বাংলাদেশের স্বপ্ন এবং একজন আনিসুজ্জামান

১৪ মে প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এ রচনা

আনিসুজ্জামান (১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৭—১৪ মে ২০২০)

যাঁদের জীবন অধ্যয়ন করে একালের বাঙালি মুসলমানের ইতিহাসের বাঁকগুলোকে চিহ্নিত করা যায়, আনিসুজ্জামান তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। ইতিহাসের স্রোত তাঁকে নিয়ে গেছে জন্ম থেকে পরিণতির দিকে। আবার ইতিহাসের বাঁক পরিবর্তনে কখনো তিনি নিয়েছেন অগ্রণী ভূমিকা। তাঁর পরিবারের ইতিহাসের মধ্যেও রয়েছে একই স্রোত। তাঁর দাদা শেখ আবদুর রহিম (১৮৫৯-১৯৩১) ছিলেন সেকালের বাঙালি মুসলমান বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে উজ্জ্বল নক্ষত্র। মিহির ও সুধাকরসহ বিভিন্ন পত্রিকা সম্পাদনা, বাংলায় রাসুল (সা.)–এর জীবনী রচনা প্রভৃতির মধ্য দিয়ে একদিকে তিনি স্বীয় ধর্মাবলম্বীদের মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে প্রস্তুত করেছিলেন, অন্যদিকে ছিলেন অসাম্প্রদায়িক মনোভাবেরও প্রতিভূ। আনিসুজ্জামানের বাবা ড. এ টি এম মোয়াজ্জম কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হোমিও চিকিৎসক ছিলেন। ১৯৪৬ সালের ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং ১৯৪৭-এর দেশভাগ এই পরিবারকে নিয়ে আসে খুলনা হয়ে ঢাকায়। পশ্চিমবঙ্গের অসংখ্য মুসলমান পরিবার এ স্রোতে পূর্ববঙ্গে এসেছিল ছিন্নমূল হয়ে। আবার পূর্ববঙ্গের অনেক হিন্দু পরিবার একইভাবে ছিন্নমূল হয়ে পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নেয়। আনিসুজ্জামান এভাবেই জড়িয়ে যান ওই ইতিহাসের স্রোতে।

এ স্রোতে চলতে চলতে একসময় ইতিহাসের বাঁকবদলে সক্রিয় অংশীদার হয়ে ওঠেন আনিসুজ্জামান, যার শুরু পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগে যোগ দেওয়ার মাধ্যমে। যুবলীগ গঠিত হয় ১৯৫১ সালে মুসলিম লীগ সরকারের রোষের মুখে বুড়িগঙ্গা নদীতে এক ভাসমান বোটে। মাত্র ১৫ বছর বয়সে এ সংগঠনের দপ্তর সম্পাদক হয়েছিলেন আনিসুজ্জামান।

তবে আনিসুজ্জামানের প্রকৃত দ্বিতীয় জন্ম বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে। পাকিস্তানের স্বপ্ন ও মোহ ভেঙে এ আন্দোলন সে সময়ের ছাত্র-যুবসমাজকে নবজন্ম দিয়েছিল। ভাষা আন্দোলনে আনিসুজ্জামানের কার্যকলাপের শুরু জগন্নাথ কলেজের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য হিসেবে। ৪ ফেব্রুয়ারির ছাত্র ধর্মঘট ও বিক্ষোভ মিছিল করতে তাঁর দায়িত্ব পড়ে পোগোজ স্কুল ও সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে। প্রথমটিতে ছাত্র ধর্মঘট সংঘটনে তিনি সফল হন; দ্বিতীয়টি পুলিশের বাধায় পণ্ড হয়। ১১ ফেব্রুয়ারি পতাকা দিবসে ‘চাঁদার টিন’ নিয়ে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ট্রেনে অর্থ সংগ্রহ করেন; টিনের ওপর সাঁটানো কাগজে লেখা ছিল—‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। অন্যদিকে যুবলীগের পক্ষ থেকে জেলা শাখায় ভাষা আন্দোলনকে সংগঠিত করার কাজে দপ্তর-সম্পাদক তিনিই চিঠিপত্র পাঠাতেন। এ ছাড়া পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, স্টেট ব্যাংক ট্রেড ইউনিয়ন, পূর্ব পাকিস্তান শ্রমিক ফেডারেশন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রভৃতিতে যুবলীগের পক্ষ থেকে যোগাযোগও রাখতেন তিনি। তবে এ সময়ে আনিসুজ্জামানের বড় কাজ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন: কী ও কেন? শীর্ষক পুস্তিকা রচনা।

