যুদ্ধাপরাধের বিচার

আইনের শক্তি ও সামাজিক দায়

কাটুন: শিশির
কাটুন: শিশির

আদালতকক্ষে উপচে পড়া ভিড় ও রুদ্ধশ্বাস নীরবতার মধ্যে বিজ্ঞ বিচারকেরা একের পর এক পাঠ করে চলছিলেন গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মামলার রায়ের বিভিন্ন অংশ। আদালতের ভেতরের মতো বাইরেও ছিল অধীর অপেক্ষা। এই অপেক্ষার কাল ছিল কতই-না দীর্ঘ, চার দশকের বিচারহীনতা পেরিয়ে ২০০২ সালে শুরু হয়েছিল বিচারকাজ, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশজুড়ে সংঘটিত ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতার এক খণ্ডাংশের বিচার, যে নির্মমতা ঘটেছিল রাউজান এলাকায় এবং চট্টগ্রাম শহরের গুডস হিলের আবাসে, যার হোতা ছিলেন অভিযুক্ত সাকা চৌধুরী। দীর্ঘ রায়ের মধ্য দিয়ে পরতে পরতে উন্মোচিত হচ্ছিল ঘটনার পূর্বাপর ভাষ্য এবং ইতিহাসের সত্য। অভিযোগ ছিল ১৭টি, তার মধ্যে নয়টি অভিযোগে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে অভিযুক্তের ভূমিকা ও সংশ্লিষ্টতা, যে অপরাধ সুনির্দিষ্ট কতক হত্যাকাণ্ড, গণহত্যা, উৎখাত, পীড়ন, অপহরণের বটে, তবে তার চেয়েও বড় কথা, এসব ভয়ংকরতা ও বর্বরতা ঘটেছে বৃহত্তর বর্বরতা তথা জেনোসাইড এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অংশ হিসেবে। গণহত্যার পরিবর্তে ‘জেনোসাইড’ শব্দবন্ধ ব্যবহারে আমাদের পক্ষপাত বেশি, অন্তত যত দিন পর্যন্ত এর উপযুক্ত বাংলা প্রতিশব্দ আমরা খুঁজে না পাই। ‘জেনোসাইড’ শব্দটিও তো মানবজাতির অভিধানে ছিল না, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে পাইকারিভাবে ইহুদি নিধন ও অন্যান্য নাৎসি অপরাধের মুখোমুখি হয়ে আইনের পথে এর মোকাবিলার চেষ্টা থেকে এই শব্দবন্ধের উদ্ভব। বলা হয়ে থাকে অপরাধ প্রাচীন, তবে শব্দবন্ধ হালের। কোনো গোটা জাতি, ধর্ম, বর্ণ বা নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীকে উৎখাতের বা নিশ্চিহ্নকরণের লক্ষ্যে যখন আক্রমণ-অভিযান পরিচালিত হয়, তা ভয়ংকর বাস্তবতার আকার ধারণ করে, সেই গোষ্ঠীর নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ কেউ আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পান না। যেমন পাননি অশীতিপর বৃদ্ধ দাতা-পুরুষ নূতনচন্দ্র সিংহ কিংবা উনসত্তরপাড়ার হিন্দু-বসতির পঞ্চাশাধিক আবালবৃদ্ধবনিতা, যাঁদের মধ্যে ছিলেন রায়ে প্রকাশ, এমনকি অন্তঃসত্ত্বা নারী, যাঁর পেট চিরে বের হয়ে পড়েছিল অজাত মানবশিশু। হিন্দু ধর্মগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্নকরণের লক্ষ্যে পরিচালিত এসব আক্রমণ ছিল দেশব্যাপী পরিচালিত এমন আর সব হত্যাভিযানের অংশ, ফলে নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট সময়ে কৃত সাকা চৌধুরীর অপরাধ অর্জন করে আরও ভয়াবহ মাত্রা, তা হয়ে ওঠে একাত্তরে দেশজুড়ে সংঘটিত ভয়ংকরতম নৃশংসতার অংশ। আর তাই আদালত চারটি অভিযোগের ক্ষেত্রে সুস্পষ্টভাবে জেনোসাইড শনাক্ত করতে পেরেছেন এবং অপরাপর অভিযোগ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে সাব্যস্ত হয়েছে। হিন্দু ধর্মগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করার আক্রমণাভিযান জেনোসাইড হিসেবে চিহ্নিত করে আদালত তার কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টায় দ্বিজাতি তত্ত্বের ঘৃণার দর্শনের উল্লেখ করেছেন। এ ক্ষেত্রে হিংস্রতার মানস কীভাবে তৈরি হয়, মানবজাতির একাংশের বিরুদ্ধে জঘন্য ও অচিন্তনীয় হিংস্রতায় কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর মেতে ওঠার কার্যকারণ ও পদ্ধতি তলিয়ে দেখা সমাজের দায়িত্ব হিসেবে সামনে উঠে এসেছে।

