২৩-২৪ মে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপের উত্তর-পূর্ব অংশে একটি নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়ে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে, বলছে আবহাওয়া পূর্বাভাস মডেল। ঘূর্ণিঝড়টির নাম হবে ‘যশ’। এক সপ্তাহ আগেই আমেরিকার আবহাওয়ার পূর্বাভাস মডেল এই ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির কথা বলেছিল। আর আজ বিশ্বের সব আবহাওয়ার পূর্বাভাস মডেল বঙ্গোপসাগরে এই ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির কথা নির্দেশ করছে। প্রায় সব মডেলই বলছে, ঘূর্ণিঝড়টি ২৫ মে মধ্যরাত থেকে ২৬ মে সন্ধ্যার মধ্যে স্থলভাগে প্রবেশ করবে। ঘূর্ণিঝড়টি ওডিশার উপকূল দিয়ে স্থলভাগে প্রবেশ করার কথা বলছে শুধু ইউরোপীয় ইউনিয়নের মডেল, বাকি সব মডেলই (আমেরিকা, কানাডা, জার্মানি) নির্দেশ করছে, ঘূর্ণিঝড়টি ভারত ও বাংলাদেশের সুন্দরবন অংশের ওপর দিয়ে স্থলভাগে প্রবেশ করবে।
জানমালের ওপর প্রভাব
আম্পানে ক্ষতিগ্রস্ত সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার মানুষদের স্বেচ্ছাশ্রমে বেড়িবাঁধ নির্মাণের আবেগস্পর্শী ছবি দেখেছে মানুষ। আতঙ্কের কথা, আম্পান যে স্থানের ওপর দিয়ে স্থলভাগে প্রবেশ করেছিল, প্রায় একই স্থান (সাতক্ষীরা, খুলনা ও পশ্চিমবঙ্গের উপকূল) দিয়ে সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়টি প্রবেশ করতে পারে। মডেলগুলোর সর্বশেষ পূর্বাভাস বলছে, ঘূর্ণিঝড়টি একটি মধ্যম মানের ঘূর্ণিঝড় হতে পারে। স্থলভাগে প্রবেশের সময় বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ থাকতে পারে ঘণ্টায় ১২০ থেকে ১৫০ কিলোমিটার। অপেক্ষাকৃত কম গতিবেগের বাতাসের কারণে এই ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতির সক্ষমতা সম্বন্ধে অনেক মানুষ বিভ্রান্ত হতে পারে। তাই সবাইকে মনে করিয়ে দিতে চাই, ২৬ মে হলো ভরা পূর্ণিমা। ফলে চন্দ্র, সূর্য ও পৃথিবী একই অক্ষে অবস্থান করবে। চন্দ্র ও সূর্যের মিলিত অভিকর্ষে ওই দিন উপকূলীয় এলাকায় প্রাকৃতিক নিয়মেই ২ থেকে ৩ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হবে। সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়টির প্রভাবে যার সঙ্গে যুক্ত হবে স্বাভাবিকের চেয়ে ৫ থেকে ১০ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস।
তাই নির্দ্বিধায় বলা যায়, ২৬ মে সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়টি যদি বাংলাদেশ ও ভারতের উপকূলে আঘাত হানে, তবে উপকূলীয় এলাকার বেড়িবাঁধগুলো স্বাভাবিকের চেয়ে ৫ থেকে ১০ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসের সম্মুখীন হবে। বেড়িবাঁধের অপেক্ষাকৃত দুর্বল স্থানগুলো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আজ ২১ মে, সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়টির উপকূলে আঘাত হানার সময় ২৬ মে। হাতে এখনো পাঁচ দিন আছে। জান ও মালের ক্ষতি কমিয়ে আনার জন্য পাঁচ দিন পর্যাপ্ত সময়। বাংলাদেশ সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় ও পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষের প্রতি অনুরোধ, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের উপকূলীয় এলাকার বেড়িবাঁধগুলো নিরীক্ষা করে জরুরি মেরামতের পদক্ষেপ নিন। প্রবাদে আছে, রোগ হওয়ার পরে চিকিৎসার চেয়ে রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা নেওয়া অধিক শ্রেয়তর।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস থেকে মানুষ উপকৃত হয় কি?