২০ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা জারির পর আওয়ামী মুসলিম লীগ অফিসে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের যে জরুরি সভা হয়, তাতে জগন্নাথ কলেজের সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে পর্যবেক্ষক হিসেবে আনিসুজ্জামান ও সৈয়দ আহমদ হোসেন উপস্থিত ছিলেন। ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে নেয়ামাল বাসির, তোফাজ্জল হোসেন, আলী আশরাফ ও আনোয়ার হোসেন অনুকে নিয়ে আনিসুজ্জামান যান কলাভবনের জমায়েতে। সমাবেশের পর শুরু হয় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা। তৎকালীন যুবলীগ নেতা অলি আহাদ সে সময় আনিসুজ্জামানের হাতে যুবলীগ অফিসের চাবি বুঝিয়ে দিয়ে বলেন, তিনি যেন গ্রেপ্তার না হয়ে যুবলীগ অফিসে গিয়ে সব কাগজপত্র নিজের কাছে নিয়ে যান। এর কিছুক্ষণের মধ্যে প্রথমে লাঠিপেটা, কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়া ও গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। এ সময় ১৫ বছর বয়সী আনিসুজ্জামান আবারও একটি ঐতিহাসিক ঘটনায় জড়িয়ে যান। তাঁর ভাষায়—

কীভাবে যেন মেডিকেল কলেজের ১১ নম্বর ব্যারাকে (গেটের সংলগ্ন) একটা মাইক্রোফোন এনে বসানো হলো। মোহাম্মদ তোয়াহার বাংলায় বক্তৃতা করার অভ্যাস ছিল না। তিনি আমাকে বললেন, লিখে লিখে দিতে এবং সেটা দেখে তিনি পড়তে থাকলেন। কিন্তু মুখের কথার সঙ্গে লেখার গতির মিল হয় না। সুতরাং একসময়ে লেখার টান পড়ল। তোয়াহা ভাই এক-আধটা কথা যোগ করে বক্তব্য শেষ করে আমাকে মাইক্রোফোন দিলেন। বক্তৃতার অভ্যাস আমারও ছিল না কোনো ভাষাতেই। কয়েক বছর আগে পুলিশ ধর্মঘটের সময়ে সেনাবাহিনীকে দিয়ে পুলিশের ওপরে গুলি চালনা করা হয়েছিল। সেই কথার উল্লেখ করে, মাতৃভাষার দোহাই দিয়ে, পুলিশের উদ্দেশে কিছু বললাম। ততক্ষণে অনেক বক্তা জড়ো হয়েছেন।

২৩ ফেব্রুয়ারি আনিসুজ্জামান তাঁর বাবার রেডক্রস চিহ্ন লাগানো গাড়িকে লক্ষ্মীবাজার থেকে মাইক লাগিয়ে মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে যান সমাবেশে যোগ দিতে। সে মাইক থেকেই দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়। সেদিনই আনিসুজ্জামানের মা নবনির্মিত শহীদ মিনারে তাঁর মৃত কন্যার সোনার হার নিবেদন করেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ধর্মঘটের ডাক দিয়ে যে প্রচারপত্র তৈরি হয়, তার খসড়া ও মুদ্রণের দায়িত্বেও ছিলেন আনিসুজ্জামান। ভাষা আন্দোলনের সময় আত্মগোপনকারী নেতাদের মধ্যে যোগাযোগের ক্ষেত্রেও তাঁর সক্রিয় ভূমিকা ছিল।