বিচারকাজ এমনি আরও অনেক কর্তব্য আমাদের সামনে মেলে ধরেছে। গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনে যে ব্যাপক আয়োজন দরকার, রাষ্ট্রশক্তির সঙ্গে সমাজের একাংশের যৌথ যোগসাজশে যে এমনই ব্যাপক মাত্রার অপরাধ সংঘটিত হয়, সে অভিজ্ঞতা থেকে আন্তর্জাতিক আইনেরও অনেক প্রসারতা ঘটছে। তার প্রকাশ আমরা দেখি অপরাধের যৌথ দায়বদ্ধতা বা জয়েন্ট ক্রিমিন্যাল রেসপনসিবিলিটির ধারণায়। সাম্প্রতিক এই উপলব্ধি থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনে উদ্ভূত হয়েছে জয়েন্ট ক্রিমিন্যাল এন্টারপ্রাইজ বা জেসিইর ধারণা ও প্রয়োগ, অন্যান্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে সাম্প্রতিককালে যার স্বীকৃতি আমরা দেখতে পাই। অনেক সংস্থা ও ব্যক্তি মিলেই যে এমন ভয়ংকর অপরাধসমূহ সংঘটিত হয়, সেটার স্বীকৃতি মেলে এই ধারণায় এবং যৌথভাবে কৃত অপরাধে ব্যক্তির দায়বদ্ধতা থেকে রেহাই পাওয়ার সুযোগ আইনে রাখা হয়নি। সাকা চৌধুরীর বিচারকালে প্রসিকিউশনের যুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে, বাংলাদেশের ১৯৭৩ সালের আইনের অন্তর্নিহিত শক্তি ও ধারা, বিশেষভাবে ধারা ৪(১) অনুসারে, জেসিইর স্বীকৃতি মাননীয় আদালত প্রদান করেছেন তাঁদের রায়ে। আইনের শক্তির এই নতুন অর্জন ও বিকাশ জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে নন্দিত, পঠিত ও অধীত হওয়ার যোগ্য হয়ে আমাদের জন্য গৌরবজনক বিবেচিত হবে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন এবং আইন-সম্পর্কিত ধারণা এখন আরও নানা প্রসারতা অর্জন করছে। ড্যানিয়েল জোনাহ গোল্ডহাগেন তাঁর সাম্প্রতিক গ্রন্থ ওয়ার্স দ্যান ওয়ার-এ ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ অভিধার অস্পষ্টতা নিয়ে অস্বস্তি প্রকাশ করে বলেছেন যে প্রকৃতপক্ষে এই ধরনের অপরাধকে ‘মানবতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ হিসেবে চিহ্নিত করা উচিত, তাহলেই এর নিষ্ঠুরতা ও ভয়ংকরতা কিছুটা আঁচ করা যাবে। অন্যদিকে জেনোসাইডের সংজ্ঞা নিয়ে অস্বস্তি প্রকাশ করেছেন ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব জেনোসাইড স্কলার্স বা আইএজিএস-এর সভাপতি আর্জেন্টিনার ড্যানিয়েল ফেইরস্টাইন। তাঁর মতে, ৬০ লাখ ইউরোপীয় ইহুদি নিধনকে ধর্মগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে উৎখাত অভিযানস্বরূপ যখন ‘জেনোসাইড’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, তখন সেই ইহুদিরা যে জার্মান জাতির অঙ্গাঙ্গি অংশ ছিল, তা বিস্মৃত হয়ে নিধনকারীদের মতাদর্শ তথা জাতিসত্তার মধ্যে নানা বিভাজন আরোপের অংশী আমরা হয়ে উঠি। একই চিন্তা অনুসারে হিন্দু ধর্মগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আক্রমণাভিযানকে আমাদের দেখতে হবে বাঙালি জাতিসত্তা ধ্বংস এবং তা পাল্টে দেওয়ার প্রয়াস তথা জাতি-ধ্বংসের অংশ হিসেবে। সেই পটভূমিকায় দেখলে আমরা বুঝতে পারব আদালতে সাকা চৌধুরী যে নিজেকে বাঙালি বলতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন, তা কোনো মশকরা ছিল না, ছিল ঘাতক-মানসের উৎস সম্পর্কে ইঙ্গিত।

