৭৮ বছর বয়সে মারা গেলেন শিবনারায়ণ দাস
৭৮ বছর বয়সে মারা গেলেন শিবনারায়ণ দাস

স্বাধীন বাংলার মানচিত্রখচিত পতাকার নকশাকার শিবনারায়ণ দাসের প্রয়াণ

চোখের শূন্যতার মধ্যেই তিনি লুকিয়ে রেখেছিলেন বেদনা আর অপ্রাপ্তি

স্বাধীন বাংলার মানচিত্রখচিত পতাকার নকশাকার ও জাসদ নেতা, বীর মুক্তিযোদ্ধা শিবনারায়ণ দাস মারা গেছেন। আজ শুক্রবার সকালে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৭৮ বছর বয়সে মারা যান তিনি। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা।

আমরা ‘শিবুদা’ বলতাম। আন্তরিক সম্পর্কে নাম উচ্চারণ আশ্চর্য ছোট আর নিবিড় হয়ে আসে আমাদের সমাজে। আজ সকালে প্রয়াত হলেন স্বাধীন বাংলার মানচিত্রখচিত প্রথম পতাকার নকশাকার শিবনারায়ণ দাস। আমাদের প্রিয় শিবুদা। তাঁর সঙ্গে আমার নানা মাত্রায় সম্পর্ক ছিল, যা নিয়ে বিস্তারিত লিখতে হলে সময় ও ভাবনার বড় পরিসর প্রয়োজন। এখন দ্রুত মনে পড়ছে অল্প কিছু কথামাত্র।

গেল শতকের নব্বইয়ের দশকে তাঁকে যখন খুঁজে পেয়েছিলাম, তখন তিনি আর রাজনীতিতে সক্রিয় নেই। বউদির কাজের সুবাদে চট্টগ্রামে থাকতেন। তখন তাঁর বাসায় গিয়ে থেকেছি, রাজনীতিতে আবার ফিরে আসার সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলেছি, বাটালি হিলের উচ্চতায় উঠে সূর্যাস্ত দেখেছি কিংবা আমরা ঘুরতে গেছি প্রকৃতি শাসিত ফয়’স লেকে।

শিবুদার বৃহত্তর পরিবার কুমিল্লায় থাকত। শিবুদা চট্টগ্রাম থেকে কুমিল্লায় আসা–যাওয়া করতেন। নব্বইয়ের গণ–অভ্যুত্থানের সময় আমরা শিবুদাকে কুমিল্লায় পেয়েছি। অভ্যুত্থানপরবর্তী সংসদ নির্বাচনে তিনি বাম ঐক্যের প্রার্থী হয়েছিলেন। নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে গিয়ে আমরা শিবুদাকে নিয়ে কুমিল্লার পথে–প্রান্তরে ঘুরেছি। বুঝতে পেরেছিলাম যে আন্দোলনে আমরা যতটুকু স্বচ্ছন্দ, নির্বাচনে (পুঁজির দাপটে) ঠিক ততটুকুই অসহায়। নব্বইপরবর্তী সংসদীয়-বুর্জয়া গণতান্ত্রিক প্রাতিষ্ঠানিক যাত্রায় শিবুদা ও আমরা অনেকটা কোণঠাসা, একা হয়ে পড়লাম। শিবুদা একপর্যায়ে ঢাকায় চলে গেলেন। আমারও প্রবাসপর্ব শুরু হয়েছিল।

যতটুকু জানি, শিবুদার ঢাকা বাস ছিল অনেকটাই নিভৃত। তিনি পরিবারসহ মনিপুরী পাড়ায় থাকতেন। নিজে তেমন কিছুই করতেন না। প্রায় ১৪ বছর আগে আমি ঢাকায় তাঁর একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। প্রবাস থেকে ফিরে দেখা হয়েছিল তাঁর সঙ্গে। শিবুদা আমার কমরেড হলেও অনেকটা ইচ্ছা করেই তাঁর সেই সাক্ষাৎকার নিই। আমার জানা কথাগুলো আবার নতুন করে শুনি। ভাবি, নতুন প্রজন্ম হয়তো একদিন জানতে চাইবে লোকটা সম্পর্কে। সে সময় সাক্ষাৎকারটি ইউটিউবে ছয় পর্বে আপলোড করা হয়েছিল।

পরেও মাঝেমধ্যে যখন দেখা হতো শিবুদার সঙ্গে, তখন কথা বলে বলে একসময় খুব ক্লান্ত হতেন। তারপর স্বাধীন বাংলার প্রথম পতাকার নকশাকার শিবনারায়ণ দাস তাকিয়ে থাকতেন শূন্যতার দিকে। সেই শূন্যতার সঙ্গী হয়েছি আমি অনেকবার। শিবুদার সেই তাকিয়ে থাকা, তাঁর চোখের শূন্যতার মধ্যেই সব অভাব–অভিযোগ, বেদনা, অপ্রাপ্তি আর অসম্মান লুকিয়ে থেকেছে। এই শূন্যতা ছাড়া তিনি কখনো কাউকে কিছু শব্দ করে বলেননি।

ভাবি, আহা, মৃত্যুর পরই মানুষ কেন এমন ব্যক্তিত্বদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইবে? কেন জীবদ্দশায় তাঁদের খোঁজ কেউ নেয় না? কেন যথাযথ সম্মান আর পুরস্কার নিয়ে রাষ্ট্র তাঁদের পাশে এসে একটু দাঁড়ায় না? কেন এমন একজন মানুষকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়? কেন কফিনের ফুলগুলো জীবন্ত মানুষটার কাছে তাঁর বেঁচে থাকার সময়ও কিছুটা ভালোবাসা হয়ে আসে না?

