মা মোছাম্মদ আঙুরা খাতুনকে নিয়ে লিখেছেন বাংলাদেশের দ্রুততম মানবী শিরিন আক্তার
মেয়েদের খেলাধুলায় আসতে অনেক সময়ই পরিবারের একটা বাধা থাকে। সে ক্ষেত্রে নিজের গড়ে ওঠার পেছনে বাবা–মায়ের অবদানকেই এগিয়ে রাখতে হয়। আরও নির্দিষ্ট করে বললে একটা মেয়ের জীবনে মায়ের অবদান সবচেয়ে বেশি। তার বড় হয়ে ওঠা, স্বপ্নপূরণ, ক্যারিয়ার, খেলাধুলা—সবকিছুতেই মায়ের অংশগ্রহণ বলে শেষ করা যাবে না।
খেলাধুলা ও পড়ালেখা একসঙ্গে করব বলে ২০০৭ সালে আমি সাভারের বিকেএসপিতে ভর্তি হই, ছোট্ট বয়সে বাড়ির বাইরে চলে আসি। বাড়ির ভেতরে থাকলে আসলে ঠিকভাবে বোঝা যায় না, মাকে কতটা ভালোবাসি। বাইরে গিয়েই আমি প্রথম বুঝতে পারি, মা আসলে কী! বুঝতে পারি, গ্রামের মোছাম্মদ আঙুরা খাতুন নামের এক নারী তার মেয়ের জন্য কত কী করেছেন!
আমার মা খেলাধুলা সরাসরি বোঝেন না। কিন্তু আমার খেলা থাকলে বা আমি ব্যথা পেলে অস্থির থাকেন। রোজা রাখেন। আমি বলি, রোজা রাখার দরকার নেই; শুধু নামাজ পড়ে দোয়া করো। কিন্তু তাঁর কথা হলো, না, রোজা রেখে তিনি আল্লাহর কাছে তাঁর সন্তানের সুস্থতা চাইবেন। আমার যে কদিন যেখানেই খেলা থাকুক, ওই দিনগুলোতে তিনি রোজা রাখবেনই। সন্তানের জন্য মায়ের এই যে চাওয়া, আমার মনে হয়, এটা বিদ্যুতের মতো কাজ করে। মায়ের একটা আলাদা মাহাত্ম্য আছে।
আমার মা ভ্রমণ করতে পারেন না। বিকেএসপিতে যখন ভর্তি হই, একবার ‘পেরেন্টস ডে’তে আমার বাবা–মা আসবেন। তো সাতক্ষীরা সদরের দহকোলা গ্রামের বাড়ি থেকে বাসে যশোর পর্যন্ত এসে মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন আব্বু মাকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিতে চান। কিন্তু মা তাঁর মেয়েকে একবার দেখার জন্য অসুস্থ অবস্থায়ও সাভার আসেন। এ ছিল অভাবনীয় এক ব্যাপার!
সাতক্ষীরা থেকে আমিই প্রথম বিকেএসপিতে ভর্তি হওয়া কোনো মেয়ে। ২০১৪ সাল থেকে ১৪ বার দেশের দ্রুততম মানবী হয়েছি আমি। বর্তমানে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করছি ক্রীড়াবিজ্ঞানে। মানে এখনো রয়েছি আমি বাড়ির বাইরেই।
আগে প্রচুর ডায়েরি লিখতাম। এটা শুরু হয়েছিল বিকেএসপিতে থাকার সময়ই। এমন হতো রাতে উঠে টেবিলল্যাম্প জ্বালিয়ে ডায়েরি লিখছি, মায়ের জন্য কান্না করছি, সেই সময় চাঁদের সঙ্গে কাল্পনিক কথা বলতাম।
ডায়েরিতে আমি লিখতাম, ‘মা কেমন আছে। কী করছ? আজ এই হয়েছে’...এই সব। কখনো কখনো এমন হতো, ডায়রিতে যা লিখেছি, তা নিয়ে আসতাম বাড়ি। আমার মা পড়ালেখা তেমন জানেন না, সইটা করতে পারেন। তো আমার ডায়েরিটা খুলে তাঁকে বলতাম, ‘জানো আম্মু, অমুক দিন এতটার সময় তোমাকে অনেক মনে পড়েছে।’ কখনো কখনো হয়তো বলতামই না, লজ্জা পেতাম।
আমি এখনো ছোট ছোট করে লিখি, ‘জানো মা, আজ এই হয়েছে...।’
এখন ফোনে প্রচুর কথা বলা হয় মায়ের সঙ্গে। এক–দেড় ঘণ্টা অনায়াসে পেরিয়ে যায়। ফোন রেখে দেওয়ার সময় মা বলেন, ‘আব্বু, কোনো সমস্যা? ফোন রেখে দিবা?’ আম্মু আমাকে আব্বু বলে ডাকে। আসলে তাঁর সঙ্গে কথা বলে মনটা ভরে না। সন্তানের প্রতি সব মায়ের একই রকম অনুভূতি। মা মা–ই।
ঘন ঘন বাড়ি গেলেও মায়ের সঙ্গে বিদায়টা হয় একই রকম। মনে হয়, কত বছর দেখা হয় না! এখনো মা দাঁড়িয়ে থাকেন, কান্না করেন। ঠিক আগের মতো। কোনো বদল নেই। মায়ের এই জায়গাটা একদম নিখুঁত।
অনুলিখন: মাসুদ আলম