মাত্র ১৫ বছর বয়সী একজন ছাত্রের এসব কর্মের মধ্যেই পরবর্তী সময়ের আনিসুজ্জামানকে দেখা যায়। ১৯৫০-এর দশকের নানা আন্দোলন-সংগ্রামেই তাঁর ওই পথচলা থামেনি। অথচ এই দশকেই ভালো ফল করে তিনি অনার্স-মাস্টার্স পাস করেছিলেন। পেয়েছিলেন কালিনারায়ণ বৃত্তি ও বাংলা একাডেমি গবেষণা বৃত্তি। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক হয়েছিলেন। পদচিহ্ন রেখেছিলেন ঢাকার শিক্ষা ও সংস্কৃতির জগতে।

১৯৫৯ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারির পর সরকারের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলায় বড় ধরনের প্রতিরোধ গড়ে ওঠে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীকে কেন্দ্র করে। এর পরপরই বাষট্টির ঐতিহাসিক ছাত্র আন্দোলন। রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদ্‌যাপনে আনিসুজ্জামান সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। পরে পাকিস্তানের বেতার ও টেলিভিশনের রবীন্দ্রসংগীত বন্ধের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হয়, তাতে ছিল তাঁর অগ্রণী ভূমিকা।

এরপরের পর্ব উনসত্তরের গণ-আন্দোলন। এ আন্দোলনে নেতৃত্বে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও ছিলেন তাঁদের সঙ্গে। কাল নিরবধিতে পাওয়া যায়—

প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, মিছিল, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ। তার মধ্যে ২০ জানুয়ারিতে পুলিশের গুলিতে আসাদুজ্জামান নিহত হলো। খবর পেয়ে আমরা কজন পায়ে হেঁটে বের হলাম। কার্জন হল পেরিয়ে চানখাঁর পুলের দিকে আসতে দেখি, আসাদের রক্তাক্ত শার্ট নিয়ে মিছিল হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি থেকে সেদিনই আমরা প্রতিবাদ জানালাম, মৌন মিছিল করলাম পরদিন।...মনে হলো, জীবন আর আগের মতো রইল না।

এর কয়েক দিন পরেই পুলিশের গুলিতে শহীদ হন স্কুলছাত্র মতিউর ও রুস্তম। ওদিকে কর্তব্যরত অবস্থায় সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহা। এর প্রতিবাদে ১৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে সভা হলো। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকনেতারা তাতে অংশ নিলেন। ওই সভাতেই পূর্ব পাকিস্তানের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে অবিরাম শিক্ষক ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত হয়। আনিসুজ্জামান তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির যুগ্ম সম্পাদক।

উনসত্তরের গণ-আন্দোলনের বিজয়ের মুখে পাকিস্তান সরকার ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে। এ সময়ে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানে গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান করানোর চেষ্টা করা হয়। আনিসুজ্জামানের বয়ানে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা—

এর আগে আইয়ুব খান শেষরক্ষা করতে চেয়েছিলেন রাজনীতিবিদদের সঙ্গে গোলটেবিল আলোচনা করতে চেয়ে। এর জন্য তিনি শেখ মুজিবকে প্যারোলে মুক্তিদানের প্রস্তাব করেন। আমার বাসায় এক সকালে দুই ব্যারিস্টার—আমীর-উল ইসলাম ও মওদুদ আহমদ এলেন। আমীর-উল আর মওদুদ বললেন, শেখ সাহেবকে প্যারোলে ছেড়ে গোলটেবিলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। আমি যেন তখনই ড. কামাল হোসেনকে গিয়ে বোঝাই, এটা ঠিক হবে না। তদ্দণ্ডেই কামালের কাছে গেলাম। দেখলাম, আমার আসার দরকার ছিল না, কামাল নিজেই এ শর্ত মানতে অনিচ্ছুক। পরে শুনেছিলাম, শেখ সাহেবের প্যারোলে পিন্ডি যাওয়ার ব্যাপারে প্রবল আপত্তি করেছিলেন বেগম মুজিব।

