‘স্যার’ ডাকা হয়নি বলে নাখোশ হওয়ার ঘটনা হরহামেশাই ঘটে। যেমন গত ২২ নভেম্বরও রংপুরে এ নিয়ে ধুন্ধুমার কাণ্ড ঘটে গেল। শেষমেশ অবস্থান কর্মসূচিতে বসলেন এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। চলুন, জেনে নেওয়া যাক কীভাবে এল এই ‘স্যার কালচার’।
‘স্যার’ কখনো কখনো ‘ষাঁড়’ হয়ে যায়, তা তো জানেন। উচ্চারণ-বৈচিত্র্যে ‘ছার’ও হয়ে যেতে পারে। আবার স্যারের আগে ‘ইয়েস’ যোগ করতে গিয়ে হয়ে যায় ‘ইয়েচ চার’! মুখ দিয়ে বের হওয়া উচ্চারণ যে রকমই হোক, স্যারের তাতে কিছু যায়–আসে না। তবে স্যার যদি হন আবৃত্তির গুরু, তবে শ, ষ, স—তিন শ-এর উচ্চারণ আপনাকে শিখিয়েই ছাড়বেন। সঙ্গে বোনাস হিসেবে শেখাবেন ছ, চ-এর উচ্চারণ। তবে আবৃত্তি-গুরুও হয়তো খেয়াল করেননি, স্যার শব্দের মধ্যে একটা তরলধ্বনি ‘র’ আছে। যাঁদের মুখে এই শব্দের জন্ম, সেই খোদ ব্রিটিশরা এই র-এর উচ্চারণ ঠিকমতো করতে পারে না। জ্ঞানের কথায় বাঙালির মুখে ‘রা’ না থাকতে পারে, কিন্তু ‘র’ ঠিকই আছে। ব্রিটিশদের অনুকরণে অনেক ইঙ্গো-বাঙালিকেও ‘র’ বাদ দিয়ে ‘স্যা’ বলতে শুনবেন। বুটজুতা দিয়ে ঠকাস করে শব্দ করে, লম্বা একটা স্যালুট ঠুকে অধস্থন পদধারীও বলে ওঠে, ‘ছ্যা’! ‘ছ্যা’ শুনে আপনার সচেতন কান কুঞ্চিত হতে পারে, মুখ দিয়ে আপনি হয়তো ছ্যা-ছ্যাও করতে পারেন, তবে যাঁকে ‘স্যা’ কিংবা ‘ছ্যা’ বলা হলো, তাঁর তাতে ভাবান্তর ঘটে না। আসল ব্যাপার তখন উচ্চারণ ছাড়িয়ে স্যালুটের মধ্যে ঢুকে যায়। তখন স্যালুট, মানে সালাম, মানে সম্মানটাই মুখ্য হয়ে ওঠে।
সম্মান, হ্যাঁ সম্মান। বাঙালির অনেক কিছু নেই; তাতে কোনো সমস্যা নেই। এই জীবনে সে অনেক কিছু পায়ও না; তাতেও কোনো অতৃপ্তি নেই। কিন্তু সম্মান যদি না থাকে, আর সম্মান যদি পাওয়া না যায়, তবে বাঙালি গোসসা করে। গোসসা মানে রাগ—গরিবের রাগ। গরিব লোকও রাগ করে। আর যাঁর পয়সা আছে (পয়সাই–বা বলি কেন? পয়সায় কি ‘বড়লোক’ হওয়া যায়?), তিনিও কিন্তু আর সবকিছুর সঙ্গে সঙ্গে সম্মানটা চান। বিয়েবাড়িতে আমন্ত্রিত অতিথিকে এক পিস চিকেন রোস্ট দিয়ে যতটা না খুশি করা যায়, তার চেয়ে অলমোস্ট বেশি খুশি করা যায় সম্মান দিয়ে, মানে একটু খাতির করে। খাতির বা সম্মান কে না চায়? অনেকে জোর করে হলেও সম্মান আদায় করে নেয়। এই সম্মান করার কাজটি খুব একটা জটিল নয়। কথার ফাঁকে ফাঁকে দু-একবার ‘স্যার’ বললেই হয়। কিন্তু কৃপণ বাঙালি কখনো কখনো তিন শব্দের ফাঁকে চারবার ‘স্যার’ বলে অকৃপণতার পরিচয় দেয়! বিনয়ে হাত কচলিয়ে স্যার বলতে বলতে হাতের রেখা উঠে যেতে পারে, কিন্তু কপালের লেখায় সৌভাগ্য যোগ হতে থাকে। পদ-পদবি আর আয়-উন্নতি যে লুকিয়ে থাকে ‘স্যার’ শব্দের মধ্যে!
