প্রাইস ট্যাগ

২০১৩-১৪–এর কথা। জুন মাসের এক বিকেল। আগোরায় নানা ধরনের ফ্রেশ জুস পাওয়া যেত তখন। গ্লাসে ভরা জুস, সব কটিরই দাম এক শ টাকার আশপাশে। কেবল মাল্টার একটা জুস ছিল, যার প্রাইস ট্যাগে পরিষ্কারভাবে লেখা ২৫০। মাল্টা আমার প্রিয় ফল নয়, তারপরও কেন যেন ওটার দিকেই হাত বাড়িয়েছিলাম। 

একটা ছেলে দাঁড়িয়ে ছিল পাশেই। খুকখুক করে একটু কেশে নিয়ে বলল, স্যার, এটার প্রাইস কিন্তু আড়াই শ টাকা। 

থমকে দাঁড়ালাম। আল্লাহ আমাকে দুটো চোখ দিয়েছেন এবং সে চোখগুলো কখনো বেইমানি করেনি। জুসের গায়ে কত দাম লেখা, পরিষ্কার দেখতে পেয়েছি। তারপরও ছেলেটা এ কথা কেন বলল? তার চোখের দিকে তাকালাম। সে চোখে পরিষ্কারভাবে লেখা, জুসের গ্লাস তো হাতে নিলা, এখন আড়াই শ টাকা দাম দিতে পারবা? 

মনে হলো, দুটো জুস কিনি। এক গ্লাস নিজে খাব। আর একটা জোর করে ওকে খাওয়াব। কিন্তু সেসবের কিছুই করলাম না। গ্লাসটা রেখে বাইরে বেরিয়ে এলাম। একটা সিগারেট ধরিয়ে তাকালাম উল্টো দিকের কাচে। নিজেকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে সেখানে। নিজেরই প্রতিবিম্ব, অথচ সে হুংকার দিচ্ছে, দেখো...এই লোকটাকে দেখো...সাতাশ বছরের প্রকাণ্ড এক মানুষ। রোদ্দুরে তার ছায়া পড়েছে। পরনে ডিপ ব্লু জিনস, হালকা পেঁয়াজ রঙের হাফহাতা শার্ট, পায়ে ছাইরঙা অ্যাপেক্স স্যান্ডেল। মোটামুটি ভালোই পোশাক-আশাক। তবু তাকে দেখে মনে হয়, পকেটে আড়াই শ টাকা নেই।

এ রকম ঘটনা প্রায়ই ঘটে আমার সাথে। ২০১৫ সালে অফিসের একটা ওয়ার্কশপে ব্যাংকক যেতে হয়েছিল। ঢাকা এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশন পার হয়ে গেছি। দাঁড়িয়ে আছি ৭ নম্বর গেটের সামনে, কিছুক্ষণের মধ্যেই বোর্ডিং শুরু হবে। সাথে দুজন কলিগ। নওশিন আর মনুজেশ। তখনো নওশিনের সাথে আমার প্রেম বা বিয়ে কিছুই হয়নি। 

এয়ারলাইনসের একজন সিনিয়র অফিসার এগিয়ে এলেন আমাদের দিকে। নওশিনকে বললেন, এক্সকিউজ মি ম্যাম, বিজনেস ক্লাসের দুটো সিট খালি যাচ্ছে। আপনাদের টিকিটগুলো বিজনেস ক্লাসে আপগ্রেড করে দিই? 

প্রথমে বুঝে উঠতে পারলাম না তিনি কী বলছেন। হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম। অফিসার আবারও বললেন, এটা আমাদের রেগুলার প্র্যাকটিস। সিট খালি থাকলে ইকোনমি প্যাসেঞ্জারদের মধ্য থেকে বেছে বেছে কয়েকজনকে বিজনেস ক্লাসে আপগ্রেড করি। 

নওশিন বলল, তাহলে তো খুবই ভালো হয়। 

আপনারা আসুন আমার সাথে, বলে অফিসার সামনে এগোতে শুরু করলেন। 

আমরা তিনজন তার পিছু নিলাম। গেটের কাছে এসে অফিসার ঘুরলেন আমাদের দিকে। একটু বিস্মিত হয়ে আমাকে দেখলেন কিছুক্ষণ। তারপর আমতা–আমতা করতে লাগলেন। 

মনুজেশ বলল, কোনো সমস্যা? 

