চিকিৎসাবিজ্ঞানের জগতে অভূতপূর্ব উন্নতি হওয়ায় এবং মানুষের স্বাস্থ্যসচেতনতা বাড়াতে সংক্রামক ব্যাধিগুলো পরাস্ত হয়েছে, মানুষের গড় আয়ুও বেড়েছে। এতে জনমনে স্বস্তি এলেও স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো নতুন রূপে আবির্ভূত হয়েছে। অসংক্রামক ব্যাধি এখন বড় স্বাস্থ্য সমস্যা। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, অস্বাস্থ্যকর আহার, মানসিক চাপ ও শরীরচর্চার অভাব, সমস্যাকে আরও প্রকট ও জটিল করে তুলেছে। একবিংশ শতকে স্বাস্থ্য ও প্রবৃদ্ধির পথে প্রধান যে চ্যালেঞ্জ অসংক্রামক রোগ, এদের মধ্যে ডায়াবেটিস যে শীর্ষে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, পৃথিবীজুড়ে ৩৭ কোটির বেশি মানুষের রয়েছে ডায়াবেটিস। শীর্ষে রয়েছে চীন, ভারত, আমেরিকা ও ব্রাজিল। তবে প্রতিটি দেশেই ক্রমে ক্রমে বাড়ছে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা। বস্তুতপক্ষে ডায়াবেটিস বাড়ার হার এখন উন্নত বিশ্বের চেয়ে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বেশি। আবার ডায়াবেটিস আছে এমন লোকজনের মধ্যে অর্ধেকই জানেন না যে তাঁদের ডায়াবেটিস রয়েছে। আরেকটি আশঙ্কার কথা হলো, পাঁচজন ডায়াবেটিস রোগীর মধ্যে চারজনেরই বসবাস নিম্ন আয় ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে।
বাংলাদেশে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা এক কোটির কাছাকাছি; এই অনুমান ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশনে চিকিৎসাসেবা নিতে আসা লোকজনের কাছ থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে করা। তবে আসল রোগীর সংখ্যা যে এর চেয়ে অনেক বেশি হবে, তা বলাই বাহুল্য।
এ বছরও ১৪ নভেম্বরে আবার এল বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস। ‘ডায়াবেটিস শিক্ষা ও প্রতিরোধ’—এ থিমকে এগিয়ে চলার পাথেয় হিসেবে ধারণ করে পাঁচটি বছর পেরিয়ে বিশ্বব্যাপী অভিযানের কাফেলা এসে থামবে পঞ্চম ও শেষ বর্ষের শেষ প্রান্তে।
এ বছর হবে কাজের মূল্যায়নের বছর, ফলাফল মূল্যায়নের বছর এবং নতুন উদ্যোগে আরও এগিয়ে চলার সংকল্প গ্রহণের বছর। আগামী প্রজন্ম যাতে সুরক্ষিত থাকে, সেই প্রত্যয় নিয়ে ডায়াবেটিসের বিরুদ্ধে লড়াই চলেছিল। ডায়াবেটিস একটি জীবনভর রোগ, একে জীবনযাপনের অসুখ বলে আখ্যা দিতে অনেকেরই পছন্দ। কারণ, জীবনযাপনের যেসব সমস্যা যেমন অস্বাস্থ্যকর আহার, শরীরচর্চা না করা, শুয়ে-বসে থাকা জীবন, স্থূল শরীর—এগুলো ডায়াবেটিস হতে সাহায্য করে আবার ডায়াবেটিস হলেও স্বাস্থ্যকর ও পরিমিত আহার, অন্তত প্রতিদিন আধা ঘণ্টা দ্রুত হাঁটা, ধূমপান না করা—স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের এসব নিয়ম মানলে জটিলতা থেকে দূরে থাকা যায়।
