মেহেদি হাসানের গজল এবং...

আসল কথাটা হলো, এ যুদ্ধের সময়ে বাজারে যখন আগুন লেগেছে, তখন তাঁর মতো একজন অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষককে ইলিশ মাছ কেনার জন্য বাজারে যেতে বলাটা কি ঠিক হচ্ছে! রহমান সাহেবের জন্য এটা একটা বিড়ম্বনা। সরকারি স্কুলের শিক্ষক আবদুর রহমান অবসর নেওয়ার পর দেখলেন দুনিয়াটা বড্ড কঠিন হয়ে যাচ্ছে দিন দিন, তার ওপর রাশিয়া যুদ্ধ বাধিয়ে দিয়ে সারা দুনিয়াকে টালমাটাল করে দিচ্ছে। মানুষ ভীতসন্ত্রস্ত, বাঁচবে কী করে, বিশেষত বাংলাদেশের মানুষ! কী করবেন রহমান সাহেব? একটা ব্যাগ হাতে নিয়ে বাজারের দিকে হাঁটা শুরু করলেন। সংবাদপত্রে, টিভিতে নৌকার ওপর চকচকে যে ইলিশ দেখা যায়, বাজারে গেলে সেই ইলিশের দিকে তাকানো যায় না, মনে হয় ওগুলো আগুনের টুকরো—হাত দিলেই পুড়ে যাবে হাত। ‘আরে মিয়া আপনে তো চাক্কার তলে পড়বেন, দেইখ্যা হাঁটেন।’ রিকশাওয়ালা তাঁকে ঠেলে বাঁ দিকে সরিয়ে দিল। তাঁর গা ঘেঁষে শাঁই করে একটা গাড়ি চলে গেল। তাই তো! এভাবে অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটলে তিনি তো গাড়ির তলায় পড়ে মারা যাবেন। বাজারটা দূরে। রিকশায় যাতায়াত করলে যেতে ৪০, আসতে ৪০—মোট ৮০ টাকা খসে যাবে, তাই হেঁটেই বাজারে যান তিনি।

পকেট থেকে বের করে ফর্দটা একবার দেখলেন, প্রথমেই লেখা আছে মাঝারি সাইজের একটি ইলিশ (৩০০ টাকার মধ্যে), তারপর পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ, আদা, জিরা, আলু—এ রকম হাজারটা জিনিস। জিনিসপত্রের দাম এখন সবার আলোচনার বিষয় হলেও দাম কমে না বরং ঘণ্টায় ঘণ্টায় বেড়েই চলেছে—সকালে ৭৬ টাকা তো বিকেলে ৮০ টাকা। একজন শিক্ষকের মানসম্মান আবার কী? তাঁর তো গাড়ি–বাড়ি নেই। রহমান সাহেব স্ত্রীর কাছে কিছুই চান না, শুধু একটা বিষয় ছাড়া, সেটা হলো একটুখানি সহানুভূতি। কিন্তু সহানুভূতির বিষয়টা উঠে যাচ্ছে দিন দিন।

বাজারে ঢুকে আবদুর রহমান সব জিনিসের দাম জিজ্ঞাসা করলেন। গত দুদিনের চেয়ে আজ দাম বেশি। কিছু বললেই দোকানদার বলছে, ‘মাল আইতে পারে না, টেরাকের ভাড়া ডবল হইয়া গেছে, রাশিয়া পেট্রল বেচব না, এইগুলি শুনেন নাই?’

‘কেন শুনব না ভাই, আপনাদের ট্রাক তো চালের মোকামে যায় সকালে একবার আর বিকেলে একবার, গিয়ে ২৫ কেজি চাল কিনে নিয়ে চলে আসে তাই না? বেশি করে আনতে পারে না, সত্যিই ভাই আপনাদের খুব কষ্ট হচ্ছে।’

সামনে মাছের বাজার। দিন–রাত চব্বিশ ঘণ্টা সেখানে উজ্জ্বল আলো জ্বলে মাছের ওপর, যাতে মাছগুলো চকচক করে। আজ শুক্রবার তার ওপর যুদ্ধ, কী হয় কে জানে! মাঝারি সাইজের একটি ইলিশের দিকে আঙুল তুলে রহমান সাহেব বললেন, ‘এটা কত?’

