মত দ্বিমত

আওয়ামী লীগের এই দিবাস্বপ্ন টুটে যাবে

আঁকা: তুলি
আঁকা: তুলি

সংবিধান অনুযায়ী ২৪ জানুয়ারির মধ্যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে—প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণার জবাবে বিরোধী দল বলেছে, সমঝোতার পথ রুদ্ধ হয়ে গেল। এই প্রেক্ষাপটে চলমান রাজনীতি নিয়ে দুই বিশেষজ্ঞের মত প্রকাশ করা হলো।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বাজিয়ে দিলেন রণ-তূর্য। কয়েক দিন আগে তাঁর ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী’-জাতীয় ঘোষণাকে বিশ্লেষকেরা ধারণা করেছিলেন, সম্ভাব্য আলোচনা বা সংলাপের প্রারম্ভে প্রস্তুতিমূলকভাবে নিজ ভিত শক্ত করে প্রদর্শিত করার মনোবাসনার অভিব্যক্তি। হা-হতোস্মি! সব আশা চূর্ণ করে, সব দ্বার রুদ্ধ করে আচম্বিতে একি ঘোষণা! যেসব সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করা হয়েছে, তার মোদ্দা কথা হচ্ছে, সংসদের জীবদ্দশায়ই মন্ত্রিসভা গদিনশিন অবস্থায়ই নির্বাচন হবে, অর্থাৎ ২৪ জানুয়ারির মধ্যেই। সরকার থাকবে বহাল তবিয়তে, তবে মন্ত্রিসভা কোনো ‘নীতিনির্ধারণী’ সিদ্ধান্ত নেবে না। নীতিনির্ধারণী যে কী, তা কে চিহ্নিত করবে? এ প্রসঙ্গে এ কথাটি আসলেও আদতে মূল্যহীন। সম্ভবত সিরিয়া যুদ্ধ, মিসরের সংঘর্ষ বা মধ্যপ্রাচ্য সংকট বা সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যা ও তিস্তার পানি বণ্টন, সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন, টিপাইমুখ বাঁধ বা মানবাধিকার রক্ষণ—এসব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে কোনো নীতিনির্ধারণী আলোচনা বা সিদ্ধান্ত সরকার নেবে না। নেবে শুধু নির্বাহী সিদ্ধান্ত, যার অধিকাংশ স্বভাবতই এবং প্রয়োজন অনুসারেই হবে সাধারণ নির্বাচনসংক্রান্ত। এক দৈনিকের শীর্ষ খবর অনুসারে ‘প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বেই নির্বাহী বিভাগ’। আর বলা বাহুল্য, সরকারের নির্বাহী কর্মকর্তারাই সাধারণ নির্বাচন মুখ্যত পরিচালনা করবেন। আর দন্তহীন আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন তো থাকছেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সচিবদের উদ্দেশে আরও বলেছেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে। আর এ নির্বাচনে জনগণের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসার ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য সবাইকে আন্তরিকভাবে কাজ করতে হবে।’ অর্থাৎ সচিবদের এবং নির্বাহী কর্মকর্তাদের যে ‘ক্ষমতায় আসার ব্যবস্থা করতে হবে’ এবং তাও ‘আন্তরিকভাবে’—এই শব্দগুলোর অন্তর্নিহিত অর্থ সহজেই অনুমেয়।

