ভ্রমণ অথবা কোনো কার্যোপলক্ষে কুষ্টিয়ায় গেলে যে কারোরই ইচ্ছা জাগে ইতিহাস-ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ স্থানগুলোর অন্তত কয়েকটি স্থাপনা দর্শন করে আসার, যার মধ্যে প্রথমে মনে পড়বে, কুমারখালীর রবীন্দ্র স্মৃতিবিজড়িত শিলাইদহ কুঠিবাড়ি, লালন শাহর আখড়া, ‘গ্রামবার্ত্তা প্রবেশিকা’র সম্পাদক কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের কুটির এবং তাঁর হাতে নির্মিত পূর্ব বাংলার প্রথম মুদ্রণালয় এমএন প্রেস ও তার যন্ত্রপাতি আর ‘বিষাদসিন্ধু’ উপন্যাসের রচয়িতা মীর মোশাররফ হোসেনের বসতবাড়ি। কাজ সেরে আমাদের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। যে কয়েকটি স্থান দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল, তার মধ্যে কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের স্মৃতিবিজড়িত জাদুঘর ও নিকটস্থ কাঙাল হরিনাথের কুটির বা বসতভিটা, সমাধিঘর ও ছাপাখানা ছিল উল্লেখযোগ্য।
এ বাংলায়, বিশেষত কুষ্টিয়া অঞ্চলের হতদরিদ্র কৃষককুলের ওপর ইংরেজ ও এ দেশীয় অত্যাচারী জমিদারদের অত্যাচারের খড়্গ যখন নেমে এসেছিল, সেই দুঃসময়ে আমৃত্যু প্রতিবাদী সাংবাদিক কাঙাল হরিনাথ মজুমদার মানবিক তাড়নায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন কৃষকদের পাশে। মফস্সল সাংবাদিকতার পথিকৃৎ ও পূর্ব বাংলার প্রথম পত্রিকা ‘গ্রামবার্ত্তা প্রবেশিকা’র জনক আজ প্রায় পৌনে ২০০ বছর পরও মানুষের মনে জাগ্রত হয়ে আছেন।
কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের বিষয়ে কথার শুরুতে তাঁর সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এবং তাঁর সময়কালকে চিহ্নিত করা জরুরি। বাউল সম্রাট লালন ফকির ছিলেন কাঙাল হরিনাথের জীবনদর্শনের ভাবগুরু, ‘বিষাদসিন্ধু’র রচয়িতা মীর মোশাররফ হোসেন ছিলেন তাঁর শিষ্য এবং অক্ষয় কুমার, দীনেন্দ্রনাথ রায়, জলধর সেন—তাঁরাও তাঁর শিষ্য ছিলেন। শিলাইদহের তৎকালীন জমিদার জোত্যিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন কাঙাল হরিনাথের সময়কালের। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে সময়ে জমিদারির দায়িত্ব নিয়ে শিলাইদহে এসেছিলেন, তখন কাঙাল হরিনাথের বিদায়লগ্ন ঘনিয়ে এসেছে। লালন মারা যান ১৮৯০ সালে। আর কাঙাল হরিনাথ মৃত্যুবরণ করেন ১৮৯৬ সালে। মাত্র ছয় বছরের ব্যবধান। কাঙাল হরিনাথের কাজকর্ম সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ জানতেন। হরিনাথের লেখা দুই হাজার পৃষ্ঠার দিনলিপি তিনি পড়েছেন।
কাঙাল হরিনাথের পরিচয় একাধিক। তিনি একাধারে কবি, গীতিকার, লেখক, সম্পাদক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, প্রকাশক, সমাজসংস্কারক, সংগঠক এবং বেশ কয়েকটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর এই প্রকাশনা থেকেই ‘বিষাদসিন্ধু’ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। এ ছাড়া ‘বিজয় বসন্ত’, ‘কবিতা কুমুদী’, ‘চিত্রচপলা’, ‘মাতৃমহিমা’সহ তাঁর নিজের ১৮টি গ্রন্থ বেরিয়েছিল এই প্রকাশনা থেকেই। ফকির লালন শাহর প্রায় ২১টি লালনগীতি বই আকারে প্রথম এমএন প্রেস থেকেই প্রকাশিত হয়। কাঙাল হরিনাথের বিরামহীন কর্মযজ্ঞের স্মৃতি আজও বহন করে চলেছে কুষ্টিয়ার কুমারখালী।
