‘গার্ল উইথ বেলুন’
‘গার্ল উইথ বেলুন’

ব্যাঙ্কসি: গোপন পরিচয়ে বিশ্বকে বুড়ো আঙুল দেখানো এক শিল্পী

শিল্পের সঙ্গে বিপ্লবের সম্পর্ক পুরোনো ও গভীর এবং অনেক ক্ষেত্রে আকাঙ্ক্ষিতও। সাধারণ মানুষের কাছে শিল্পী মানেই খামখেয়ালি, প্রথাবিরোধী, বিচ্ছিন্ন ও রহস্যময়। ব্রিটিশ শিল্পী ব্যাঙ্কসির বেলায় এসব তকমার বাইরেও জুড়ে দিতে হয় আরও কিছু। কারণ, মানুষকে নিজের কথা শোনাতে এমনকি আইনের সীমা লঙ্ঘনেরও সাহস রাখেন তিনি। আর এ সবকিছুই করেন নিজেকে আড়ালে রেখে।

ব্যাঙ্কসি কে, কোথায় থাকেন, কবে তাঁর নতুন কাজ প্রদর্শিত হবে, তা কেউ জানেন না। কিন্তু নিজের শিল্পকর্ম তিনি এমন জায়গায় করতে পছন্দ করতেন, যা সবার চোখে পড়বে। রাষ্ট্র, ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন শহুরে স্থানকে নিজের চিত্রকর্মের প্রদর্শনীস্থলে পরিণত করেন তিনি। আর স্ট্রিট আর্টের ধর্মই তা–ই, যা নিজের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অনেকটাই গ্রহণ করেছে গেরিলা আর্ট থেকে।

ব্যাঙ্কসির আরেকটি চিত্রকর্ম

গেরিলা আর্ট হলো, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় বা প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে নিজের শিল্পকে হাতিয়ার করে তোলা এবং বিধিনিষেধের বেড়াজালকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করা। সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে নিউইয়র্ক ও ফিলাডেলফিয়ায় গ্রাফিতি যেভাবে হয়ে উঠেছিল কৃষ্ণাঙ্গদের ভাষা। এ প্রসঙ্গে এ–ও বলা দরকার, এই সব কটা শিল্পধারাকে এখনো ‘বর্বরতা’ হিসেবে দেখা হয় এবং পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে এ ধরনের শিল্পধারার প্রয়োগ দণ্ডনীয় অপরাধও বটে, যুক্তরাজ্যও তেমনই এক দেশ।

ব্যাঙ্কসি নামটি আবির্ভূত হতে শুরু করে নব্বইয়ের দশকে ব্রিস্টলে। নদীঘেঁষা এই শহর ‘কাউন্টারকালচার’ তৎপরতার জন্য সুপরিচিত। ‘কাউন্টারকালচার’ বলতে মূল ধারা বা ক্ষমতাসীন সাংস্কৃতিক ও আদর্শিক অবস্থান এবং মূল্যবোধের বিপরীতে অবস্থান নেওয়া। এই অবস্থান প্রায় শতভাগ ক্ষেত্রেই ‘কালচারাল হেজিমনি’ বা সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে। তো এমন এক শহরের দেয়ালে, রেলস্টেশনে, ট্রেনের বগিতে স্প্রে পেইন্টে গ্রাফিতি আঁকতে শুরু করেন ব্যাঙ্কসি। এরপর তিনি স্টেনসিল পদ্ধতিতে করতে শুরু করেন স্ট্রিট আর্ট। স্টেনসিল হলো কাগজ কেটে ছাঁচ তৈরি করে তার ওপর স্প্রে পেইন্ট বা রোল ওভার পেইন্টের মাধ্যমে চিত্রকর্ম তৈরি করা।