মাছওয়ালা তাঁর দিকে ফিরেও তাকাল না। কারণ, বড় সাইজের মাছের হালি জিজ্ঞাসা করেছে অন্য আরেক খদ্দের। তাকে নিয়েই ব্যস্ত সে। ওরা পোশাক-পরিচ্ছদ আর মুখের ভঙ্গি দেখলেই বুঝতে পারে, কোন ক্রেতা কেমন। এমনকি কার পকেটে কত টাকা আছে, তা–ও হয়তো চেহারা দেখে বলে দিতে পারে। না হলে রহমান সাহেবের কথার উত্তর দিচ্ছে না কেন সে?

বড় ইলিশের হালি জানতে চাওয়া খদ্দেরের পাশে একটা ছেলে মাথায় ঝুড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে কাছে ডেকে খুব যত্নের সঙ্গে চারটে ইলিশ তুলে দিয়ে মাছওয়ালা বলল, ‘স্যার, কম দিয়েন না।’

খদ্দের গোলাপি রঙের আটটা এক হাজার টাকার নোট দিলে কপালে হাত ঠেকিয়ে সালাম জানাল মাছওয়ালা।

লোকটা চলে গেলে রহমান সাহেব একটু ভালোভাবে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘এটা কত?’

‘আট শ।’

‘এত ছোট মাছ আট শ! চার শ হবে, হলে দাও।’ চার শ বলে বুকটা কেমন করে উঠল রহমান সাহেবের। ফর্দে আছে তিন শর মধ্যে। মাছওয়ালা এমনভাবে তাঁর দিকে তাকাল যেন তিনি মস্ত অন্যায় করে ফেলেছেন। কিছুটা তুচ্ছ করেই সে বলল, ‘চার শ-পাঁচ শ এইখানে নাই, অইন্য দিকে গিয়া দ্যাখেন।’

মাছের বাজার ঘুরে ক্লান্ত হয়ে গেলেন রহমান সাহেব। শেষ পর্যন্ত বাজার থেকে বেরিয়ে একটা চায়ের দোকানে ঢুকলেন ক্লান্তিটা দূর করতে। ততক্ষণে চা দোকানের লোকগুলো মন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে টেবিল চাপড়ে চলেছে, ‘উনারা তো সব বেহেশতেই আছেন, চেহারা দেখে বুঝেন না?’

বাজার থেকে ফিরে ক্লান্ত আবদুর রহমান যখন বাজারের থলেটা স্ত্রীর হাতে দিলেন, তখন রেবেকা বেগম তাড়াতাড়ি পলিথিনে মোড়ানো ইলিশ মাছটা বের করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে স্বামীকে বললেন, ‘এটা ইলিশ মাছ!’ রহমান সাহেব কিছু বললেন না, চুপ করে থাকলেন। হঠাৎ কী হলো, চিৎকার করে উঠলেন রেবেকা, ‘তোমাকে বললাম মাঝারি সাইজের ইলিশ আর তুমি আনলে জাটকা।’ বলেই মাছটা ছুড়ে মারলেন স্বামীর দিকে, ‘নাও তোমার মাছ তুমি খাও, তুমিই রান্না করো।’

আবদুর রহমান রেগে যাওয়া স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলেন, এখন তিনি যা কিছুই বোঝানোর চেষ্টা করেন না কেন, রেবেকা বেগম আরও রেগে গিয়ে যাচ্ছেতাই কিছু একটা করে বসবে, কোনোভাবেই তাকে বোঝানো যাবে না যে তিন-চার শ টাকায় ইলিশ মাছ পাওয়া যায় না।

বাসা থেকে বের হয়ে সোজা বড় রাস্তা ধরে হনহন করে তিনি হাঁটতে লাগলেন উত্তর দিকে। আধা ঘণ্টা এভাবে হাঁটার পর বাঁ দিকের রাস্তা ধরলেন। একটু এগোতেই সামনে লেকের পাশে একটা পার্ক দেখে ঢুকে পড়লেন সেখানে। এখানে পার্ক আছে তিনি জানতেন, কিন্তু কখনো আসেননি। জায়গাটা খুব সুন্দর। লেকের পাড়ে ইটবাঁধানো সরু পথ। পশ্চিমে লেক। পূর্ব দিকে ফুলের বাগান আর মেহগনি, শিশুগাছের সারি। অজস্র ফুল ফুটে আছে বাগানে। আবদুর রহমান সিমেন্টের বেঞ্চে বসে লেকের পানি দেখতে লাগলেন, ঠিক তখন মাথার ওপর গাছে একটা পাখি ডেকে উঠল। ইলিশ মাছ নিয়ে ঝগড়া করে পার্কে এলেও এখন মনটা একদম বদলে গেল।