সাকা চৌধুরীর বিচার-কার্যক্রম বড় পরিসরে দেখার অনেক কারণ আমাদের রয়েছে। এই বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য দেশ-বিদেশে নানা অপপ্রচার চালাচ্ছে অভিযুক্ত পক্ষ, বুঝে না-বুঝে অনেক তরুণ সাংবাদিকও সেই খাতায় নাম লেখাচ্ছেন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের অবস্থান দ্বারা ট্রাইব্যুনালকে বিতর্কিত করার প্রয়াসে নিজেরাও বিতর্কিত হয়ে পড়ছে। বাংলাদেশে গণহত্যার বিচার-প্রক্রিয়া নিয়ে আন্তর্জাতিক মহল, তথা পশ্চিমা মহলে সন্দেহ ও অবিশ্বাস যা লক্ষ্যগোচর হয়, সেই মেঘ অপসারণে আমাদেরও দায় রয়েছে। ১৯৭৩ সালের আইনের শক্তিময়তা এবং চলমান বিচার-প্রক্রিয়ার আইনি পথানুসরণ ক্রমে যে আরও বেশি করে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করবে, সেই আস্থা রাখা যায়। এই আস্থার কারণ, চার দশক পর শুরু হওয়া বিচার ইমপিউনিটির অবসান ঘটিয়েছে, যা আইন প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক ও তাৎপর্যময় কর্তব্য। বিচারের সূত্রে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার প্রতি নতুন করে আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকৃষ্ট হচ্ছে এবং বিস্মৃতি থেকে জেগে উঠছে বিশ্বমানবের স্মৃতি। একেবারে হালের দুটি ঘটনার উল্লেখ এখানে করা যায়, বিগত ২৩ সেপ্টেম্বর সংখ্যায় নিউইয়র্কার পত্রিকায় পঙ্কজ মিশ্র-কৃত দুটি গ্রন্থালোচনার শিরোনাম ছিল ‘আনহোলি অ্যালায়েন্স: নিক্সন-কিসিঞ্জার অ্যান্ড দ্য বাংলাদেশ জেনোসাইড’। একাত্তরে মার্কিন প্রশাসনের ভূমিকার সমালোচনামুখর দুই গ্রন্থের সূত্রে ইতিহাসের পুনর্মূল্যায়ন দাবি করেছেন সমালোচক এবং সেই সূত্রে বাংলাদেশে মানবতার চরম অস্বীকৃতির বিপরীতে মার্কিন প্রশাসনের সমর্থনমূলক অবস্থানের কুফল মেলে ধরেছেন পরবর্তী ঘটনাধারার আলোকে।

১ অক্টোবর যেদিন সাকা চৌধুরীর মামলার রায় ঘোষিত হলো, সেদিনই নিউইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত হয়েছিল নিবন্ধ, প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গ্যারি বাস রচিত প্রবন্ধের শিরোনাম, ‘নিক্সন ও কিসিঞ্জারের বিস্মৃত লজ্জা’। নিবন্ধে ১৭ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টে কাদের মোল্লার মামলার রায় ঘোষণার কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ‘আমেরিকানদের কাছে এটা অনেক দূরবর্তী অথবা অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে, তবে বাংলাদেশের বর্তমান অস্থিরতার সঙ্গে আমেরিকার অনেক যোগ রয়েছে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সমস্যার কয়েকটি উদ্ভূত হয়েছে ১৯৭১ সালের নির্দয়া জন্মগ্রহণ থেকে, যখন রিচার্ড নিক্সন ও তাঁর নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশি জনমানুষের হত্যাকারী ও পীড়নকারীদের দৃঢ়ভাবে সমর্থন করেছিল।’

নিবন্ধের শেষে লেখা হয়েছে, ‘হিংসাত্মক রাজনীতির নিরসন বাংলাদেশ কীভাবে করবে সেটা তাদের ব্যাপার, তবে গোড়া থেকেই তাদের এই কর্তব্য দুরূহ করে তুলেছে নিক্সন-কিসিঞ্জারের কাঠিন্য। ১৯৭১ সালের জের যুক্তরাষ্ট্রের সুনামে কালিমা হয়ে রয়েছে। কিসিঞ্জারের কাছ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা যদি উঁচুমানের প্রত্যাশা হয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে আমেরিকানদের অন্তত স্মরণ করা উচিত, সেই ভয়ংকর দিনগুলোতে তিনি ও নিক্সন কী করেছিলেন।’

একাত্তরের সেই ভয়ংকর দিনগুলোতে মানবতার বিরুদ্ধে যুদ্ধকারী ও গণহত্যাকারী গোষ্ঠী এবং তাদের নেতৃস্থানীয়রা যা করেছিল, সেই বাস্তবতা স্মরণ করে বাংলাদেশের বিচার-প্রক্রিয়ার তাৎপর্য মেলে ধরা তাই অপরিসীম গুরুত্ববহ। আন্তর্জাতিকভাবে বিচারের সমর্থনে গণতান্ত্রিক রাজনীতির মতপার্থক্য নির্বিশেষে সবার সক্রিয় সমর্থন যেমন জরুরি, তেমনি প্রয়োজন বিচার-প্রক্রিয়া থেকে উঠে আসা বিভিন্ন প্রশ্নে সামাজিক ভূমিকা পালন। শহীদের প্রতি দায়বদ্ধতা বাস্তবে রূপায়িত করা তাই আজকের চ্যালেঞ্জ। এ ক্ষেত্রে বিচার-প্রক্রিয়া আমাদের বড় অবলম্বন ও বিশাল শক্তি হিসেবে দেখা দিয়েছে।

মফিদুল হক: লেখক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।