২০০০ সালের পর থেকে ব্যাঙ্কসি নামটি পরিচিতি পেতে শুরু করে তাঁর স্বকীয় ব্যঙ্গাত্মক ও তির্যক হাস্যরসাত্মক ভঙ্গির কারণে। বিভিন্ন জনপ্রিয় কাল্পনিক ও বাস্তব চরিত্রের ব্যঙ্গাত্মক উপস্থাপনার পাশাপাশি নিজস্ব চরিত্রও তৈরি করেছেন তিনি। সেই সঙ্গে জন্ম দিয়েছেন শিল্প ইতিহাসের অভাবনীয় ও স্মরণীয় কিছু মুহূর্তের। কিন্তু ২০১৮ সালে ব্যাঙ্কসি যা ঘটান, তাকে কেউ কেউ বলেন শিল্প আর কেউ কেউ বলেন মশকরা।

ব্যাঙ্কসির আরেকটি চিত্রকর্ম

তবে বিশ্বখ্যাত চিত্রকর্ম নিলামকারী প্রতিষ্ঠান সদাবি’স সেই ঘটনাকে আখ্যায়িত করেছেন ‘সরাসরি নিলামের সময় সৃষ্ট ইতিহাসের প্রথম শিল্প’ হিসেবে। ২০০৬ সালে পূর্ব লন্ডনের দেয়ালে স্টেনসিল করা চিত্রকর্ম ‘গার্ল উইথ বেলুন’-এর একটি ফ্রেমবদ্ধ কপি নিলামে তোলে সদাবি’স। ১৪ মিলিয়ন পাউন্ডে বিক্রি হয় চিত্রকর্মটি। নিলামের হাতুড়ির শেষ বাড়িটি পড়তেই অ্যালার্ম বাজতে শুরু করে এবং ছবিটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফালি ফালি হয়ে ফ্রেম থেকে বের হয়ে আসতে শুরু করে। তবে ছবিটি অর্ধেক ধ্বংস হওয়ার পর থেমে যায়। এ প্রক্রিয়ার একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করে ব্যাঙ্কসি লেখেন, ‘যাচ্ছে, যাচ্ছে, গেল…।’

পরে তিনি জানান, ছবিটিকে পুরোপুরি ধ্বংস করার উদ্দেশ্যেই ফ্রেমের ভেতর একটি যন্ত্র স্থাপন করা হয়েছিল এবং নিলামকারী প্রতিষ্ঠান এ বিষয়ে একেবারেই অবগত ছিল না। যদিও যে ইউরোপীয় নারী ছবিটি কিনেছিলেন, তিনি পুরো দামই মিটিয়েছিলেন এবং এখনো এ ছবির মালিক তিনি। তবে এখন এই শিল্পকর্মের নাম ‘লাভ ইন দ্য বিন’ অর্থাৎ ‘ভালোবাসা আস্তাকুঁড়ে’। বরাবরই শিল্পকর্ম বিক্রিকেও কোনো না কোনোভাবে নিজের শিল্পপ্রক্রিয়ার অংশ করে তুলেছেন ব্যাঙ্কসি।

২০১০ সালে টাইম ম্যাগাজিনের শত প্রভাবশালীর তালিকায় ব্যাঙ্কসি জায়গা করে নেওয়ার পর মার্কিন শিল্পী শেফার্ড ফেইরি তাঁর সম্পর্কে লিখেছিলেন, ব্যাঙ্কসি নন্দনতত্ত্ব আর ভাষার মাঝখানের রেখার ওপর ছবি আঁকেন, তারপর গোপনে অকল্পনীয় সব স্থানে সেগুলো আবার আঁকেন। তাঁর কাজ, সেটা তিনি রাস্তায় স্টেনসিল করুন, প্রদর্শনীতে বিক্রি করুন বা কৌশলে জাদুঘরে ঝোলান, সেগুলো চাতুর্য ও রূপকে পরিপূর্ণ এবং ভাষার প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করে।

শরণার্থী সমস্যার দিকে বারবার নজর ফেরাতে বাধ্য করেছেন ব্যাঙ্কসি। ফ্রান্সের ক্যালেতে শরণার্থীশিবিরের বাইরের দেয়ালে অ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবসকে তিনি আঁকেন শরণার্থী হিসেবে