একটা প্রশ্ন প্রায় অনেকেই করেন, নগরায়ণের ফলে জীবনযাপনে যেসব পরিবর্তন এসেছে, স্থূলতা এবং সেই সঙ্গে যেসব অসুখ এসেছে, মানুষের শরীর এগুলো সইতে পারে কি না। শরীর তো সর্বংসহা-মহাশয় বলে একে জানে সবাই—তবু শেষরক্ষা হয় না। একসময় খাদ্যের অনিশ্চয়তা, সরবরাহে নানা সমস্যা—এসব ছিল মানুষের চ্যালেঞ্জ। যখন পাওয়া যেত, তখন উদরপূর্তি ও ‘ভোজ’ আর না পেলে চলত ‘অনাহার’। শরীরও তাই এ খাদ্যসংকটে অভ্যস্ত হলো, অভিযোজনের পালা চলল।
যখন ‘ভোজ’ হতো, তখন শরীর সেই সাময়িক খাদ্য উদ্বৃত্তকে মেদে রূপান্তর করায় কুশলী হয়ে উঠল। সেকালে সেভাবেই বেঁচে থাকা সম্ভব হতো মানুষের। এরপর অনেক দিন গেল। কৃষি ও খামার এল সভ্যতায়। নতুন সভ্যতায় খাদ্য উৎপাদন ও সংরক্ষণের পদ্ধতিগুলো মানুষের খাদ্যে প্রাচুর্য আনল। ফাস্টফুড, টিনজাত, প্রক্রিয়াজাত খাবার, কোমল পানীয়— সহজলভ্য প্রচুর খাদ্য মানুষও প্রশ্রয় দিতে লাগল। এর সঙ্গে ইন্টারনেট, ফেসবুকে আসক্তি—এ নাগরিক সভ্যতা প্রশ্রয় দিল স্থূলতাকে।
সব সময় খাদ্যের সহজলভ্যতা, অনাহারে অভ্যস্ত শরীরযন্ত্র এ নতুন উপদ্রব সইতে পারে না। আর এ বাড়তি ক্যালরি ঝরাতেও চায় না আধুনিক মানুষ। অনায়াসে, অতি সহজে পাওয়া খাদ্য সমাহারে অস্বাস্থ্যকর খাদ্যও বেশি, স্বাদু ও তেলযুক্ত মিষ্টি—এ রাজ্যে এসে মানুষ নিজের অবয়বকে স্ফীত করা ছাড়া আর কীই-বা করতে পারে! এমন সব আতিশয্য ও প্রশ্রয়ের ফলে এল ডায়াবেটিস, হূদেরাগ, ক্যানসারের মতো অসুখ। আমরা জানি, শরীর প্রাচুর্যের চেয়ে দুর্ভিক্ষ বা অপ্রাচুর্যের প্রতি সহনশীল বেশি।
বেঁচে থাকতে হলে ক্যালরি চাই, শক্তি চাই, তবে বাড়তি শক্তিকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টাও চাই। তাই প্রয়োজন ব্যায়াম। চাই পরিমিত খাবার, স্বাস্থ্যকর খাবার। কম কম করে কয়েকবার খাওয়া। জানি নির্মল বাতাস, কাকচক্ষু জলের সরোবর, কোলাহলমুক্ত পরিবেশ, বৃক্ষে সুশোভিত নগর পাব না, তবু খেলার মাঠ পেতে পারি কি? দু-তিনটি স্কুল মিলে একটি খেলার মাঠ কি হবে না বাচ্চাদের জন্য? সাইকেল চালিয়ে চলার মতো ছোট পথ? হাঁটার জন্য নিরাপদ পথ? নিজেদেরও অবশ্য সচেতন হতে হবে। শুয়ে-বসে না থেকে চলাফেরা করব। জোরে জোরে হাঁটব অন্তত প্রতিদিন আধা ঘণ্টা। পরিমিত আহার করব।
খাদ্যসম্ভারের মধ্যে থেকেও সংযম বজায় রেখে কম খাব, স্বাস্থ্যকর খাবার খাব। ব্যায়াম করব। টিভি ও কম্পিউটারে, ইন্টারনেটে এবং ফেসবুকে আসক্ত হব না। ফল দিয়ে নাশতা করব, চিপস দিয়ে নয়। ধূমপান করে থাকলে ছাড়ব। লবণ কম খাব। চিনি কম খাব। আর চেকআপ করাব ডায়াবেটিস আছে কি না। ডায়াবেটিস সম্বন্ধে জেনেশুনে, রোগ সম্বন্ধে ও এর জটিলতা সম্বন্ধে সজাগ হয়ে অন্যকেও তা জানাব, অনুপ্রাণিত করব অন্যদের সচেতন হওয়ার জন্য।
নিজের ক্ষমতায়ন এভাবে করলে নিজেরাই হয়ে উঠব ডায়াবেটিসের বিরুদ্ধে লড়াকু মানুষ। আর এভাবে আগামী প্রজন্মকে সুরক্ষিত রাখার জন্য, ডায়াবেটিসের করাল গ্রাস থেকে রক্ষার জন্য আমাদের লড়াই চলবে নিরন্তর।
অধ্যাপক এ কে আজাদ খান: সভাপতি, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি।
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী: পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস, বারডেম।