সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশ এবং দিনও বদলায়। ৩০–৪০ বছর আগে বাংলাদেশে পবিত্র রমজান মাসের দিনগুলো ছিল খানিকটা অন্য রকম। কেমন ছিল সেই হারানো সময়ের রোজা?
কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে, প্রবাসে সবচেয়ে খারাপ লাগে কোন মাসে? আমার একমুহূর্ত সময় লাগবে না বলতে—রোজার মাসে। এ পরবাসে অনেক আছে, কিন্তু কত কিছু যে নেই! সবচেয়ে বেশি নেই যা আশৈশব আমার ছিল—চারদিকে চেনা মানুষের সেই চেনা কোলাহল, ষড়ঋতুর সেই বিচিত্র চন্দ্রাতপ, আমরা যাকে আকাশ বলি। এখানে কি মানুষ নেই? আছে। ঋতুবৈচিত্র্য নেই? আকাশ নেই? বড় উৎসব ঘনিয়ে আসার দিনগুলোয় রোমাঞ্চ নেই? আছে তো। কিন্তু যে সোনার চাবি ঘুরিয়ে ছোট্ট একটি হৃদয়কুলুঙ্গিতে সময়ের স্মৃতি এসে জমে, সেই শৈশবস্মৃতি নেই। যে স্মৃতি প্রথম বলেছিল, ‘তুমি আমার তাই আমি তোমার’, সেটা তো নেই। তাই অত নেই-নেই লাগে।
রোজায় তখন সারা মাস স্কুল ছুটি থাকত না, ছুটি অবশ্য পেতাম বড়সড়ই। সেই ছুটিতে আজব আজব সব বাড়ির কাজ থাকত। মনে আছে, ক্লাস ফোরে বাড়ির কাজ পেলাম সমস্ত জেলার নাম মুখস্থ করতে হবে, ফাইভে বাড়ির কাজ পেলাম চল্লিশবার বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকতে হবে, সিক্সে পেলাম সভ্যতার ক্রমবিকাশ নিয়ে স্ক্র্যাপবুক বানানোর কাজ, সেভেনে পেয়েছিলাম সবচেয়ে অদ্ভুত বাড়ির কাজ—জীবনানন্দ দাশের ‘রূপসী বাংলা’ কবিতার এক-একটি লাইন ধরে সেটার ব্যাখ্যা ও সচিত্র বিবরণ দিতে হবে। ছুটিতে মনপ্রাণ ঢেলে এসব করতাম, হোমটাস্কে ঢিলেমির অবকাশ ছিল না। কবে রোজা রাখব, সেটা নিয়ে সাগ্রহ ঔৎসুক্য তো ছিলই। বড়রা গরমের রোজায় পানির তৃষ্ণায় হুসহাস করত। আর কেউ কেউ আমাদের বলত, ছোটদের রোজা নাকি কিছুক্ষণের জন্য। ফুঁ দিয়ে কোথাও পুরে রেখে দিব্যি ছোটরা পানি খেয়ে নিতে পারে। পানি রাখার কলস তো একালেও দেখা যায়, তখন আরও ছিল কুঁজ/কুঁজো, কলসের চেয়ে তার গলা খাটো, কালো মাটিতে তৈরি, তাতে পানি থাকত চমৎকার শীতল। কুঁজোতেও নাকি ফুঁ দিয়ে রোজাটা আপাতত রেখে আসা চলবে! আমাদের এক মামা আমরা কেউ রোজা রাখতে শুরু করেছি শুনলেই চেপে ধরতেন, ‘কলের কাছে কয়বার গেছিস, সত্য কইরা বল! গোসলের সময় মাথায় পানি ঢাইল্যা কতবার চপচপ কইরা পানি খাইছিস সত্যি বল।’—ভারি মজার সব কাণ্ড হতো রোজা নিয়ে।
