দুপুরের কিছু আগে আমরা যখন পাড়াতলী গ্রামের সেই পুকুরের সামনে এসে দাঁড়ালাম, সেটি তখন নিস্তরঙ্গ। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের এমনই এক অনতি দুপুরে কবি শামসুর রাহমান এই পুকুরপাড়ে বসে লিখেছিলেন বিখ্যাত দুই যমজ কবিতা ‘স্বাধীনতা তুমি’ ও ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’।
পুকুরের দিকে তাকিয়ে মনে প্রশ্ন জাগল, মুক্তিযুদ্ধের অবরুদ্ধ সেই সময়ে এই পুকুরপাড়ে বসে মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যে কেমন করে কবিতা দুটি লিখে ফেলেছিলেন কবি? প্রশ্নের কোনো সুরাহা হলো না।
পাড়াতলী গ্রামের এরশাদুর রহমান পুকুরপাড়ের একটি আমগাছ দেখিয়ে বললেন, ‘এখানে বসেই কবিচাচা কবিতা দুটো লিখেছিলেন।’ পাড়াতলীতে শামসুর রাহমানের পারিবারিক ভিটার পাশের বাড়িটি তাঁর। প্রায় ৬০ বছর বয়সী এই মানুষের মুখে ‘কবিচাচা’ শব্দটি শুনে চমকে গেলাম! কবি শামসুর রাহমান তাহলে পাড়াতলীতে ‘কবিচাচা’?
হ্যাঁ, গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ শামসুর রাহমানকে কবিচাচা হিসেবেই চেনেন।
শামসুর রাহমানের স্মৃতি খুঁজতে সম্প্রতি আমরা গিয়েছিলাম নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলায় কবির পিতৃপুরুষের ভিটায়।
বাস আর সিএনজির পর নৌকায় মেঘনার শাখা নদী পাড়ি দিয়ে রিকশায় চেপে তবেই না পৌঁছাতে হয় পাড়াতলী। সায়েদাবাদ ঘাটে পৌঁছে যেকোনো রিকশাচালককে বললেই হলো, ‘কবির বাড়ি যাব’, আর চিন্তা নেই।
আমাদের রিকশাচালক জহিরুল। কবির কথা তুলতেই তাঁর মুখে কথা ফুটল খইয়ের মতো, ‘আমি পড়ালেখা তেমন করতে পারিনি। কিন্তু জানি, কবিচাচার কবিতা স্কুলের বইয়ে আছে। পাড়াতলী গ্রাম নিয়ে তিনি লিখেছেন।’ এরপরই শুনিয়ে দিলেন কবির ‘প্রিয় স্বাধীনতা’ পদ্যের দুটো চরণ, ‘মেঘনা নদী দেব পাড়ি/ কলঅলা এক নায়ে।/ আবার আমি যাব আমার/ পাড়াতলী গাঁয়ে।’
পাড়াতলী গাঁয়ে পা রাখার পর আমাদের দেখা হয়ে গেছে এরশাদুর রহমানের সঙ্গে। নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে বললেন, ‘কবিচাচা আর আমরা একই বংশের।’ এ-ই বলেই মেলে ধরলেন তাঁর স্মৃতির ঝাঁপি, ‘শেষবার তিনি এসেছিলেন ২০০৫ সালের ডিসেম্বর মাসে। কবিচাচা তখন বেশ অসুস্থ। তবু খুব হাসিখুশি ছিলেন। চারপাশে তখন শর্ষে ফুল ফুটেছে। তিনি শর্ষেখেতে ছবি তুললেন। আমরা তাঁকে একটি আমগাছের চারা দিলাম। তিনি পুকুরপাড়ে সেটা লাগালেন।’