অফিসার বললেন, না আসলে হয়েছে কি, আমি ভেবেছিলাম আপনারা দুজন। এখন তো দেখছি তিনজন। বিজনেস ক্লাসে আমাদের দুটো সিট খালি আছে। 

স্পষ্টতই সমস্যাটা আমাকে নিয়ে। এ অবস্থায় বলতেই হয়, নওশিন, তোমরা দুজন গিয়ে বসো। আমি ইকোনমি ক্লাসেই চলে যাব। 

নওশিন সাথে সাথেই বলল, তা হয় না। তিনজন একসাথে যাচ্ছি। আলাদা আলাদা বসতে পারব না। 

ফিরে এসে আমরা আবার ইকোনমি ক্লাসের লাইনে দাঁড়ালাম। এবং এ ঘটনার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে আমি নওশিনের প্রেমে পড়ে গেলাম। 

প্রেম হয়ে যাওয়ার পর লক্ষ করলাম, নওশিন বরাবরই আমার পক্ষ নিয়ে কথা বলে। এমন না যে এই পক্ষ নেওয়ার কোনো দরকার আছে, তবু নেয়। কারণ, সে আমাকে ভালোবাসে। আমার মতো একজন লুজারের পক্ষে ভালোবাসা পাওয়া সহজ নয়। এই দুর্লভ বস্তু কী করে পেলাম, জিজ্ঞেস করবেন না। জানি না। শুধু এটুকুই বলতে পারব, হয়ে গেছে। 

ছোটবেলায় জ্যামিতি পড়েছেন সবাই। সেখানে সম্পূরক কোণ বলে একটা জিনিস ছিল। একটা কোণ আর একটা কোণ মিলে ১৮০ ডিগ্রি হয়। সে জন্য ওদেরকে বলে সম্পূরক কোণ। 

একটা কোণ যদি ৮০ ডিগ্রি হয়, তবে আর একটা কোণকে অবশ্যই ১০০ ডিগ্রি হতে হবে। নওশিন হলো ১৭৯ ডিগ্রির একটা মেয়ে। সুতরাং ওর দরকার ছিল আমার মতো ১ ডিগ্রির একজনকে। এর চেয়ে বেশি হলে মাপে বড় হয়ে যেত। ১ ডিগ্রির বেকুব পৃথিবীতে একজনই মাত্র অবশিষ্ট ছিল। সে হলাম আমি। সুতরাং প্রেম না হয়ে আমাদের উপায় ছিল না। 

নওশিনের ধারণা, আমার প্রাপ্যটুকু পৃথিবী ঠিকঠাক বুঝিয়ে দিচ্ছে না। নানাভাবে ঠকাচ্ছে। সারা দুনিয়ার মানুষ হাঁ করে বসে আছে আমাকে ঠকানোর জন্য। আরও ডিটেইলে যেতে হলে দু–একটা ঘটনার কথা বলতে হবে। 

একবার ওর মায়ের সেলফোন হঠাৎ ফ্রিজ হয়ে গেল। আমার বাসা তখন শান্তিনগর। পাশেই টুইন টাওয়ার শপিং কমপ্লেক্স। সেখানে বেশ কয়েকটা মোবাইল সার্ভিস শপ আছে। সুতরাং মোবাইল ঠিক করানোর দায়িত্বটা আমার কাঁধে এসে পড়ল। 

এক শুক্রবারে মোবাইল নিয়ে গেলাম পরিচিত এক দোকানে। যে ছেলেটা ওখানে বসে সে বলল, ভাইয়া, একটু বসেন, এক কাপ চা খান। আমি ঠিক করে দিচ্ছি। 

সে ঠিক তিন ঘণ্টা সময় নিল। কখনো ব্যাটারি খোলে, আর একটা ব্যাটারি লাগায়। কখনো অন্য একটা টাচ স্ক্রিন লাগিয়ে দেখে কাজ করছে কি না। একসময় ছেলেটা বলল, ভাইয়া, ঠিক হয়ে গেছে। 

