আমাদের কী করতে হবে

তথ্যে গম্যতা বা তথ্য অধিকার জাতিসংঘ স্বীকৃত একটি মৌলিক অধিকার। বিভিন্ন দেশ এই অধিকার বিভিন্ন নামে অভিহিত করে আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করেছে। বাংলাদেশে ২০০৯ সালে গৃহীত হয়েছে ‘তথ্য অধিকার আইন’। ২০০২ সালের ২৬ থেকে ২৮ সেপ্টেম্বর বুলগেরিয়ার রাজধানী সোফিয়াতে তথ্য অধিকার ও তথ্যের অবমুক্তি আইন বিষয়ে একটি আন্তর্জাতিক বৈঠকে ২৮ সেপ্টেম্বরকে ‘আন্তর্জাতিক জানার
অধিকার দিবস’ বা ‘ইন্টারন্যাশনাল রাইট টু নো ডে’ হিসেবে ঘোষণা করে। তার পর থেকে বিশ্বজুড়ে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। গত বছর বাংলাদেশসহ ৪০টিরও বেশি দেশে দিবসটি পালিত হয়েছে। এ বছর তথ্য অধিকার ফোরাম বাংলাদেশে দিবসটি উদ্যাপনের পদক্ষেপ নিয়েছে।
আমাদের তথ্য অধিকার আইন পাসের পর ৪৮ মাস পেরিয়ে গেছে। কিন্তু আইনটি খুব একটা সাফল্যের মুখ দেখেনি। এ আইন কার্যকর করতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখার কথা তথ্য কমিশনের। কিন্তু তথ্য কমিশনের কর্মকাণ্ডে যে গতিশীলতা প্রত্যাশিত ছিল, তা এযাবৎ দৃশ্যমান হয়নি। তথ্য অধিকার আইন ও তথ্য কমিশনের উপস্থিতি, কার্যকারিতা ও সুফল বৃহত্তর নাগরিক জীবনে সেভাবে লক্ষ করা যাচ্ছে না। তথ্য কমিশনের সর্বশেষ প্রতিবেদনে তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়নে সীমাবদ্ধতা বা চ্যালেঞ্জ হিসেবে ১৭টি কারণ উল্লেখ করেছে। সেগুলোর অধিকাংশই তথ্য কমিশন ও সরকারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। চার বছরেও তারা এসব সীমাবদ্ধতা দূর করতে পারেনি। তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়নে এটিই সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা বলে ধারণা করা যায়।
আইন প্রণয়নের পর এনজিও ও সুশীল সমাজকে খুব একটা তৎপর দেখা যাচ্ছে না, যদিও তথ্য অধিকার আইন প্রণয়নে এদেরই ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি। রাজধানী ও বড় শহরকেন্দ্রিক কয়েকটি এনজিও তথ্য অধিকার নিয়ে কিছু তৎপরতা দেখালেও সার্বিক বিবেচনায় তা অতি নগণ্য। এনজিওদের নিস্পৃহ হওয়ার প্রধান কারণ তথ্য অধিকার আইন তাদের জন্যও প্রযোজ্য, যা তাদের কাছে কাম্য ছিল না। সম্প্রতি প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, এনজিওবিষয়ক ব্যুরোতে নিবন্ধিত দুই হাজার ২৫২টি এনজিওর মধ্যে মাত্র ১০৮টি এনজিও তথ্য প্রদানের প্রস্তুতি নিয়েছে, যা মোট নিবন্ধিত এনজিওর ৫ শতাংশেরও কম (প্রথম আলো, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৩)। সরকারও এনজিওগুলোর সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে কোনো ধরনের টেকসই ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি নেয়নি।
তথ্য কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, সাংবাদিক ও মিডিয়াকর্মীদের তথ্য অধিকার আইন ব্যবহারে অনীহা আছে। জরিপে লক্ষ করা যায়, বাংলা দৈনিকের মধ্যে প্রথম আলোতে তথ্য অধিকারসংশ্লিষ্ট সংবাদ সবচেয়ে বেশি প্রকাশ পেয়ে থাকে। তবে এটিও যে খুব বেশি বা যথোপযুক্ত, তা নয়। গত এক বছরে প্রথম আলোয় তথ্য অধিকারসংশ্লিষ্ট ২০টিরও কমসংখ্যক সংবাদ, ফিচার ও প্রতিবেদন প্রকাশ পেয়েছে। এই অবস্থায় জনসাধারণের তথ্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় আমাদের কী করণীয় হতে পারে, সে সম্পর্কে কিছু সুপারিশ দেওয়া হলো। এসব শুধু তথ্য অধিকার দিবসেই সীমিত থাকবে না, আমরা প্রতিদিনই এগুলো কার্যকর করতে পারি।
