প্রথম আলোতে কলেজের অধ্যক্ষ–সংকট নিয়ে একটি খবর প্রকাশিত হয়েছিল। এতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিবের মতামতও ছিল। তিনি প্রতিবেদনে প্রকাশিত বক্তব্যের সত্যতা স্বীকার করেছেন। বলেছেন কাজ চলছে। অক্টোবরের মধ্যে নিয়োগ হয়ে যাবে। শুধু অধ্যক্ষ নয়, ২৮টি কলেজে উপাধ্যক্ষ পদও শূন্য রয়েছে।
একটি কলেজে অধ্যক্ষ না থাকলে প্রতিষ্ঠানটি নেতৃত্বসংকটে ভোগে। অধ্যক্ষ তাঁর সহকর্মীদের কাজ তদারক করেন। তিনি প্রশাসনিক ও আর্থিক বিষয়াদির দায়িত্বেও থাকেন। জানা গেল, ১ হাজার ৮০০ ছাত্রের একটি কলেজে অধ্যক্ষ নেই প্রায় এক বছর। সে কলেজে উপাধ্যক্ষের পদও নেই। একজন সহকারী অধ্যাপক অধ্যক্ষের দায়িত্বে আছেন। ৩৪ জন শিক্ষকের মধ্যে ১০টি পদ শূন্য। সে ক্ষেত্রে কলেজটি কেমন চলছে, তা সহজেই বোধগম্য।
নেতৃত্ব ছাড়া সংগঠন হয় না। আর সে নেতৃত্বের সঙ্গে কিছু কর্তৃত্বও থাকে। নিয়মিত অধ্যক্ষের অনুপস্থিতিতে কোনো একজনকে দায়িত্ব দেওয়া হলেও কর্তৃত্ব প্রয়োগে তিনি কিছুটা সংশয়ে থাকবেন। নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রেও থাকবে ফাঁক। আর্থিক বিষয়াদির নিষ্পত্তিতে একটু অনাগ্রহী হওয়াও অস্বাভাবিক নয়। ছাত্রসংগঠনগুলোর, বিশেষ করে সরকার সমর্থক ছাত্রসংগঠনের নেতা–কর্মীদের সামাল দেওয়াও যেকোনো অধ্যক্ষের জন্য একটি দুরূহ কাজ।
এমনিতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ অন্য সব ক্ষেত্রের মতো শিক্ষাব্যবস্থাকেও পর্যুদস্ত করে ফেলেছে। এর অবসানে কীভাবে হারানো সময়ের ক্ষতি পোষানো যায়, তার একটি ছকও একজন অধ্যক্ষ তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে করে রাখতে পারেন। কেউ কেউ হয়তো করেছেনও। তবে যেখানে নিয়মিত অধ্যক্ষ নেই, সেখানে এমনটা আশা করা যথার্থ হবে না। এ শূন্যতা সৃষ্টির পেছনে প্রথম আলোর অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি অনুসারে কারণ মূলত ঢিলেমি। সে ক্ষেত্রে বলতে হবে ব্যাপারটি শুধু দুঃখজনক নয়, অগ্রহণযোগ্যও বটে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, দেশে সরকারি কলেজের সংখ্যা ৬৩২। এর মধ্যে পুরোনো ৩২৯টি। আর ২০১৮ সালে জাতীয়করণ হয় ৩০৩টি। হালে জাতীয়করণ করা কলেজগুলোসহ অধিকাংশ কলেজ সরকারি কলেজে রূপান্তরিত করার ক্ষেত্রে তেমন কোনো পরিকল্পনা ছিল না। ১৯৭৫ সালের পর দুজন সামরিক শাসক তাঁদের বেসামরিক ক্ষমতাবলয়কে প্রসারিত করার চেষ্টা হিসেবে বিভিন্ন সফরে গিয়ে রাস্তার পাশে জমায়েত জনগণ ও তাঁর সমর্থক নেতাদের অনুরোধে একটার পর একটা কলেজ সরকারি করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং তা বাস্তবায়ন করেছেন। কাছাকাছি একাধিক কলেজও সরকারি হয়ে গেছে। বেসরকারি কলেজশিক্ষকেরা রাতারাতি সরকারি কলেজশিক্ষকের মর্যাদা পান। একটি নীতিমালার আওতায় তাঁদের জ্যেষ্ঠতা ও বেতন নির্ধারণের ব্যবস্থা করা হয়। এবার জাতীয়করণ করা কলেজগুলোও প্রয়োজনীয়তা নির্ধারণে স্থানীয় রাজনীতির মূল নিয়ামক ছিল। যাহোক যেহেতু সরকারি কলেজ হয়ে গেছে, এখন পরিচালনার সামগ্রিক দায়িত্ব সরকারের। সেখানে শিক্ষক পদ খালি পড়ে থাকলে শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হয়।
দেশের ৬৩২টি সরকারি কলেজে কয়েক লাখ ছাত্রছাত্রী শিক্ষা নিচ্ছে। আমাদের আর্থিক সীমাবদ্ধতা এগুলোকে পরিপূর্ণ সুন্দরভাবে চালানোর ক্ষেত্রে কোথাও কোথাও অন্তরায় হতে পারে। তবে পড়ানোর জন্য থাকবেন না শিক্ষক আর পরিচালনার জন্য ঘাটতি হবে অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষের, এমন হওয়ার কথা নয়। সরকার তার সামর্থ্যের দিক বিবেচনায় নিয়েই ২০১৮ সালে ৩০৩টি বেসরকারি কলেজকে সরকারি করে