স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের ঘূর্ণিঝড় পূর্বাভাস সক্ষমতা কী পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে, পূর্বাভাস পদ্ধতির কী পরিমাণ উন্নতি হয়েছে কিংবা প্রদত্ত আবহাওয়ার পূর্বাভাস মানুষের কতটুকু কাজে লাগে, তার খুব সুন্দর একটি বর্ণনা পাওয়া যায় আম্পান বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানার দিন (২০ মে ২০২০) প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রখ্যাত পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আইনুন নিশাতের ‘ঘূর্ণিঝড়ের পর যা করতে হবে’ শিরোনামের উপসম্পাদকীয়তে:
ব্রিটিশ আমলের সাইক্লোন ওয়ার্নিং সিস্টেম সামান্য বদলেছে। নৌ আর সমুদ্রবন্দরের পার্থক্যটা ঘুচেছে। কিন্তু বন্দরের জন্য পূর্বাভাস দেওয়া হাতজোড় করে বলছি, বন্ধ করুন। মানুষের জন্য পূর্বাভাস দিন। পাশের দেশ ভারতে যেভাবে পূর্বাভাস দেয়, উন্নত বিশ্বে যেভাবে পূর্বাভাস দেয়, সেই পদ্ধতি অবলম্বন করুন। যখন মোংলা ও পায়রা বন্দরকে ১০ নম্বর মহাবিপৎসংকেত দেওয়া হচ্ছে, তখন চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে ৯ নম্বর সংকেত দেওয়া হচ্ছে। ৮, ৯ ও ১০ নম্বর সংকেতের মানে হচ্ছে প্রশাসনের দায়িত্ব, সবাইকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া। কক্সবাজার অঞ্চলে তো এই ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব পড়বে না। তাহলে সেখানে ৯ নম্বর সংকেত দিয়ে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কেন একটা সংশয়ের মধ্যে ফেলা?...আবহাওয়ার পূর্বাভাস দুর্বোধ্য ভাষায় দেওয়া বন্ধ করে জনমানুষের জন্য বোধগম্য করতে হবে।’
মোংলা সমুদ্রবন্দরে ১০ নম্বর বিপৎসংকেত ঝিনাইদহ জেলার ফুলচাষি কৃষকদের কাছে কোনো গুরুত্ব বহন করে না। কিন্তু সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ২০০ থেকে ৪০০ মিলিমিটার বৃষ্টির সম্ভাবনার তথ্য ওই একই ফুলচাষি কৃষকদের কাছে গুরুত্ব বহন করে। একই ভাবে সমুদ্রে মৎস্য আহরণ পেশায় নিয়োজিত জেলেদের জন্য ঘূর্ণিঝড় উপকূলে আঘাত হানার দুই থেকে তিন দিন আগেই জানা প্রয়োজন। কারণ, এর ওপরই নির্ভর করবে তাঁরা গভীর সমুদ্রে মৎস্য আহরণে যাবেন কি না। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর এ রকম নির্দিষ্ট ঘূর্ণিঝড় পূর্বাভাস কেন দিতে পারে না, তা দেশের মানুষকে জানানো উচিত বলে মনে করি।
যা করতে পারে আবহাওয়া অধিদপ্তর
আবহাওয়ার পূর্বাভাস মডেলগুলোর কল্যাণে সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়ের কথা ৫ থেকে ১৭ দিন আগেই এখন জানা যায়। মডেলগুলোর অভূতপূর্ব উন্নতির ফলে আঘাত হানার দু-তিন দিন আগেই ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ নিশ্চয়তা দিয়ে ঘূর্ণিঝড়ের পথ জানা যায়। একটা উদাহরণ দিই। ২০২০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর আমেরিকার লুইজিয়ানার লেক চার্লস এলাকায় হ্যারিকেন লওরা আঘাত হানে। স্থলভাগে আঘাত করার ৩৬ ঘণ্টা আগে এই ঘূর্ণিঝড়ের সম্ভাব্য পথের যে পূর্বাভাস করেছিল আমেরিকার আবহাওয়া পূর্বাভাস মডেল ‘জিএফএস’, বাস্তবে ঘূর্ণিঝড়টি সেই পথ থেকে মাত্র ১ কিলোমিটার দূর দিয়ে প্রবেশ করেছিল।
আগের ঘূর্ণিঝড়গুলোর পূর্বাভাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর ক্ষেত্র ভেদে একটি পূর্বাভাস দেওয়ার পর ৬ থেকে ১২ ঘণ্টা আর কোনো আপডেট দেয় না। দেখা যায়, একটি পূর্বাভাসে ২ থেকে ৪ নম্বর সতর্কসংকেত দেওয়ার পরের পূর্বাভাসেই হঠাৎ ৯ বা ১০ নম্বর মহাবিপৎসংকেত জারি করে। জাপানের আবহাওয়াবিষয়ক কৃত্রিম ভূ-উপগ্রহ হিমাওয়ারি থেকে বঙ্গোপসাগরের ওপর সৃষ্ট যেকোনো ঘূর্ণিঝড়ের ছবি পাওয়া যায় প্রতি ১০ মিনিট অন্তর। যে ছবি বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়া পূর্বাভাসবিদেরা যেকোনো ঘূর্ণিঝড় সম্বন্ধে ধারাবাহিকভাবে পূর্বাভাস দিতে পারেন। প্রতি ১০ মিনিট না হোক, প্রতি ৩০ মিনিটে কিংবা প্রতি ঘণ্টায় একটি করে ঘূর্ণিঝড় আপডেট কেন দিতে পারে না বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর, সেই প্রশ্নের উত্তর বাংলাদেশের মানুষদের জানানো উচিত বলে মনে করি।
মোস্তফা কামাল আবহাওয়া ও জলবায়ু বিষয়ক পিএইচডি গবেষক, স্কুল অব এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সাসটেইনিবিলিটি, সাসকাচোয়ান বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা
kamaluw@gmail.com