এই আমগাছের চারা রোপণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আরেক ঘটনা। শামসুর রাহমানের আত্মস্মৃতি কালের ধুলোয় লেখা বইটায় চোখ ফেরানো যাক। কবি লিখেছেন, ‘এপ্রিল মাসের সাত অথবা আট তারিখ দুপুরের কিছুক্ষণ আগে বসেছিলাম আমাদের পুকুরের কিনারে গাছতলায়। বাতাস আদর বুলিয়ে দিচ্ছিল আমার শরীরে।
পুকুরে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে, কিশোর-কিশোরীও ছিল ক’জন, সাঁতার কাটছিল মহানন্দে। হঠাৎ আমার মনে কী যেন বিদ্যুতের ঝিলিকের মতো খেলে গেল।...আমি চটজলদি আমার মেজ চাচার ঘরে চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র চাচাতো ভাইয়ের কাছ থেকে একটি কাঠপেন্সিল এবং কিছু কাগজ চাইলাম।...কাঠপেন্সিল এবং খাতাটি নিয়ে সাততাড়াতাড়ি পুকুরের দিকে ছুটলাম...পুকুরের প্রতিবেশী সেই গাছতলায় বসে...পর পর লিখে ফেললাম দুটি কবিতা—“স্বাধীনতা তুমি” এবং “তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা”।’
শামসুর রাহমান পুকুরপাড়ের যে গাছতলাটির লিখেছেন, সেটি ছিল আমগাছ। গাছটি পরে ঝড়ে ভেঙে পড়ে। ২০০৫ সালে কবি যখন সর্বশেষ গ্রামে এলেন, তখন সেখানেই আবার নতুন করে আমগাছের চারা লাগিয়ে যান। এরশাদুর রহমান বললেন, ‘কবিচাচাকে বলেছিলাম, আমগাছটা লাগিয়ে যান, পরবর্তী প্রজন্ম জানতে পারবে কবিতা দুটো কোথায় লেখা হয়েছিল।’
আমগাছটি বেশ ডাগর হয়েছে। আমরা গাছটি ধরে দাঁড়ালাম। জানা গেল, আমগাছের পাশে এই পুকুরে ডুবেই ১৯৭৬ সালে মারা গিয়েছিল কবির কিশোরপুত্র ওয়াহিদুর রাহমান। কবি তাকে আদর করে ডাকতেন মতিন। অকালপ্রয়াত সেই ছেলেকে ‘তোর কাছ থেকে দূরে’ কবিতায় অমর করে রেখেছেন কবি। ‘তোর কাছ থেকে দূরে, সে কোন নিশ্চিন্তিপুরে পালাতে চেয়েছি/ প্রতিদিন, বুঝলি মতিন!/ হয়তো বা টের পেয়ে অবশেষে নিজেই উধাও হয়ে গেলি।’ পাড়াতলী গ্রামেই রয়েছে মতিনের কবর।
এই পাড়াতলীকে কি কখনো ভোলা সম্ভব ঢাকার আশেক লেনে জন্ম নেওয়া শামসুর রাহমানের পক্ষে? এর জবাব দিয়েছেন আত্মস্মৃতিতেই, ‘আমার নিজের শৈশব, কৈশোর, যৌবন এবং প্রৌঢ়ত্বের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে পাড়াতলীর সঙ্গে। সেই যে কবে বিছানায় শুয়ে শুয়ে কিংবা পুকুরপাড়ে গাছতলায় বসে উদাস দুপুরে ডাহুকের ডাক শুনতাম...এসব কি ভোলা যায় কখনও?’
কবি ভোলেননি। জীবদ্দশায় বারবার ফিরে গেছেন পাড়াতলীতে। পাড়াতলীর মানুষজনও ভুলতে পারেননি তাঁদের কবিচাচাকে?
এখনো কবির পারিবারিক ভিটায় গেলে, বাড়িটি এখন যাঁরা তদারক করেন তাঁরা—অথবা গ্রামে থাকলে কবির ছোট ভাইয়ের ছেলে তৌফিকুর রাহমান—সবাইকে নিয়ে যান শ্যাওলামাখা একতলা সেই বাড়িটিতে, যেখানে শুয়ে থেকে কবি শুনতেন ডাহুকের ডাক!