এর পরেই চলে আসে ১৯৭১-এর মার্চ মাস, মুক্তিযুদ্ধের আগমুহূর্ত। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ চট্টগ্রামে প্রচারিত হয় ৮ মার্চ। ওই দিনই সকাল ১১টায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সভা হয় উপাচার্য এ আর মল্লিকের সভাপতিত্বে। তাতে বক্তৃতা করেন আনিসুজ্জামান। সেদিনই গঠিত হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদ। একই দিন বিকেলে চট্টগ্রাম শহরের ‘সাহিত্য নিকেতন’-এ অধ্যাপক আবুল ফজলের সভাপতিত্বে স্থানীয় সংস্কৃতিসেবীদের একটি সভা হয়। তাতেও আনিসুজ্জামানের ছিল সক্রিয় ভূমিকা। এর চার দিন পর সাহিত্য নিকেতনে আরেক সভায় চট্টগ্রাম বেতার বর্জনের সিদ্ধান্ত হয়। কর্তৃপক্ষ এ পরিস্থিতিতে প্রতিবাদী অনুষ্ঠানের দাবি মেনে নেয়। ১৫ মার্চ লালদিঘি ময়দানে শিল্পী-সাহিত্যিক-সংস্কৃতিসেবীদের সমাবেশ হয়। এ সভায়ও তিনি অংশ নেন।

এভাবেই আসে ২৫ মার্চ রাত। ২৬ মার্চ বিকেলে ছাত্রলীগের এককালীন নেতা রফিকুল আলম টেলিফোনে একটি ইংরেজি বার্তার ‘ডিকটেশন’ দেন আনিসুজ্জামানকে। সেটা ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা।

১ এপ্রিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ত্যাগ করেন আনিসুজ্জামান। কুণ্ডেশ্বরী ও কয়েকটি জায়গা ঘুরে ১০ এপ্রিল পৌঁছান রামগড়। পথে জীবন বিপন্ন করে খালের পানির মধ্য দিয়ে গাড়ি চালিয়েছিলেন তিনি। ২৬ এপ্রিল তাঁরা পৌঁছালেন আগরতলায়। আগরতলায় তখন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ চলছে। তাঁদের জন্য একটা পাঠক্রম তৈরি করেন আনিসুজ্জামান, ওসমান জামালকে সঙ্গে নিয়ে। পরে নিজের গাড়িটা মুক্তিযোদ্ধাদের কাজের জন্য দিয়ে সপরিবার তিনি চলে যান কলকাতায়।

কলকাতায় তাঁর প্রথম কাজ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির অফিসে। প্রতিদিন গিয়ে বাংলাদেশ থেকে আসা শরণার্থী শিক্ষকদের সহায়তা করতেন। তত দিনে ভারতে চলে গেছেন পূর্ব বাংলার কয়েক হাজার স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তাঁদের নিয়ে একটা সমিতি গঠিত হলো। ১১ জ্যৈষ্ঠ আনিসুজ্জামানের কণ্ঠ শোনা গেল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। কলকাতায় বাংলাদেশ থেকে যাওয়া শিল্পী-সাহিত্যিকদের সংগঠিত করতেও উদ্যোগ নেন তিনি। এর মধ্যে কলকাতার মুক্তধারা প্রকাশ করে আনিসুজ্জামানের মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য-এর নতুন সংস্করণ। একই সময়ে তিনি যুক্ত হন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের সঙ্গে। আনিসুজ্জামানের ভাষ্যে—