অথচ বলতে পারি, যাঁদের স্বপ্নে, সাহসে আর ত্যাগ ও অবদানে আমাদের দেশটা তিল তিল করে গড়ে উঠেছিল, শিবনারায়ণ দাস ছিলেন তাঁদেরই একজন। সমাজ–নায়ক। শিবুদা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের ‘নিউক্লিয়ার্স’ সেলের সঙ্গে কাজ করেছেন। নিউক্লিয়ার্স কর্তৃক আমাদের জাতীয় পতাকার পরিকল্পনা ও রূপায়ণে প্রধান নকশাকার হিসেবে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছেন তিনি।

রাষ্ট্র, সরকার, সমাজ থেকে শিবুদা পাননি তেমন কিছুই। কিছু আদায় করার চেষ্টা-ধরণ থেকেও মুক্ত ছিলেন শিবনারায়ণ দাস। তাঁর অর্থনৈতিক অবস্থাও খুব একটা ভালো ছিল না। প্রায় নিভৃত জীবন যাপন করেছেন সাধারণ মানুষের মতো। শেষ দিকে নানা ব্যাধি বাসা বেঁধেছিল তাঁর শরীরে। প্রস্থানও করতে হলো অনেকটা নীরবেই। হয়তো পতাকা দিয়ে তাঁর নিথর দেহ এখন মুড়িয়ে দেওয়া হবে, যা তিনি দেখবেন না।

ইতিহাস থেকে জানা যায় যে ১৯৭০ সালের ৬ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের ১১৬ নম্বর (বর্তমান ১১৭-১১৮) কক্ষে তৎকালীন ছাত্রনেতাদের মধ্যে নানা আলোচনার পর পতাকার নকশা ও পরিমাপ নির্ধারণ করা হয়। ওই দিন রাতেই নিউমার্কেট থেকে কাপড় কিনে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন কায়েদে আজম হলে (এখন তিতুমীর হল) কাজী আরেফ অন্যদের নিয়ে জাতীয় পতাকার কাজ শুরু করেন। পরে শেরেবাংলা হলে শিবনারায়ণ দাস—শিবুদার দক্ষ হাতে পরিসমাপ্তি হয়। তাঁর আঁকার হাত খুব ভালো ছিল বলেই তাঁকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। পরে দরজির দোকান থেকে সেলাই করে প্রথমে হলে লুকিয়ে, পরে এক ছাত্রলীগ নেতার মালিবাগের বাসায় রাখা হয়।

শিবনারায়ণ দাস

পরবর্তীকালে অনেকেই শিবুদাকে স্বাধীন বাংলার প্রথম পতাকার ‘রূপকার’ বলতে চেয়েছেন, কিন্তু যেহেতু পতাকার বিষয়টি নিউক্লিয়াসের সম্মিলিত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছিল, তাই এককভাবে কেউ ‘রূপকার’ হতে পারেন না। ‘নকশাকার’ সেই অর্থে অনেক যথাযথ অভিধা। শিবুদা যে এই পতাকার নকশা করেছেন, এ নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। যে পতাকা আজ স্বাধীন বাংলাদেশে নির্ভয়ে পতপত করে ওড়ে, সেই পতাকার ভ্রূণ যে নিশানের মধ্যে ছিল, তার নকশাকার ছিলেন শিবুদা।

রাষ্ট্র, সরকার, সমাজ থেকে শিবুদা পাননি তেমন কিছুই। কিছু আদায় করার চেষ্টা-ধরণ থেকেও মুক্ত ছিলেন শিবনারায়ণ দাস। তাঁর অর্থনৈতিক অবস্থাও খুব একটা ভালো ছিল না। প্রায় নিভৃত জীবন যাপন করেছেন সাধারণ মানুষের মতো। শেষ দিকে নানা ব্যাধি বাসা বেঁধেছিল তাঁর শরীরে। প্রস্থানও করতে হলো অনেকটা নীরবেই। হয়তো পতাকা দিয়ে তাঁর নিথর দেহ এখন মুড়িয়ে দেওয়া হবে, যা তিনি দেখবেন না। হয়তো এখন তাঁর মৃত্যু নিয়েই মাতবে সবাই। গাইবে বীরগাথা। কিন্তু শিবনারায়ণ দাস আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন চির অভিমানে, এটাই সত্যি কথা।