‘স্যার’–এর প্রতি বাঙালির এই লালসা আজকের নয়। সেই ব্রিটিশ আমলে ভারতবর্ষে উপনিবেশ গড়েই ইংরেজরা আমাদের ‘স্যার’ বলা শিখিয়েছেন। বাঙালিও নিজ উন্নতি ত্বরান্বিত করতে ‘স্যার’ বলা শিখেছে। স্যার যে কত বড়, এটা বোঝাতে ইংরেজরা নাইট উপাধির সঙ্গে স্যার যুক্ত করে দিয়েছেন। তবে সেই স্যার বর্জনেরও নমুনা আছে।
ব্রিটেনে ‘স্যার’ শব্দের জন্ম, ফরাসি ‘সিউর’ থেকে। জমির মালিক, সম্ভ্রান্ত আর সম্মানিত মানুষের জন্যই শব্দটি চালু ছিল। যার অন্য মানে ছিল ‘লর্ড’। ফরাসিরা ওটা ছেড়ে বহু আগেই ‘মিসিয়া’ গ্রহণ করেছে। আমরা ফরাসিদের অনুকরণে ‘মিসিয়া’ বা ‘মশিঁয়ে’ অবশ্য বলি না, কিন্তু বলি ‘মশাই’ বা ‘মহাশয়’। স্যার বাংলা (!) কি না, এই দ্বিধা থেকে অনেকে চিঠিপত্রে ব্যবহার করেন ‘মহাশয়’ বা ‘জনাব’। স্যার শব্দের নারীবাচক প্রয়োগে এককালে ব্যবহার হতো ‘জনাবা’। ইংরেজিতে অবশ্য স্যারের নারীবাচক কোনো শব্দ গড়ে ওঠেনি।
শিক্ষকতা করবেন, এই ইচ্ছা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতী খুলেছিলেন, গুরু হয়েছিলেন। আবার কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণ গ্রহণ করে শেষ বয়সে ‘স্যার’ হয়েছিলেন। কিন্তু পড়ন্ত যৌবনে জালিয়ানওয়ালাবাগের ইংরেজদের নির্লজ্জ হত্যাকাণ্ড দেখে নাইট উপাধি ‘স্যার’–এর মায়া ত্যাগ করেছিলেন। কপাল ভালো, ব্রিটিশরাজের অংশ না হওয়ায় আইনস্টাইন ‘স্যার’ হতে পারেননি, ফলে স্যার ত্যাগের প্রশ্ন ওঠে না। এদিকে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী নিউটন অনায়াসে হয়ে গেলেন স্যার আইজ্যাক নিউটন।
বিশ্বজুড়ে প্রবল ক্ষমতাধর এই ব্রিটিশ রাজত্বের বিস্তার দেখে একসময় বলা হতো, ‘ব্রিটিশ রাজত্বের কখনো সূর্যাস্ত ঘটে না।’ এখন সেই ব্রিটিশ রাজত্বের সূর্যাস্ত ঘটেছে, বহু দেশ এই-ওই-সেই নানা রকম পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে স্বাধীনতাও লাভ করেছে। কিন্তু সম্বোধনে ‘স্যার’ ত্যাগ করতে পারেনি। এখানে-ওখানে-সেখানে সব জায়গায় দেদার এখন ‘স্যার’ সম্বোধিত হচ্ছে। আপনি যদি স্বল্প আয়ের নিম্নবিত্ত মানুষও হন, মোবাইল কোম্পানির করপোরেট অফিসে ফোন দিলে আপনাকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করবে।
তাতে স্যার সম্বোধনে অনভ্যস্ত আপনি প্রথমবার ভড়কে যেতে পারেন, কিন্তু ওরা আপনাকে স্যার বলবেই। এখানে সম্মান-অসম্মান বড় ব্যাপার নয়, স্যার এখানে পুঁজি বড় করার উপায়!
