খবরটি খুব আকস্মিক ছিল এমন বলা যাবে না। তিনি দীর্ঘদিন বয়সের বিপরীতে বিভিন্ন অসুস্থতা নিয়ে লড়ছিলেন। তবে যখন এল তখন ব্যাপারটি আকস্মিকই মনে হলো। এমনটা তো আমরা চাইনি কিংবা ভাবিনি। তবে নিষ্ঠুর প্রকৃতি চলে আপন নিয়মে।
জীবনের সব দিক দিয়ে সফল জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান পরিণত বয়সেই প্রয়াত হয়েছেন। তিনি কয়েক হাজার ছাত্রের সরাসরি শিক্ষক ছিলেন। আর তাঁর সময়কার বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য ছাত্রদেরও তিনি প্রকৃতপক্ষে ছিলেন শিক্ষকই। তিনি সামান্য পরিচয়েই যে কাউকে আপন করে নেওয়ার সহজাত গুণাবলি রপ্ত করে নিয়েছিলেন। ‘স্যার’ শব্দটা ভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহার হলেও প্রধানত এর ব্যবহার ছাত্র–শিক্ষকের। আর তিনি কত হাজার মানুষের স্যার ছিলেন, এর হিসাব কেউ করতে পারবেন না। তাদের অনেকেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনোভাবেই তাঁর ছাত্র ছিল না। এ ব্যাপারে তাঁরই দীক্ষাগুরু প্রয়াত মনিষী অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে একত্রে ভারত ভ্রমণ প্রসঙ্গে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ বিপুলা পৃথিবীতে লিখেছেন। ত্রিবান্দ্রমের এক সভা। সেখানে পণ্ডিতদের সমাবেশে দুজনই সমাদৃত হলেন। মূল উদ্যোক্তা, রাজ্জাক সাহেবকে পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে বলেন, ‘ঢাকায় নাম না করে শুধু স্যার বলতে আব্দুর রাজ্জাককেই বোঝায়। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান আমাকে বলেছেন যে তাঁর শাশুড়ি যিনি কখনো কোনো স্কুলেই যাননি, তিনিও ওঁকে স্যার বলে সম্বোধন করেন।’ স্যার সম্বোধনে আনিসুজ্জামান তাঁর দীক্ষাগুরুকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন কি না, বলতে পারছি না। তবে খুব যে পেছনে ছিলেন না, এটা বিনা দ্বিধায় বলা চলে।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান সমকালীন সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিলেন। মেধাবী সফল ছাত্র। ২২ বছর বয়সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক। ছাত্রজীবনে ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের মাধ্যমে সম্পৃক্ততা। তারুণ্যেই তিনি দেশের প্রগতিশীল রাজনীতিকদের কাছে পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ হন। ডক্টরেটও করেন ঢাকায়। তবে পোস্ট ডক্টরেট করার সুযোগ পান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ১৯৬৯ সালে তিনি ঢাকা ছেড়ে চলে যান নব প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। সে বছরেই আমি সেখানে ভর্তি হই। তবে ভিন্ন বিষয়ে। তখন প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার ফলে তাঁর কিছুটা সাহচর্যের সুযোগ পাই। তবে এটাকে ঘনিষ্ঠ বলা যাবে না। সেটা যা–ই হোক, তিনি যখন যেখানে যেটা বলতেন, সেটা গ্রহণ না করলেও মন্ত্রমুদ্ধের মতো শুনতে হতো। আর এটা সম্ভব হয়েছিল তাঁর অনবদ্য শব্দচয়ন ও বাঁচনভঙ্গির জন্য। অল্প সময়ে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্বিবিদ্যালয়ের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিতে থাকেন। আর সেটা একটি তাৎপর্যপূর্ণ রূপ নেয় মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে। আনিসুজ্জামানের ন্যায় কিছু তরুণ শিক্ষকের অদম্য দেশপ্রেম অন্য প্রায় সব শিক্ষককে অনুপ্রাণিত করেছিল এ যুদ্ধে অংশ নেওয়ার। ভারতের কলকাতায় গিয়েও তিনি হলেন বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক। আর্থিক বিপর্যয়ে পড়া শিক্ষকদের সহায়তা করতে তিনি সচেষ্ট ছিলেন। গভীরভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে। একটু বাম ঘরানার রাজনীতিতে বিশ্বাসী অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তখনকার কোনো কোনো প্রভাবশালী মহলের দৃষ্টিতে একটু বিরাগভাজন হলেও তাঁর অগ্রযাত্রা থেমে যায়নি।
স্বাধীনতার পরপরই আবার ফেরেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। পাশাপাশি বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নসংক্রান্ত গণপরিষদের কার্যক্রমের সঙ্গে হন যুক্ত। তাঁর নেতৃত্বে গঠিত কমিটির দায়িত্ব ছিল সংবিধানের বঙ্গানুবাদ। তা করতে গিয়ে তিনি অতি ঘনিষ্ঠ হন তখনকার আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন এবং প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর। এরপর তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজের পাশাপাশি বিলেতের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের (সোয়াস) সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে কোম্পানি আমলের কিছু দলিলপত্র অনুবাদ ও নথিবদ্ধ করতে সহায়তা করেন। জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে বিভিন্ন