২০১৫ সালে ডিজনিল্যান্ডের আদলে দক্ষিণ–পশ্চিম ইংল্যান্ডের সামারসেটে তিনি গড়ে তোলেন ডিজমাল্যান্ড। এই ‘হতাশানগর’-এ ডিজনি রাজকন্যাদের দেখা মেলে ঠিকই, তবে তারা কঠোর বাস্তবতার আবর্তে ঘেরা। আর সেই সঙ্গে আছে শরণার্থীদের নৌকার খেলা। যে পৃথিবীতে আমরা বসবাস করি, মাত্র তিন পাউন্ডের টিকিট কেটে তার প্রকৃত চেহারা দেখতে দর্শনার্থীদের উৎসাহিত করা হয়।

শরণার্থী সমস্যার দিকে বারবার নজর ফেরাতে বাধ্য করেছেন ব্যাঙ্কসি। ফ্রান্সের ক্যালেতে শরণার্থীশিবিরের বাইরের দেয়ালে অ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবসকে তিনি আঁকেন শরণার্থী হিসেবে। বাস্তবে একজন সিরীয় শরণার্থীর সন্তান স্টিভ জবস। ‘দ্য সন অব আ মাইগ্র্যান্ট ফ্রম সিরিয়া’ নামের সেই চিত্রকর্ম নিয়ে তিনি লেখেন, ‘আমাদের অনেক সময় বোঝানো হয় যে শরণার্থীরা একটি দেশের সম্পদ শুষে নেয়, কিন্তু স্টিভ জবস একজন সিরীয় শরণার্থীর সন্তান। অ্যাপল বিশ্বের সবচেয়ে লাভজনক প্রতিষ্ঠান। এটি প্রতিবছর সাত বিলিয়ন ডলারের বেশি কর দেয় এবং এটা সম্ভব হয়েছে কারণ তারা হমস থেকে আসা এক তরুণকে থাকতে দিয়েছে।’

ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে বহু বছর ধরেই সোচ্চার ব্যাঙ্কসি। গাজার পশ্চিম তীর, বেথেলহেম ও জেরুজালেমে তিনি ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরোধিতায় বহু চিত্রকর্ম তৈরি করেছেন। ২০১৭ সালে ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ শাসনের শত বছর পূর্তিতে তিনি বেথেলহেমে প্রতিষ্ঠা করেন ওয়ার্ল্ড অব হোটেল। বলা হয়, বিশ্বের সবচেয়ে নিকৃষ্ট দৃশ্য দেখা যায় এ হোটেল থেকে। প্রতিটি কক্ষ থেকে চোখে পড়ে পশ্চিম তীরে তোলা ইসরায়েলি দেয়াল আর সেই সঙ্গে শয্যার ওপর ব্যাঙ্কসির আঁকা চিত্রকর্ম, যেন এক ইসরায়েলি সীমান্তসেনা বালিশযুদ্ধ করছেন এক ফিলিস্তিনির সঙ্গে।

ব্যাঙ্কসির আরেকটি চিত্রকর্ম

‘অপরাধী’, ‘ধ্বংসকারী’, ‘বর্বর’, ‘ভুয়া’সহ নানা তকমা জুটেছে ব্যাঙ্কসির কপালে। তাঁর চিত্রকর্ম মুছে ফেলা হয়েছে, ভেঙে ফেলা হয়েছে, অপসারণ করা হয়েছে। তিনি আবার এঁকেছেন। নজরদারির এই দুনিয়াকে বারবার বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজেকে গোপন রেখেছেন। সেই সঙ্গে ছুড়ে যাচ্ছেন একের পর এক প্রশ্নবাণ। ভোগবাদী ব্যবস্থায় মানুষের ক্রমাগত পণ্যের গোলাম হয়ে ওঠা, আধিপত্যবাদ যে কল্পিত বাস্তবতার জাল ছড়িয়ে রেখেছে, তাকেই গ্রহণ করা আর ক্ষমতাধরের আগ্রাসনকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে প্রতিষ্ঠানকে বিদ্রূপ করেন ব্যাঙ্কসি। আধিপত্যবাদের খোলস ভেঙে বারবার অস্বস্তিতে ফেলেন ক্ষমতাসীনদের। ব্যাঙ্কসির সঙ্গে এই দড়ি–টানাটানির খেলায় শেষ পর্যন্ত জয়টা হয়তো আমাদের মতো আমজনতারই হয়।