অবশ্য পুঁজিবাদী দুনিয়ার বিকাশের অনেক আগে, সামন্তবাদী ইউরোপে ‘স্যার’ শব্দটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সেটা উনিশ শতকের গোড়ার দিকের ঘটনা। এর অন্তত পাঁচ শ বছর আগে ব্রিটেনে ‘স্যার’ শব্দের জন্ম, ফরাসি ‘সিউর’ থেকে। জমির মালিক, সম্ভ্রান্ত আর সম্মানিত মানুষের জন্যই শব্দটি চালু ছিল। যার অন্য মানে ছিল ‘লর্ড’। ফরাসিরা ওটা ছেড়ে বহু আগেই ‘মিসিয়া’ গ্রহণ করেছে। আমরা ফরাসিদের অনুকরণে ‘মিসিয়া’ বা ‘মশিঁয়ে’ অবশ্য বলি না, কিন্তু বলি ‘মশাই’ বা ‘মহাশয়’। স্যার বাংলা (!) কি না, এই দ্বিধা থেকে অনেকে চিঠিপত্রে ব্যবহার করেন ‘মহাশয়’ বা ‘জনাব’। স্যার শব্দের নারীবাচক প্রয়োগে এককালে ব্যবহার হতো ‘জনাবা’। ইংরেজিতে অবশ্য স্যারের নারীবাচক কোনো শব্দ গড়ে ওঠেনি, তবে সম্মানিত নারীর জন্য ব্যবহার হতো ‘ডেম’। সেই ডেম কালে কালে হয়েছে মাডেম বা ম্যাডাম। এই ম্যাডাম আবার ইনফরমাল উচ্চারণে হয়েছে ম্যাম।
আজকের দুনিয়ায় কেউ আর পুরুষ-নারীর ভেদ করতে চান না, অন্তত শব্দে। তাই জনাবা হয়েছে ‘জনাব’, ম্যাডাম হয়েছে ‘স্যার’। আপনি নারী ডিসি হন আর নারী মন্ত্রীই হন, আপনাকে ‘স্যার’ই শুনতে হবে। তবে স্যার বলাতে কি কাউকে বাধ্য করা যায়? বাধ্য-অবাধ্যের ব্যাপারটা বেশ জটিল। এই ‘স্যার’ সম্বোধনের খানিক যে সুবিধা আছে, সেটি তো মানবেন। পদ-পদবি বা র্যাংকে কে কার ওপরে, এটা বোঝার জন্য কান পেতে থাকুন, কে কাকে ‘স্যার’ বলছে লক্ষ করুন। পুলিশ-মিলিটারির ব্যাজ না বুঝেও আপনি উচ্চ-নিম্ন পদ ঠিকই বুঝে ফেলতে পারবেন স্রেফ ‘স্যার’ উচ্চারণের মধ্য দিয়ে।
‘স্যার’ সম্বোধনের মধ্য দিয়ে মর্যাদা পাওয়ার চেষ্টা চলে, হাল আমলের বিভিন্ন সংবাদে আপনি এটা নিশ্চিত হতে পারবেন। ওদিকে ‘ছারপোকা’র মধ্যেও তো ‘ছার’ আছে। সেই ছার অবশ্য ‘তুই কোন ছার!’-এর মতো তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের স্যার। এদিকে দলবাজি-টেন্ডারবাজি থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গায় ‘ভাই’দের দোর্দণ্ড প্রতাপে অনেকে ‘স্যার’ না বলে ‘ভাই’ও বলতে পারে! তাতে মনে করার কারণ নেই সম্মান কমে গেল। তবে নিজের সহোদর ভাইও যদি বিদ্যায়তনের শিক্ষক হন, আর আপনি যদি সেখানকার ছাত্র হন, তবে কিন্তু ভাই ডাকা যাবে না। তখন যে উচ্চারণেই হোক—ষাঁড়, ছার, চার কিংবা স্যার আপনাকে বলতেই হবে।