সরকার অন্য কোনো দলের বা মতামতের কোনো তোয়াক্কাই করছে না। এমনকি সরকারে আওয়ামী লীগের জোটভুক্ত জাতীয় পার্টির সঙ্গেও কোনো আলোচনা যে হয়নি, তাও পরিষ্কার। দলটি ঘোষণা করেছে, ‘নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সমঝোতা না হলে এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে।’ সমঝোতায় পৌঁছার অপরিহার্যতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন দলের মহাসচিব।
এই একক ঘোষণার আগে মহাজোটের অংশীদারদের সঙ্গেও হয়নি কোনো আলোচনা। আওয়ামী লীগ সরকার সম্পূর্ণ এককভাবে নির্বাচন সম্পর্কে আনুষঙ্গিক সব সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং তা বাস্তবায়নের কঠোর-কুটিল-মহাসাংঘর্ষিক পথে ধাবিত হচ্ছে।
আমরা যদি অন্যান্য ঘোষিত সিদ্ধান্ত এবং নির্দেশমালা বিশ্লেষণ করি তা হলে দেখি, অন্তর্বর্তী শব্দ ব্যবহার এ প্রসঙ্গে নিরর্থক। পুরো সরকারই চলমান থাকছে—পুরোদমে তাদের ক্ষমতা, দায়িত্ব, কর্তৃত্ব, প্রটোকল—সব নিয়েই থাকছে। মন্ত্রী ও সাংসদেরা তাঁদের সব সুযোগ-সুবিধা, ক্ষমতা ও খবরদারিতে যে শুধু অটুট রাখছেন তা নয়, তা ব্যবহারও করবেন—সরকারের সব প্রজেক্ট ও পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে থাকবেন; শুধু সংসদের অধিবেশন বসবে না। সে তো আরও মজা। অর্থাৎ সাংসদেরা নিজ নিজ এলাকায় নির্বাচনী প্রচারকর্ম এবং উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন-সংক্রান্ত নির্বাচনকালীন অনুকূল কর্মতৎপরতা অব্যাহত রাখছেন। বলিহারি, ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’।
তবে তার প্রয়োজনই বা কী? ফিল্ডে তো অন্য কোনো দলই থাকছে না।
বিএনপির মুখপাত্র ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যথার্থই বলেছেন, ‘সরকার আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে পৌঁছানোর সব পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে। সমঝোতার আর কোনো পথ খোলা থাকল না।’ আরও বলেছেন, ‘সরকার চাইছে বিএনপিকে বাদ দিয়ে একদলীয় নির্বাচন করতে। তারা নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে জনমতের বাইরে গিয়ে একরোখা অবস্থান নিচ্ছে।’
শুধু বিএনপিই নয়, বাংলাদেশের জনগণই একদলীয় নির্বাচনের বিপক্ষে এবং অন্য সব দলই এর বিরোধিতা করছে। গণতন্ত্রকামী মানুষের এই ঘোষিত বিরোধিতার বিপরীতে আওয়ামী সরকার একক সিদ্ধান্ত নিয়ে মনে হয় সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হচ্ছে জনগণেরই বিরুদ্ধে। আন্তর্জাতিক মতামত উপেক্ষা করে সরকার তাদের স্বৈরাচারী সিদ্ধান্ত বলপূর্বক চাপিয়ে দিতে চাইছে। বোঝাই যাচ্ছে, এতকাল যে তাঁরা সমঝোতা, সংলাপ বা আলোচনার আভাস বা কথা বলেছিলেন, সবই মেকি, সবই ভাঁওতাবাজি। আর এই সিদ্ধান্তগুলো যে ১২ সেপ্টেম্বরের আহূত সংসদ অধিবেশনের আগেই করা হলো, সেটাও বিশেষ তাৎপর্যমূলক। অর্থাৎ সংসদ নেতা আগেই জানিয়ে দিলেন, নৈবচ নৈবচ। খামোখা আর কোনো আলোচনা বা প্রস্তাবের কথা এখন চিন্তা করাই বাতুলতা।
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আগেই দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, ‘সংলাপ, সমঝোতায় বিএনপি রাজি। তবে গ্রহণযোগ্য কোনো নির্বাচনের ব্যবস্থা না হলে জনগণ তা কঠোর সংগ্রামের ভেতর দিয়েই আদায় করবে।’ বাংলাদেশের সংগ্রামী জনতা আজ গণতন্ত্রের এই চরম পরীক্ষার ক্ষণে ত্যাগ ও তিতিক্ষার জন্যই প্রস্তুত।
ফাঁকা মাঠে ভাড়াটে গোল দিয়ে ভাড়াটে রেফারি দিয়ে বিজয় ঘোষণা করিয়ে বাংলাদেশের শাসনভার পরিচালনা করবেন, আওয়ামী লীগের এই দিবাস্বপ্ন কীভাবে টুটিয়ে দেওয়া যায়, তা বাংলার জনগণের জানা আছে। শুধু দুঃখ লাগে, শঙ্কা জাগে যে এই সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি ও প্রক্রিয়ায় শান্তিপ্রিয় নিরীহ জনগণের কী অশেষ দুর্গতি হবে, আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের হবে কী অশেষ ক্ষতি! গদি আঁকড়ে থাকার অদম্য মোহে ক্ষমতাসীন দল কি তা ভেবেই দেখল না?
ইনাম আহমদ চৌধুরী: উপদেষ্টা, বিএনপির চেয়ারপারসন।