সেমিনারে গেছেন দেশ–দেশান্তরে। বঙ্গবন্ধুর শাসনকালে গঠিত শিক্ষা কমিশনসহ বহু কমিশন, কমিটিতে তিনি স্থান পেয়েছিলেন। তাঁর জীবনীগ্রন্থ মতে, সরকারের সচিব পদে তাঁকে নিয়োগ দিতে বঙ্গবন্ধু খুব আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু তিনি শিক্ষকতার বাইরে কিছু করতে আদৌ আগ্রহী ছিলেন না। এ প্রসঙ্গে তাজউদ্দীন বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, আনিসুজ্জামানকে সচিব করা হলে দেশ একজন ভালো শিক্ষককে হারিয়ে মন্দ প্রশাসক পাবে। তখনকার মতো সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখেন বঙ্গবন্ধু। তরুণ বয়স থেকে কর্মমুখর এক জীবনকে তিনি বেছে নিয়েছিলেন। মেধার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তাঁর অনুশীলন।
শিক্ষকতা ও গবেষণার পাশাপাশি তিনি প্রসারিত করেছিলেন তাঁর কর্মস্থলকে সব ধরনের প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে। তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় সম্পৃক্ত ছিলেন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সঙ্গে। মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলায় ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী। সত্তরের দশকে রবীন্দ্রবিরোধী প্রচারণার বিপরীতে ছিল তাঁর সোচ্চার অবস্থান। নিজের কর্মক্ষমতার ওপর ছিল তাঁর অবিচল আস্থা। কিন্তু এ আস্থা তাঁকে উদ্ধত করেনি। করেছিল প্রত্যয়ী। তিনি যে এ দেশের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ, এটা অনুধাবন করতেন ভালোভাবে। যেমন আমরা দেখি তাঁর প্রথম জীবনীগ্রন্থকাল নিরবধির পূর্বাভাসে উল্লেখ করেছেন, ‘পাঠকের কাছে যদি আমার স্মৃতিকথার কোনো প্রাসঙ্গিকতা থাকে, তা এ জন্য যে আমি প্রচুর তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার সাক্ষী এবং বহু বিশিষ্ট ব্যক্তির সাহচর্যধন্য। যে পরিবেশ–পরিপ্রেক্ষিতে “আমি” হয়ে উঠেছি, সে সম্পর্কে জানানোর সঙ্গে সঙ্গে তাই আমি অন্য অনেকের এবং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কথা বলতে চেয়েছি।’ তাঁর ‘আমি’ হয়ে ওঠার উপলব্ধি দেশের জন্য কল্যাণকরই হয়েছে। একটি যুগ সমাপ্ত হলো তাঁর বিদায়ে।
ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে কিছু বিষয় এখানে আসবে। সূচনায় আমি তাঁর খুব ঘনিষ্ঠ না থাকলেও সময়ান্তরে হয়ে যাই। তবে আমার অনুজ হাসান ইমাম ছিল তাঁর সরাসরি ছাত্র। সে ছাত্রের বিয়ের অনুষ্ঠানে তিনি যোগ দিয়েছিলেন চট্টগ্রাম থেকে কুমিল্লায় এসে। এতে আমরা গোটা পরিবার হই আপ্লুত। আবার কালের পরিক্রমায় সে ছাত্রের দুই কন্যার বিবাহ অনুষ্ঠানেও তাঁর ছোঁয়া ছিল। বড় জনের বিয়েতে দেশে না থাকায় তাঁর স্ত্রী প্রতিনিধিত্ব করেন স্যারকে। আর ছোটজন ভিন্ন বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁরই সহকর্মী। এখন সহকারী অধ্যাপক এবং লন্ডনে কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে অধ্যয়নরত। এর বিবাহ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন স্বস্ত্রীক। এসব উপস্থিতি আমাদের পরিবারকে দিয়েছে একটি বিশেষ মর্যাদা। এ অনুষ্ঠানগুলোতে গণ্যমান্য লোকের উপস্থিতির ঘাটতি ছিল না। পদ–পদবিতেও জাঁকাল ছিলেন অনেকে। সবাইকই নিয়ে আমরা গৌরব বোধ করি। তবে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের উপস্থিতি ছিল নজরকাড়া ও অনন্য। বিষয়গুলো আমাদের পারিবারিক স্মৃতির অ্যালবামকে করেছে সমৃদ্ধ।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সঙ্গে দেখা হতো বিভিন্ন সভা–সমিতিতে। আমি তেমন একটা কেউ না হলেও তিনি সঙ্গীদের কাছে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতেন বড় মুখ করে। ১১ বছরের আমার অবসর জীবনকালে সাধারণত সপ্তাহে এক দিন দুপুরের দিকে ঢাকা ক্লাবে যাওয়া হয় কাজে ও অকাজে। তখন যাঁদের দেখতাম তাঁরা ক্রমান্বয়ে একে একে চলে যাচ্ছেন। ফারুক চৌধুরী, সৈয়দ শামসুল হক, জগলুল চৌধুরী ও বেহরুজ ইস্পাহানী চলে গেছেন। এবারে একটি ভূমিকম্পের মতো ভিত কাঁপিয়ে গেলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। আমি ভুলতে পারি না তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়কার ২০০৮ সালের জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের কথা। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান রবীন্দ্র স্মারক বক্তা। দীর্ঘ বক্তব্য হলো পিনপতন নীরবতায়। শেষ হলো টের পেলাম পাশের একজন পদস্থ কর্মকর্তার কথায়। সে কর্মকর্তা বলছিলেন এরপর তো আর গান শুনতেও ভালো লাগবে না। সত্যি ব্যাপারটি তাই ছিল। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের বক্তৃতার পর অনেক ক্ষেত্রে নিষ্প্রাণ হয়ে যেত গান। তিনি আমাদের ছেড়ে পরলোকে। কামনা করি থাকুন তিনি চির শান্তিতে।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
majumderali1950@gmail.com