আপনি একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে তথ্য চেয়ে এক বা একাধিক সরকারি বা বেসরকারি সংস্থায় আবেদন করতে পারেন বা কাউকে আবেদন করতে উদ্বুদ্ধ ও সহযোগিতা করতে পারেন। আপনার এলাকার সংবাদপত্রে তথ্য অধিকার নিয়ে ফিচার লিখতে পারেন। একই সঙ্গে আপনি স্থানীয় সরকার, বেসরকারি সংস্থা, সামাজিক সংগঠন ও জনপ্রতিনিধিদের দিবসটি উদ্যাপনে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন।
আপনি ব্লগার হলে তথ্যের গুরুত্ব সম্পর্কে নিশ্চয়ই অবগত। আপনার ব্লগকে তথ্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় ব্যবহার করুন। আপনার ব্লগে তথ্য অধিকার প্রয়োগের সফলতা ও বিফলতার উদাহরণগুলো প্রকাশ করুন। পাশাপাশি তথ্য অধিকারের সমস্যা ও সমাধান বিষয়ে মতামত আর বিতর্ক চালু রাখুন। এনজিও বা সুশীল সমাজ এ দিবসে তথ্য অধিকার সম্পর্কে সচেতনতামূলক প্রচারণা এবং বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারে। তারা জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করে বিশেষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তথ্য অধিকার প্রতিষ্ঠার বিভিন্ন পথ ও পদ্ধতি আলোচনা করতে পারে। একই সঙ্গে তথ্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে সফল ব্যক্তি বা সংস্থাকে সম্মাননা দিতে পারে। শিক্ষক বা ছাত্র হিসেবে আপনার প্রতিষ্ঠানে তথ্য অধিকার নিয়ে আলোচনা করতে পারেন। স্থানীয় বিষয় যেমন স্বাস্থ্যসেবা, ক্রীড়া, ত্রাণ বিতরণ, উন্নয়ন প্রকল্প ইত্যাদি সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে বেশি বেশি তথ্য চাইতে পারেন, যাতে তারা জনগণের চাহিদা বুঝতে পারে এবং তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়নে সক্রিয় হয়।
আপনি যদি সাংবাদিক হন, তবে আপনার সংবাদমাধ্যমকে অবলম্বন করে তথ্য অধিকারের প্রকৃত অবস্থা জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দিন। বিশেষ করে তথ্য অধিকারের সুফল ও সাফল্যগুলো তুলে ধরুন। তথ্য প্রদানে অনিচ্ছুকদের বিষয়েও সংবাদ প্রকাশ করুন, যাতে তাঁরা সতর্ক হন।
আপনি যদি নাগরিকবান্ধব বা সুশাসনের পক্ষের সরকারি বা বেসরকারি কর্মকর্তা হন, তবে তথ্য প্রদানের জন্য আপনার প্রতিষ্ঠানকে তৈরি করুন। তথ্য অধিকার আইনের আওতায় চাহিদা পাওয়া মাত্র তথ্য প্রদানের বাধাগুলো চিহ্নিত করুন এবং তা দূর করার উদ্যোগ নিন। আপনার প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে যত বেশি সম্ভব তথ্য সন্নিবেশিত করুন। তথ্য সংরক্ষণ বা নথি ব্যবস্থাপনায় সকল স্তরকে উদ্বুদ্ধ করুন। জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট সব তথ্য পুস্তিকা, প্রচারপত্র, দেয়ালে বা বিলবোর্ডের সাহায্যে প্রচার করুন। আপনার সংস্থার তথ্য যত বেশি জনগণের কাছে পৌঁছবে, আপনার স্বচ্ছতাও তত বেশি প্রতিষ্ঠা পাবে।
বলা হয়, বর্তমান সরকারের অন্যতম প্রধান সাফল্য ছিল ‘তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯’ প্রণয়ন করা। কিন্তু আইনটি কার্যকর করতে সরকার আন্তরিক কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে। কিন্তু নীতিনির্ধারকেরা নিশ্চয় জানেন যে তথ্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলে প্রশাসনে দুর্নীতি রোধ হয়, স্বচ্ছতা আসে এবং জবাবদিহির আবহ সৃষ্টি হয়। ফলে চূড়ান্তভাবে প্রশাসনে জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধি পায় এবং সরকার জনপ্রিয় হয়।
মুহাম্মদ লুৎফুল হক: গবেষক।
lutful55@gmail.com