উল্টেপাল্টে দেখলাম, আসলেই তাই। ছেলেটা অনুরোধ করল, ভাইয়া, আমাকে আরও ৩০ মিনিট সময় দেবেন? একটু দেখতে চাই, ব্যাটারি চেঞ্জ না করে অরিজিনাল ব্যাটারিটাই রেখে দেওয়া যায় কি না। 

বললাম, দেখ। 

আরও দুই ঘণ্টা ৩০ মিনিট সেখানে বসে রইলাম। দেখলাম, পুরোনো ব্যাটারিটাই ঠিকঠাক কাজ করছে। সব মিলিয়ে বিল এসেছে পনেরো শ টাকা। আমি নিশ্চিত, ইস্টার্ন প্লাজার কোনো দোকানে যদি যেতাম, গলায় ছুরি চেপে পাঁচ হাজার টাকা হাতিয়ে নিত। 

পরদিন অফিসে গিয়ে ফোনটা দিতেই নওশিন জিজ্ঞেস করল, কত টাকা বিল আসছে? 

পনেরো শ টাকা বলতে ভয় হলো আমার। বললাম, নয় শ টাকা। 

নওশিন চুপ মেরে রইল। এই চুপ থাকার অর্থ আমি জানি। ও মনে মনে ভাবছে, আহারে ছেলেটাকে বোকা পেয়ে কী বাড়িটাই না মারল দোকানদার! 

মনে মনে বললাম, নওশিন, ছেলেটা পুরো সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা ব্যয় করেছে। ওর এই চেষ্টাটা যদি দেখতে, আমি নিশ্চিত যে তুমি ওকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে আসতে। কাজটার দাম হয়তো পনেরো শ টাকা। কিন্তু মূল্য অনেক বেশি। 

দাম এবং মূল্যের মধ্যে বেসিক কিছু পার্থক্য আছে। ঠেকে শিখেছি। প্রাইস ট্যাগে যে দাম লেখা থাকে, মূল্য কখনো কখনো তার চেয়ে অনেক বেশি হয়। আরেকটা ঘটনার কথা বললে হয়তো পরিষ্কার হবে। 

আমাদের রিলেশনের বয়স তখন প্রায় এক বছর হতে চলেছে। জুলাই মাসের ৯ তারিখ নওশিনের জন্মদিন। ওকে গিফট দিতে হবে। কী দেব ভেবে পাচ্ছিলাম না। ওর ছোট বোনের নাম নওরিন। একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে নওরিনকে ফোন দিলাম। সে বলল, আপু পার্ল সেট খুব পছন্দ করে। 

আমি ভাবলাম, পারফেক্ট। সোনার জিনিসপত্র দেওয়াটা আমার রুচির সাথে যায় না, খ্যাত লাগে। পার্লই ভালো। কিন্তু সমস্যা মিটল না। ওগুলো কোথায় পাওয়া যায়, সে সম্পর্কে কিছুই জানি না। নওরিনকে আবারও ফোন দিলাম। অনুরোধ করলাম, আমাকে একদিন সময় দিতে। সে জানাল, সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা সামনে। এখন তার মরারও সময় নেই। 

গুগলই ভরসা। ঘাঁটাঘাঁটি করলাম দুই দিন। অবশেষে অনলাইন শপ থেকে একটা পার্লের সেট অর্ডার করলাম। নওশিন খুবই খুশি হলো গিফট পেয়ে। 

কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। কোনো এক অসতর্ক মুহূর্তে তাকে দামটা বলে ফেললাম। নওশিন আমার দিকে খানিকক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে রইল। নিশ্চিতভাবেই ভাবছে, ছেলেটা এত বোকা কেন? এত দাম দিয়ে কেউ এই জিনিস কেনে! 

