশ পায়। তাই সঠিকভাবে হজ আদায়কারীকে জান্নাতের সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে, ‘বিশুদ্ধ মকবুল একটি হজ পৃথিবী ও এর মধ্যকার সব বস্তু থেকে উত্তম। বেহেশত ব্যতীত কোনো কিছুই এর বিনিময় হতে পারে না।’ (বুখারি ও মুসলিম)
হজ বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টির এক বিশেষ প্রশিক্ষণ। কালো-সাদা, বর্ণ-বৈষম্যহীন বিশ্ব মানবসভ্যতা গঠনের লক্ষ্যে সবাইকে একই পোশাক মাত্র দু-টুকরো কাপড় পরিধান করে ভিক্ষুকের মতো আল্লাহর দরবারে হাজির হতে হয়। এখানে কোনো ব্যক্তি বা দেশের বিশেষ মর্যাদা ও উঁচু-নিচুর শ্রেণীবিন্যাস করা হয় না। এভাবে হজ ইসলামি ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সৃষ্টি করে থাকে এবং সমাজব্যবস্থায় ন্যায়নীতির ভাবধারা চালু হয়। হজই একমাত্র ইবাদত, যা পালনের সময় দুনিয়ার মায়া-মহব্বত ছেড়ে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর দিকে ধাবিত হয়। একজন হাজি পার্থিব সব ধনসম্পদ, স্ত্রী, সন্তানসন্ততি ছেড়ে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে বায়তুল্লাহ শরিফে পাড়ি জমান। হজ মুসলমানদের মনে আল্লাহর আনুগত্যের স্বীকৃতি, হূদয়ের পবিত্রতা, ইমানের শক্তি বৃদ্ধি ও আধ্যাত্মিক জীবনের চরম উন্নতি সাধনের দ্বারা অন্তরে পারলৌকিক সুখের অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। সাম্য, মৈত্রী, বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধ ও সম্প্রীতির সৃষ্টি এবং ভাষা ও বর্ণবৈষম্য ভাবের উৎখাত করে। ইহরাম, তালবিয়া, সালাত, তাওয়াফ, হাজরে আসওয়াদে চুম্বন বা স্পর্শ করা, সাফা ও মারওয়ায় সায়ি করা, আরাফাতের ময়দানে অবস্থান, পশু কোরবানি, শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ, মুজদালিফায় রাতযাপন ও মাথা মুণ্ডানো প্রভৃতি ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা পালনের জন্য সামর্থ্যবান মুসলমানদের জীবনে মাত্র একবার হজ সম্পাদন করা ফরজ বা অত্যাবশ্যক।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com