বর্তমান নীতিমালা অনুসারে অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ হতে হলে অনলাইনে আবেদন করতে হয়। মন্ত্রণালয়ের একটি কমিটি যাচাই–বাছাই করে তালিকা চূড়ান্ত করে। সে তালিকা থেকে করা হয় পদায়ন। কোন কলেজের অধ্যক্ষ পদ কবে খালি হবে, তা দু–একটি বিরল ব্যতিক্রম ছাড়া আগেভাগেই জানা যায়। অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষ তালিকাও তৈরি করে রাখা সম্ভব। শূন্য পদের বিপরীতে সে তালিকা থেকে পদায়ন করলে পদ শূন্য থাকার কথা নয়। প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে, তালিকা প্রণয়নে রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত প্রীতিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এ অবস্থাটা এখন সর্বত্র বিরাজমান। তাই সরকারি কলেজের এসব পদের ক্ষেত্রে ভিন্ন কিছু হবে, এমনটা আশা করছি না। তবে তালিকাটা সময়মতো হবে না কেন? এর কোনো গ্রহণযোগ্য জবাব কারও কাছে নেই।
জানা যায়, অনুমোদিত পদে ১৮ শতাংশ শিক্ষকের পদও শূন্য রয়েছে কলেজগুলোতে। এর সংখ্যা ২ হাজার ৮৭৮টি। বড় শহরের বড় কয়েকটি কলেজ ছাড়া বেশির ভাগ সরকারি কলেজই শিক্ষক–সংকটে ভুগছে। শূন্য পদগুলো পূরণের যে সনাতনী ব্যবস্থা তা এভাবে বহন করতে পারছে না। শিক্ষক নিয়োগের জন্য পৃথক সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) করার রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছিল এ সরকারের। এখন দেখা যাচ্ছে বর্তমান পিএসসি থেকেই আরও ভারাক্রান্ত করে ফেলা হচ্ছে। অবশ্য এ পরিমাণ শূন্য পদের চাহিদা পিএসসিকে জানানো হয়েছে কি না, এটা প্রতিবেদনে উল্লেখ নেই। সাধারণ ক্যাডারগুলো ছাড়া সব বিশেষায়িত ক্যাডারে নিয়োগের জন্য একটি অধিকতর সহজ প্রিলিমিনারি পরীক্ষার পর মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে নিয়োগ দেওয়া চলে। তাঁদের ছাত্রজীবনের ফলাফলকেও বিবেচনায় নেওয়া যায়। অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও সহকারী অধ্যাপকদের শূন্য পদ পূরণের ব্যবস্থাও বিধিনির্ধারিত পদ্ধতিতে অগ্রসর হলে তেমন সময় নেওয়ার কথা নয়।
প্রতিবেদনে মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের একটি সূত্রকে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, কলেজগুলোতে আরও সাড়ে ১২ হাজার নতুন শিক্ষক পদ সৃজনের একটি প্রস্তাব বেশ কিছুকাল ঝুলে আছে, নিষ্পত্তি হচ্ছে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করলে ছাত্র আসবে। আর তাদের পড়াতে হবে শিক্ষকদের। কোন ক্ষেত্রে কতজন শিক্ষক আবশ্যক, তা নির্ধারণের একটি স্বীকৃত মানদণ্ড আছে। সে মানদণ্ড অনুসারে নতুন পদগুলোর মঞ্জুরি এবং এসব পদের বিপরীতে আশু নিয়োগ দেওয়াও দরকার। নতুন পদ সৃজনের ক্ষেত্রে আমাদের শাসনব্যবস্থায় এ ধরনের কালক্ষেপণের মন্দ নজির রয়েছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় যেভাবে চাইবে, সেভাবেই সব করা যাবে না। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, অর্থ বিভাগ এবং প্রশাসনসংক্রান্ত সচিব কমিটির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে এ বিষয়ে। তাদের কিছুটা রক্ষণশীল হতে হয়। তবে যেখানে যৌক্তিক প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, সেখানে হাত গুটিয়ে বসে থাকাও অসংগত। অথচ সে অভিযোগই আসছে।
দেশের ৬৩২টি সরকারি কলেজে কয়েক লাখ ছাত্রছাত্রী শিক্ষা নিচ্ছে। আমাদের আর্থিক সীমাবদ্ধতা এগুলোকে পরিপূর্ণ সুন্দরভাবে চালানোর ক্ষেত্রে কোথাও কোথাও অন্তরায় হতে পারে। তবে পড়ানোর জন্য থাকবেন না শিক্ষক আর পরিচালনার জন্য ঘাটতি হবে অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষের, এমন হওয়ার কথা নয়। সরকার তার সামর্থ্যের দিক বিবেচনায় নিয়েই ২০১৮ সালে ৩০৩টি বেসরকারি কলেজকে সরকারি করে। এ ধরনের অবহেলার কারণে সরকারি কলেজগুলোতে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হওয়া কোনো যুক্তিতেই মেনে নেওয়া যায় না।
● আলী ইমাম মজুমদার সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
majumderali1950@gmail.com