রোজার মাসের সাহ্রি থেকেই শুরু করি। আজ থেকে বছর চল্লিশেক আগের সাহ্রি, ঘষা কাচের আড়ালে চলে গেছে যে বিভ্রম—সেই সময়কে মনে করব বলে লিখতে বসেছি। সাহ্রির সময় হলে মহল্লার বাড়িগুলোর দরজায় ঢেঁড়া পিটিয়ে হাঁক দিতে দিতে যেত দলবদ্ধ মুসল্লি, বলত, ‘সেহ্রির সময় হয়েছে।’ হায়, সেকালের দরজা, এই আমিই তো দরজার পেছনের সেই মোটা কাঠটাকে দেখেছি (ডাসা?), দুপাশের দুটি ছোট কাঠের ওপর শয়ান, কাঠের হুড়কো-খিল, বাইরে লোহার কড়া। দেখেছি মাটির জলকান্দা ভরা জলে, তার ওপর রাখা হাঁড়ি যেন হাঁড়ির জিনিসে পিঁপড়া না ধরে। তখন মসজিদে মাইকের এমন ব্যবহার ছিল না, তালেবে এলেমদের কেউ কেউ সারা সাহ্রির ওয়াক্তে হামদ–নাত হয়তো গাইতেন, তবে তা খুব সরবে নয়, জয়ীফ-বৃদ্ধ মানুষ, অসুস্থ মানুষ সব পরিবারেই কমবেশি ছিল, ছিল অন্য ধর্মাবলম্বী পড়শি, যাঁরা সাহ্রিতে জেগে উঠলে কষ্ট পাবেন—সেই বিনয়, সেই সংকোচ, সেই সৌজন্য ছিল সমাজে।
ঢাকা শহরে সাহ্রির ওয়াক্তে উঠে সেই ভাত বসিয়ে দেওয়াটা মনে পড়ে—গরম ভাতের গন্ধের এক আশ্চর্য শরীর ছিল, সেই সুবাস বলত, ভয় নাই, ভয় নাই, আমি আছি। সন্ধ্যারাতের তরকারি গরম দেওয়া হতো চিরায়ুষ্মতী লোহার কড়াইয়ে আর সিলভারের হাঁড়িতে, অনুজ্জ্বল অ্যালুমিনিয়ামের নাম সিলভার কিংবা সিলভর—আমরা কত রঙ্গ জানি! সাহ্রির অতটুকুন সময়ে তো নতুন করে রান্না করা সম্ভব ছিল না। চালাক–চতুর মাইক্রোওয়েভ মধ্যবিত্তের হেঁশেলে ঢুকতে তখনো ঢের দেরি। তখনো বাড়িতেই লোকে সাহ্রি খেত, পুরান ঢাকার চিত্র হয়তো খানিকটা ভিন্ন হবে, নতুন কিংবা উঠন্তি ঢাকায় তখন বাড়ির বাইরে হোটেলে গিয়ে সাহ্রি খাওয়ার চল ছিল না একেবারেই। এখনকার মতো রগরগে বিরিয়ানি-পোলাও সাহ্রিতে চলত না। মুরব্বিরা বলতেন, সাহ্রিতে নাকি সহজ-সুপাচ্য খাবার খেতে হয়, খেতে হয় ঝোলের মাছ, শজনের ডাল, সবজির তরকারি, আমিষার্থে বড়জোর মুরগির ঝোল কিংবা ডিমভুনা। শেষ পাতে খানিকটা দুধ-গুড় আর সঙ্গে মরসুম বুঝে কলা কিংবা আম। ফলে সাহ্রিতে ঘুমচোখে উঠে ও রকম সাত্ত্বিক খানাখাদ্য দেখে আমাদের ছোটদের ভারি বিরক্ত লাগত। কে না জানে, শিশুদের খাদ্যরুচি ভারি তামসিক। তবে হ্যাঁ, পরিণত বয়স্ক মানুষের গভীর আগ্রহে খাদ্যগ্রহণের দৃশ্য দেখার একটা মজা আছে কিন্তু, সেটা যদি আলুপোড়াও হয়, তা–ও সই, জানতেন ভ্যান গঘ। জানতেন হুমায়ুন আজাদও (ফুলের গন্ধে ঘুম আসে নাতে সেই কামলাদের ভাত খাওয়ার অত্যুজ্জ্বল দৃশ্যবর্ণনা)। জানতাম আমরা ছোটরাও। গরমকালে রোজা পড়লে শেষ পাতে বড়দের সেই আম আর দুধ খাওয়ার লুব্ধ দৃশ্য আগ্রহ নিয়ে দেখতাম, শীতে গুড়-কলা আর দুধভাত। চেয়ে চেয়ে আসলে কী দেখতাম তখন? অন্নময় জীবনে