বিকেল গড়িয়ে সূর্যটা পশ্চিমের ভবনগুলোর ওপারে চলে যাচ্ছে। একটা মেয়ে এসে দাঁড়াল রহমান সাহেবের সামনে, ‘এক্সকিউজ মি, একটু বসতে পারি?’ আবদুর রহমান বেঞ্চের এক পাশে সরে বসে বললেন, ‘শিওর, হোয়াই নট।’ মেয়েটা তাঁর পাশে বসলে, তিনি সরাসরি মেয়েটার দিকে তাকালেন না। হয়তো ভাববে লোকটা হ্যাংলা। তিনি লম্বা মেহগনিগাছটার ডালে পাখি খুঁজতে লাগলেন। মাঝে মাঝে পরখ করছিলেন, কী হতে পারে মেয়েটা? পায়ে সুন্দর জুতা, পরনে চমৎকার ম্যাচিং সালোয়ার-কামিজ-ওড়না, কাঁধে ঝুলছে ভারী ব্যাগ, সুগন্ধি মেখেছে শরীরে। সব মিলিয়ে ভীষণ স্মার্ট লাগছে তাকে। হঠাৎ মেয়েটা কথা বলে উঠল ‘আপনি প্রতিদিন এখানে আসেন?’

‘না, আজই প্রথম এলাম।’

‘কী আশ্চর্য ব্যাপার! যদি কিছু মনে না করেন, আপনি কি অবসর নিয়েছেন?’

‘হ্যাঁ।’

‘তাহলে তো আমার জন্য খুব ভালো হলো, আগে কী করতেন প্লিজ...।’

‘শিক্ষকতা করতাম। আপনি কি আমাকে ইন্টারভিউ করছেন।’

‘দেখুন, আমি একটা এনজিওতে কাজ করি। আমার কাজ হলো যেসব মানুষ রিটায়ার্ড করেছেন, তাঁরা অবসর সময়টা কী করে কাটাচ্ছেন, সে সম্পর্কে প্রতিবেদন তৈরি করা, আপনি কি অনুগ্রহ করে একটু সাহায্য করবেন আমাকে?’

‘অবশ্যই করব, একটু অপেক্ষা করুন প্লিজ।’

বাসা থেকে বের হয়ে রেগে মোবাইল ফোনটা সাইলেন্ট করে রেখেছিলেন। রহমান সাহেব দেখলেন তাঁর স্ত্রী ১৮ বার কল করেছেন, না পেয়ে মেসেজ করেছেন, ‘তাড়াতাড়ি বাসায় চলে এসো প্লিজ।’ মেয়েটা বলল, ‘স্যার, এদিকটায় কোলাহল বেশি, যদি একটু ওদিকে যেতেন তাহলে আমার জন্য খুব ভালো হতো।’

‘ঠিক আছে চলুন। তবে তাড়াতাড়ি করবেন। আমাকে আবার বাসায় ফিরে যেতে হবে।’

‘অবশ্যই।’ মেয়েটা পার্কের এক কোনায় নিয়ে গেল। রহমান সাহেবকে একটা সিমেন্টের বেঞ্চে বসতে বলল, যার চারপাশে গাছ দিয়ে ঘেরা। বেঞ্চে বসে রহমান সাহেব বললেন, ‘বলুন, কী জানতে চান?’

‘আচ্ছা, আজ যে আপনি হঠাৎ পার্কে এলেন, এর পেছনে কী কারণ আছে বলবেন দয়া করে?’

‘না, ওটা তো পারিবারিক বিষয়, ওটা বলা ঠিক হবে না।’

‘ঠিক আছে স্যার, আপনাকে অন্য ধরনের কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে চাই, করব...?

‘অন্য ধরন মানে?’

‘আপনাকে দেখে মনেই হয় না আপনি অবসরে গেছেন, কোনো একসময় আপনার চেহারা অসম্ভব সুন্দর ছিল তাই না? এখন মনে হয় আপনি পঁয়তাল্লিশ পার করেননি...।’

‘না, এটা ঠিক না। তবে আমার বন্ধুদের চেয়ে তুলনামূলকভাবে আমাকে কিছুটা কম বয়সী মনে হয় এই আরকি।’

‘এখান আপনি অসম্ভব সুন্দর—এই কথাগুলো কখনো কি কেউ বলেছে আপনাকে?’

একটু হাসলেন আবদুর রহমান। বহুদিন পর তিনি গর্বভরে বলে উঠলেন, ‘জানেন, অনার্স পড়ার সময় গল্প-কবিতা লিখতাম। বন্ধুরা বলত, খুব ভালো হয়েছে। এমএ পড়ার সময় কয়েকটা গল্প বের হয়েছিল একটা দৈনিকের সাহিত্য পাতায়। কী যে আনন্দ হয়েছিল সেই দিনগুলোতেই বলে বোঝাতে পারব না! আশ্চর্য সেসব দিন। আর...।’

‘আর?’