আমি কলকাতায় আসার পরে, প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা বা বিবৃতি লেখার সময় হলে থিয়েটার রোডে আমার ডাক পড়ত। প্রধানমন্ত্রীর শয়নকক্ষে গিয়ে হয় দেখতাম অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ অপেক্ষা করছেন, নয় অনতিবিলম্বে তিনি এসে পড়তেন। প্রথমে তাজউদ্দীন আমাদের কাছে পরিস্থিতি অথবা পরিস্থিতির যতটা তিনি বলতে চান, তা ব্যাখ্যা করতেন। তারপর বক্তৃতা বা বিবৃতিতে কী থাকা দরকার বলে উনি মনে করেন, সে কথা বলতেন এবং সে সম্পর্কে আমাদের পরামর্শ চাইতেন। আমিই সাধারণত আলোচনার নোট রাখতাম। এমন করে আলোচনার ভিত্তিতে একমত হওয়ার পরে আমি বাংলা খসড়া করতাম।

পাশাপাশি চলছিল কলকাতার বাইরে ভারতবর্ষের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বক্তৃতা ও আলোচনা। জুন মাসের মাঝামাঝিতে আনিসুজ্জামানসহ একটি প্রতিনিধিদল দেখা করলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে।

মুক্তিযুদ্ধকালে আনিসুজ্জামানের সর্বশেষ কর্মস্থল ছিল পরিকল্পনা সেলে। খান সারওয়ার মুরশিদ, মুশাররফ হোসেন ও স্বদেশরঞ্জন বসুর সঙ্গে তিনি এই সেলের সদস্য হন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় নানা রকম কাজেই ব্যাপৃত ছিলেন আনিসুজ্জামান। সর্বশেষ ১৬ ডিসেম্বরে লিখেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা। তাঁর স্মৃতিকথায় পাওয়া যায়—

একফাঁকে প্রধানমন্ত্রী বললেন, “আমার বক্তৃতা লিখা দিবেন না?” ওই ঘরের মধ্যেই একটা টেবিলের ধারে চেয়ার টেনে লিখতে বসলাম। ঢাকা যে মুক্ত হয়েছে, বাংলাদেশ যে স্বাধীন হয়েছে, সে কথা কেউ মুখ ফুটে বলেননি আমাকে। আশপাশ থেকে আভাসে-ইঙ্গিতে আমি তা জেনে নিয়েছিলাম। এই বাস্তবতা একটু একটু করে সঞ্চারিত হয়েছিল আমার মনে এবং লেখায়। আমি অল্প কয়েকটি শব্দের বাক্যে, অল্প কয়েকটি বাক্যের অনুচ্ছেদে, অল্প কয়েকটি অনুচ্ছেদের একটি বক্তৃতার খসড়া তৈরি করলাম।

বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। কিন্তু অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের কাজ থামেনি। বাংলাদেশের সংবিধানের বাংলা ভাষ্য রচনা, শিক্ষা কমিশনের কাজ, এরশাদবিরোধী আন্দোলন, ২০০১-পরবর্তী সাম্প্রদায়িক সংঘাত নিরোধ, ভয়ভীতি উপেক্ষা করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে সাক্ষ্য দেওয়া—দেশের কাজে তিনি নিরত ছিলেন মৃত্যু পর্যন্ত।

যাঁরা শিক্ষকতা বা সাহিত্যচর্চার মতো পেশায় থাকেন, তাঁদের অনেকে দেশের কাজে একটা দূরত্ব রেখে চলেন। আনিসুজ্জামান শিক্ষকতা, গবেষণা, সংস্কৃতির অঙ্গনে নেতৃত্বের পাশাপাশি ব্যাপৃত হয়েছিলেন দেশের কাজে—যে স্বপ্ন নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, সেই বাংলাদেশ গড়া ছিল তাঁর আকাঙ্ক্ষার অংশ। এক সংবর্ধনা সভায় আনিসুজ্জামান বলেছিলেন, জীবনকে তিনি কানায় কানায় উপভোগ করেছেন। নাগরিক হিসেবে যে বাংলাদেশ তিনি চেয়েছিলেন, তার অপূর্ণতায় তাঁর খেদ ছিল; কিন্তু ব্যক্তিজীবনে তাঁর না-পাওয়ার কোনো অতৃপ্তি ছিল না।

আজ বাংলাদেশ আছে। আর তার মধ্যেই আছেন একজন আনিসুজ্জামান।