অন্ন গ্রহণের স্বাদ? সামান্য উপবাসের ভয়ে মরিয়া মানুষ? অর্ধাহার কি অনাহারের ভেতর যে জীবনের সর্বোচ্চ ভয় উপস্থিত, যে ভয়ে মানুষ আত্মবিক্রয় করে সন্তান বিক্রয় করে, সেই ভয় সম্পর্কে আমরা ছোটরা তো তখন ওয়াকিবহাল ছিলাম না; বড় যাদের দেখতাম, তারাও তো জানত রোজা খোলার পরে ভাত জুটবেই। তাহলে অত ভয় অত ব্যবস্থাপনা কিসের? জানি না। ঘুমে চোখ টানছে, মাথাটা দুলছে জলে-ভরা পাত্রের মতো, তবু সাহ্রির ওই সময়ের পৃথিবী আমার অদ্ভুত লাগত। যে রাতের গা-ছমছমে পৃথিবী চোর-ডাকাতের, সেটা যেন একমুহূর্তে জাগ্রত-জনতার হয়ে গেছে।
ঢাকা শহরে সাহ্রির ওয়াক্তে উঠে সেই ভাত বসিয়ে দেওয়াটা মনে পড়ে—গরম ভাতের গন্ধের এক আশ্চর্য শরীর ছিল, সেই সুবাস বলত, ভয় নাই, ভয় নাই আমি আছি। সন্ধ্যারাতের তরকারি গরম দেওয়া হতো চিরায়ুষ্মতী লোহার কড়াইয়ে আর সিলভারের হাঁড়িতে।
রাতের মোহন স্তব্ধতা, রাতের গ্লানি, রাতের লুকোনো কান্না, রাতের বিপদ—সব নেই করে দিয়ে জেগে উঠেছে একটুখানি দিনের বেলা, এমন লাগত। সাহ্রিতে উঠতে আইঢাই করলে মশারির নিচে আম্মা চুপচাপ এগিয়ে দিত দুধের গেলাস। শীতকালে রোজা পড়লে সবকটা বালতিতে আম্মা ঝপাঝপ গরম পানি মিলিয়ে রাখত। কত কঠিন ছিল আমাদের শৈশব–কৈশোর, অথচ কত অনায়াস হয়ে গেছিল অত যত্ন পেয়ে পেয়ে। আর সাহ্রি শেষ হওয়ার আগের কয়েক মিনিটে সে কী তোড়জোড়, যেন এক দিনের বাদশাহ আবু হোসেনের রাজ্যপাট গোটানোর সময় ওটা। গোছাত বাড়ির মেয়েরা, তাদের যেন পরকাল নেই। বাড়ির পুরুষেরা দিব্যি বসে যেত জায়নামাজে। সাইরেন বাজত। এরপর আজান। ফজরের নামাজ পড়েই দে পড়ে ঘুম। সকালে নাশতার ঝামেলা নেই (যদি না বাড়িতে বেরোজদার শিশু আর বৃদ্ধ থাকে), দুপুরে অফিসের খাবার দেওয়ার তাড়াহুড়ো নেই। কিন্তু না, সূর্যাস্তের পর ইফতারি আছে তো। তার তৈয়ারি চলবে সারা দুপুর-বিকেল।
ইফতারের আগে–পরে বাংলাদেশ টেলিভিশনে হামদ-নাত পরিবেশন শুরু হলো হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জমানায়। চেনা শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন খালিদ হোসেন, ফাতেমা তুজ জোহরা, শবনম মুশতারী। নাতে রসুল কিছু ছিল ভারি সুন্দর—‘নবী এলেন উঠল গেয়ে বনের যত বুলবুলি’, ‘মনে বড় আশা ছিল যাব মদিনায়’, ‘নিখিলের চিরসুন্দর সৃষ্টি আমার মুহম্মদ রাসুল’, ‘তওহিদের মুরশিদ আমার মুহাম্মদের নাম’—আর কিছু ছিল বেসুরো গলার চেঁচানি, যেমন—‘দে পানাহ দে ইয়া এলাহি’, সেটা শুরু হলেই আমরাও চেঁচাতাম একসঙ্গে। কেননা