‘আর গানও গাইতে পারতাম, কোনো তালিম ছাড়াই শুধু রেডিওতে শুনে, সিনেমা দেখে, মেহেদি হাসানের গজল গাইতে পারতাম। আসলে সত্যি বলতে কি, জীবনে অনেক কিছুই হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই হয়নি।’

‘হয়নি বলছেন কেন? আপনার জীবন তো ফুরিয়ে যায়নি, স্যার? শিল্পের কোনো বয়স থাকে না। আপনি আবার গাইবেন, আবার লিখবেন, শুধু শুরু করাটা যা একটু কঠিন, তবে আপনার হবেই।’

‘সত্যি বলছেন?’

‘সত্যি বলছি স্যার, আপনি আবার গাইবেন, আবার লিখবেন...।’

কথাগুলো শুনে সূর্য ডুবে যাওয়ার আগমুহূর্তের আকাশের দিকে তাকালেন রহমান সাহেব। প্রবাল রঙের আকাশ তাঁর সামনে। লেকের কালো পানির ওপর বাতাসের ঝিরঝির কম্পন নেই এখন। সবকিছু কেমন শান্ত। শুধু দূরের রাস্তায় গাড়িগুলো ছুটে চলেছে। আগত সন্ধ্যায় আবদুর রহমান কিছুটা আত্মমগ্ন হলেন। মেয়েটা রহমান সাহেবের কাছে সরে বসল একটু গা ঘেঁষে। আচমকা মেয়েটি রহমান সাহেবকে জড়িয়ে ধরে একজনকে বলল, ‘কেমন লাগছে দেখুন তো?’

চকিতে দুজন যুবক রহমান সাহেবের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল, ‘শালা সন্ধ্যাবেলা খারাপ মেয়েছেলে নিয়ে পার্কে লুচ্চামি করা হচ্ছে।’

‘এসব কী বলছ তোমরা! আমাকে চেনো? আমি একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক।’

একজন রহমান সাহেবের শার্টের কলার চেপে ধরে বলল, ‘চুপ, একদম চুপ। তার অন্য হাতে ধারালো ছুরি। অন্য যুবক রহমান সাহেবের হাতের ঘড়ি, পকেটের মোবাইল, টাকা—সবকিছু কেড়ে নিল। দ্রুত পার্ক থেকে বেরিয়ে গেল ওরা। আবদুর রহমান পেছন পেছন ‘ছিনতাইকারী, ছিনতাইকারী’ বলতে বলতে ছুটে গেলেন। ততক্ষণে ওরা একটা মোটরসাইকেলে চেপে দ্রুত পগারপার। সামনে দুজন পুলিশ সদস্য দাঁড়িয়ে ছিলেন। রহমান সাহেব তাঁদের কাছে গিয়ে দ্রুত সবকিছু বলে আঙুল তুলে দেখালেন, ওই যে ওই যে, ওই মোটরসাইকেলের ছেলেমেয়েগুলো, হ্যাঁ ওরাই ছিনতাইকারী, ধরুন, আমার সবকিছু নিয়ে পালিয়ে গেছে।

রহমান সাহেবের চারপাশে তখন কিছু মানুষের ভিড়। সবাই বলছে পুলিশ কী করবে, ওরা তো এখন ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে।

আবদুর রহমান সাহেব অবাক। একমুহূর্তে ওরা তিনজন কীভাবে তাঁকে অপদস্থ করে মোবাইল ফোন আর ঘড়িটা নিয়ে চলে গেল! রেবেকার ছোট ভাই আবুধাবি থাকে, এবার দেশে এসে ওই ফোন আর ঘড়িটা তাঁকে উপহার দিয়েছিল, দুটোই খুব দামি জিনিস। রহমান সাহেব রাগ করে এ পার্কে এসে বসেছিলেন, তাঁর ৫৮ বছরের জীবনে এমন সুন্দর মুহূর্ত এর আগে কখনো আসেনি। কিন্তু মেয়েটা আর ছেলে দুটো তাকে এভাবে অপমান-অপদস্থ করে সবকিছু নিয়ে গেল!

আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো রহমান সাহেবকে দেখছিল বোকার মতো। রহমান সাহেবের ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল সত্যি, কিন্তু এটাও সত্যি যে মেয়েটা তাঁর মধ্যে এক অসীম সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলেছিল, যা এর আগে কেউ কখনো করেনি!