আমি হয়তো অনেক দাম দিয়ে একটা জিনিস কিনেছি। কিন্তু এর মূল্য আমার কাছে আরও বেশি। চারটি দিন এই জিনিসটার পেছনে দিয়েছি। সুতরাং টাকার অঙ্কে এর মূল্য নির্ধারণ করা যাবে না। 

আরেকবার একটা বোকামি করেছিলাম। আমাদের বিয়ের ঠিক ছয় মাস আগে। নওশিনের মতে, সেটাও বড় ধরনের বোকামি। 

একবার অফিসের আড্ডায় এক মিউজিশিয়ান এল। ছেলেটা গিটার বাজিয়ে গান করল পুরোটা সন্ধ্যা। নওশিন মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল। একটু হিংসা হলো আমার। সংগীত হলো এমন এক জিনিস, যা কোনো সীমানা মানে না। সরাসরি মনের দরজা ভেঙে ঢুকে যায়। স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম, আমার হবু বউয়ের ছেলেটাকে খুব পছন্দ হয়েছে। 

ঠিক করলাম, গিটার বাজানো শিখতে হবে। বিয়ের আগে টুকটুক করে গোপনে গিটারটা শিখে নেব। বেসিকটুকু হাতে–কলমে শেখার জন্য একজন মাস্টার রাখব। মাসখানেক লাগবে হয়তো। এরপর ইউটিউব দেখে বাড়িতে বসে হাত পাকাব। মাস ছয়েক পরে যখন আমাদের বিয়ে হবে, তখন আমি ওকে গিটার বাজিয়ে চমকে দেব। 

ফেসবুকে পুরোনো জিনিস কেনাবেচা করার সাইটে গিয়ে দেখলাম, তারেক নামে একজন একটা গিটার বিক্রি করবে। সিগনেচার টোপাজ ২৬৫ অ্যাকুয়াস্টিক গিটার। তাকে নক করলাম। বললাম, গিটারটা কিনতে চাই। 

ছেলেটার বাসা মালিবাগ। এক সন্ধ্যায় অফিস শেষ করে ওর বাসায় চলে গেলাম। তারেক আমাকে গিটারটা দেখাল। একটা তার ছেঁড়া। কৌশলে স্কচটেপ মারা। সেখানেই শেষ নয়। টিউনিং কিগুলোর একটা ভাঙা, সুপার গ্লু দিয়ে জোড়া দেওয়া। 

নিজেকে বোঝালাম, ঠিক আছে। ভাঙাচোরায় সমস্যা কী? আমি কী এমন মহান গিটারিস্ট হব যে একদম ফিটফাট জিনিসই লাগবে? দাম জিজ্ঞাসা করলাম। 

ছেলেটা লাজুক মুখে বলল, আপনিই বলেন ভাইয়া। 

আমি পড়ে গেলাম বিপদে। কী দাম বলব! টের পাচ্ছিলাম, এই গিটারটা তার অনেক আদরের। নিদারুণ অর্থকষ্টে পড়েছে। তাই বিক্রি করতে চাচ্ছে। দুম করে বলে বসলাম, পাঁচ হাজার টাকা। 

ছেলেটা চমকে উঠল। হয়তো পাগল ভাবল আমাকে। 

এই কদিন অনলাইনে ঘাঁটাঘাঁটি করে জানি, নতুন অবস্থায়ই এ ধরনের গিটার পাওয়া যায় সাড়ে চার হাজার টাকায়। সেকেন্ড হ্যান্ডের দাম বড়জোর দেড়–দুই হাজার হবে। তারপরও পাঁচ হাজার বললাম। কারণ আমি জানি, এর সাথে জড়িয়ে আছে ওর মিউজিশিয়ান হওয়ার স্বপ্ন এবং সেই স্বপ্ন ভাঙার গল্প। দেড় হাজার কী করে বলি? 

যা বলছিলাম এতক্ষণ, দাম এবং মূল্যের মধ্যে বেসিক কিছু পার্থক্য আছে। দাম আমাকে বিচলিত করে না একটুও। প্রতিটা জিনিসের উপযুক্ত একটা মূল্য ঠিক করে নিই। 

সেই হিসাবে আমার নিজস্ব একটা মূল্যতালিকা আছে। সেই তালিকায় মাল্টার জুসের মূল্য শরাবন—তহুরার চেয়ে কম নয়। প্লেনের ওই বিজনেস ক্লাসের টিকিট কোনো ক্রেডিট কার্ডে বুক করা যাবে না। এ রকম শতসহস্র জিনিসের সন্ধান আমি জানি, যেগুলো অমূল্য। দীর্ঘশ্বাস গুনে নিজেই সেগুলোর মূল্য নির্ধারণ করে নিয়েছি। অনেক দাম দিয়ে একদিন সব কিনে নেব নিশ্চয়ই...।