শিশুর চিত্ত অফুরন্ত আমোদে ভরা, পরকালের ডরভয় কম। কারণ, সম্মুখে জীবন অগাধ। সেকালে ইফতারের সময় ঘোষণা হতো টেলিভিশনে। সেই ঘোষণার আগে থলেতে করে তুষে মোড়া বরফ নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে বাড়িতে যেত মানুষ। ঘরে ঘরে তো আর তখন ফ্রিজ ছিল না, কিন্তু ইফতারের রোজা-ভাঙানিয়া শরবতে একটু হিম ছাড়া কি আর চলে! ইফতারি বাড়িতে বানানোর চলটা খানিকটা শহরের, গ্রামের লোকে বাইরের বানানো ইফতারি কিনে আনত বলে শুনেছি—সঙ্গে ঘরের ভেজানো চিড়া, কলা, দুধ, দই অথবা সরাসরি ভাত-তরকারি। শহরেও অনেকেই ইফতারি কিনে আনত। ইফতারির ছোলা-বুট ভিজিয়ে রাখা হতো আগের দিন সন্ধ্যায়। পরদিন সোডাসমেত বহুক্ষণ সেদ্ধ করা হতো সে কঠিনহৃদয় দানাকে। চৌকো করে কাটা আলু আর প্রচুর পেঁয়াজসমেত ছোলা ভুনা করা হবে। মুড়ি তো এ মাসে জাতীয় খাদ্য। সঙ্গে মসুর ডালের পেঁয়াজু, পাতলা মুচমুচে বেগুনি, ধনেপাতা-পুদিনাপাতা দেওয়া আলুর চপ। দোকানের পেঁয়াজু বাড়িতে আসবে না, কারণ সেখানে খেসারির ডাল মেশানো হয়, আর নাকি মেশানো হয় মবিল। তখনো ইফতারিতে হালিম বানাতে দেখতাম না। তখন আমাদের দাদি জীবিত, ফলে গ্রামের বাড়ি থেকে চলে আসত রোজা আর ঈদের সওগাত—ফুলপিঠা এলোকেশী পিঠা, পাতা পিঠা, পাকন পিঠা। ভেজে নিলেই কোনোটা মুড়মুড়ে, কোনোটা শারদ মেঘের মতো এলো, এরপর চিনির শিরা কিংবা ঝোলাগুড় ঢেলে খাওয়া হতো। মনে মনে কীসব ভাবতাম, নানির দিকের পিঠা সরস—দুধপুলি, চই পিঠা, দুধ চিতই; আর দাদির দিকের পিঠা ঝনঝনে, শুকনো। আম্মা বলত, আমাদের নানির দিকের জমিনে নদী-নালা, খালবিল, তাই নাকি অত ঝোল তরকারি খাওয়ার চল, দাদির দিকে উঁচু ডাঙা আর লাল মাটি তাই তরকারি সব ভুনা। মনে হতো, পিঠায় এসেও সেই ল্যান্ডস্কেপের প্রভাব পড়েছে নিশ্চয়ই। ইফতারের খানিক পরই তারাবিহর নামাজ, অর্থাৎ আব্বা মসজিদে এবং আম্মাও দীর্ঘ নামাজে। আমাদের আর পায় কে! এন্তার ফাঁকি দিতাম পড়ালেখায়।
রোজার মাসের শেষ দিকে শবে কদর। শবে বরাতে যা কিছু বরাতে লেখা হয়েছে, সেটা পাক্কা করা হবে এই রাতে। সাদা ফরাস পেতে তাতে জায়নামাজ বিছানো হতো, এ রাতে কেউ ঘুমাবে না। হাতলভাঙা চিনামাটির কাপে চাল ভরে তাতে আগরবাতির লিকলিকে ডাঁটা গুঁজে রাখা হতো। সারা রাত সুগন্ধে ভরে থাকত বাড়ি। শবে কদরের পর থেকেই আমাদের অস্থিরতা বাড়ত, কবে ঈদ! ঈদের চেয়ে যদি আনন্দের কিছু থাকে, তবে তা ঈদের আগের রাত—চানরাত। বাজি তখনো পোড়ানো হতো, এখনকার চেয়ে কম। ঈদের চাঁদ দেখতে গিয়ে সত্যি সত্যি এ ছাদ–ও ছাদে কত প্রেম হয়ে যেত। খলিফার মাসব্যাপী ব্যস্ততার সেই সমাপনী সন্ধ্যা। আম্মা অবশ্য নিজেই আমাদের কাপড় সেলাই করত ছোটবেলায়, আমার ফ্রক তো বটেই, সঙ্গে একই ছিটের হাফপ্যান্ট আর ফুরফুরে লেস দেওয়া শেমিজ, ভাইয়ের শার্ট আর প্যান্টও। সেসব ফ্রক, ভয়েলের—লেডি হ্যামিল্টন সিল্কের কিংবা পুরোই পরি-টাইপ লেসের, লুকিয়ে রাখতে হবে যেন কেউ না দেখে। একবার মোক্ষম জায়গা খুঁজে পেলাম আমার হারমোনিয়ামে সুরের চাবিগুলো তুলে ফেললে ভেতরে যে কাঠের গহ্বর, সেখানে। ঈদের আগের রাতে অবধারিতভাবে বিটিভিতে সৈয়দ আব্দুল হাদী বাচ্চা ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নিয়ে গাইতেন, ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ’। ঈদে বাচ্চাদের অনুষ্ঠান বলে যা দেখাত, তা কখনো দেখিনি, শিশুমন বিষয়ে বিটিভির ভাবনা বেশ সীমিত ছিল।
ঈদের দিন ভারি আনন্দের দিন, অতএব ভারি আনন্দ করতে হবে—এই সংকল্প-রোমাঞ্চিত মনে কলঘরের দিকে যেতে যেতে দেখতাম, ভোররাতে জেগে উঠে আম্মা কত রকম সুখাদ্য রেঁধে খাবার টেবিলে সাজিয়ে ফেলেছে, দুধসেমাই (শিরখুরমা শব্দটা শুনতে শুনতে বহু বছর পার হয়ে যাবে), সেমাইয়ের কমলা জর্দা, পায়েস, কাবাব, খানিকটা মটরশুঁটি দেওয়া পোলাও, কোর্মা, সকালে খাওয়ার নরম খিচুড়ি আর ভুনা গোশত। অত কিছু রেঁধেবেড়ে আম্মার গায়ের গন্ধ বদলে যেত। কিন্তু আম্মা আমাদের গায়ের গন্ধ সম্পর্কে বেশি সজাগ, তক্ষুনি প্রচুর পানি ঢেলে গোসল করে আসতে হবে, এসে নতুন জামা, নতুন জুতা পায়ে দিয়ে আম্মাকে দেখাতে হবে। সদ্য সমাপ্ত ক্যানভাসের মতো করে আমার কাছ থেকে পিছিয়ে গিয়ে আমাদের চিত্রকর মা দেখবে সেলাইকলে উবু হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পরিশ্রম করে তৈরি করা জামাটা আমার গায়ে কেমন ফিট করেছে। চোখ সরু, ঠোঁট চেপে আছে, যে চোখমুখের সামনে আমার কাঠের খোলে লুকিয়ে ফেলা সবকিছু ধরা পড়ে যায়… সেই গামা রে থেকে বাঁচতে আমি ঢিপ করে উপুড় হয়েছি, প্রথম সালাম করতে হবে আম্মাকে। ভাইকে নিয়ে দু–চারটে বন্ধুর বাড়িতে যাব, খেতে দিলে বলতে হবে—খেয়ে এসেছি, আম্মা ও রকম শিখিয়ে দিয়েছে।
সেই সময়ের মহল্লার রোজা আর ঈদের গল্প এসব, যে সময় বেশির ভাগ বাড়ির সদর দরজা খোলাই থাকত, বরফ-পানি খেলতে খেলতে সব বাড়ির অন্দর এফোঁড়–ওফোঁড় করে ছুটে যেতাম, এবাড়ি–ওবাড়ি বিনিময় হতো বাটি-বাটি তরকারির, দরজায় ভিখারির গান বাজত অষ্টপ্রহর। হারিয়ে গেছে সেই রকম শৈশব, মানুষে-মানুষে সেই ভরসা।