এখন মূল প্রসঙ্গে আসি। আমরা কুমারখালীর কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের স্মৃতিসংবলিত ও সরকার নির্মিত জাদুঘর দেখতে গিয়েছিলাম। ওই জাদুঘরের সামনে দাঁড়িয়ে প্রথম দৃষ্টিতেই এমন আধুনিক ও নান্দনিক স্থাপনাটির দিকে তাকিয়ে মনটা ভরে গেল। ভেতরে প্রবেশ করে তো আমরা আরও অবাক। নিচতলায় সম্মেলনকক্ষ, ছোট আকারের মিলনায়তন, পাশে লাগোয়া পাঠাগার। যত দূর জানতে পেরেছি, ২০১৭ সালে ৯ ডিসেম্বর প্রায় ২৮ শতক জমির ওপর ১৬৮টি স্মৃতিনিদর্শনের সম্ভার নিয়ে জাদুঘরটির পথচলা শুরু হয়।
জাদুঘরে প্রবেশ করে দোতলায় এক এক করে কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের সুবিন্যস্ত বিভিন্ন হস্তলিপি, কবিতা, লেখালেখির খসড়া, পত্রপত্রিকার প্রচ্ছদ, লেখা, মুদ্রণকাজের নানা সরঞ্জাম, বেশ কয়েকটি কাঠের ব্লক ইত্যাদি দেখলাম। দেখতে দেখতে বারবার মনে হয়েছিল, এই জাদুঘর না দেখতে এলে আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের বড় একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন আমার দেখার বাইরে থেকে যেত। সেখান থেকে বের হওয়ার আগমুহূর্তে জানতে পেলাম, কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের মূল বসতবাড়িটি জাদুঘরের নিকটস্থ কুণ্ডুপাড়ায় অবস্থিত। জাদুঘর থেকে এর দূরত্ব খুব বেশি নয়—আধা কিলোমিটার। তাই মনে হলো, এত কাছেই যখন এসেছি, তখন দেখেই যাই না কেন! পরে দু-এক কথায় জানতে পারলাম, আমরা জাদুঘরে যে মুদ্রণযন্ত্রসহ যে ধাতব অক্ষরের বাক্সটি (অক্ষর কম্পোজ) দেখে এসেছি, সেটা আসল নয়, এটি ওই যন্ত্রের কাছাকাছি মডেলের সদৃশমাত্র। এটা জানার পর মন খুব খারাপ হলো। ভাবলাম, তাহলে আমরা টিকিট কেটে যে মুদ্রণযন্ত্রটি দেখে এলাম, সেটি কাঙাল হরিনাথের ব্যবহৃত নয়? এটি আসল নয়?
এবার আমাদের যাত্রা কুণ্ডুপাড়া অভিমুখে। মাত্র পাঁচ-সাত মিনিটের সরু পথে আমরা সেখানে পৌঁছে গেলাম। জরাজীর্ণ কুটির, দালানের দেয়ালগুলো যেন কোনো ধ্বংসাবশেষ, একটু জোরে ধাক্কা দিলেই ঝরঝর করে খসে পড়বে। প্রবেশমুখে দেয়ালে এখনো সেকালের প্রেসের নামটি উৎকীর্ণ হয়ে আছে—‘এমএন প্রেস’। এখান থেকেই ‘গ্রামবার্ত্তা প্রবেশিকা’ প্রকাশিত হতো।
জানা যায়, শৈশবকালে মারা যাওয়া কোনো প্রিয় বন্ধুর নামে কাঙাল হরিনাথ এ নামকরণ করেছিলেন। এ নামেই প্রেসটি তখন পরিচিতি পেয়েছিল। আমরা বসতবাড়ির বাঁ পাশ দিয়ে একটু ভেতরে এগিয়ে পেলাম কাঙাল হরিনাথের সমাধি। সেটির অবস্থাও ভালো নয়। বসতভিটার সর্বত্রই অবহেলার স্বাক্ষর, সবকিছুতেই দারিদ্র্যের ছাপ। উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ডাকাডাকি করতেই বাড়ির ভেতর থেকে এক ভদ্রমহিলা বেরিয়ে এলেন। আনুমানিক ষাটোর্ধ্ব বয়সী। তাঁর নাম গীতারানী মজুমদার। তিনি হরিনাথ মজুমদারের চতুর্থ পর্যায়ক্রমের বংশধর শ্রী অশোক মজুমদারের স্ত্রী। তাঁকে অনুরোধ করলে, তিনি চাবি নিয়ে এসে ছাপাখানাটি আমাদের খুলে দেখালেন। হ্যাঁ, একই ঘরে (ক্লাইম্যান ডিক্সন কোং, লন্ডন; মডেল ১৭০৬, রাজশাহীর রানী স্বর্ণকুমারীর অর্থ আনুকূল্যে নিলামে ৬০০/- টাকায় ক্রয়কৃত সেট) তিনটি অবস্থানে দুটি ছাপার মেশিন, মুদ্রণের সেই ধাতব অক্ষরগুলোর একটি বাক্স সেভাবেই রয়েছে। মেঝেটি স্যাঁতসেঁতে, অমসৃণ, গুমোট ঘর।
এ ঘরে লালন শাহ ও মীর মোশাররফ হোসেন কোথায় এসে বসতেন, তা-ও দেখলাম আমরা। ঘরটির ওপরে টিনের চালা, কোথাও ফুটো, কোথাও পড়ো পড়ো অবস্থা। গীতারানীর কাছে জানতে চাইলাম, কেন এই ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবান সম্পদগুলো জাদুঘর তথা নিরাপদ সরকারি ব্যবস্থাপনায় দিলেন না। তিনি বললেন, মূল কারণ দুটি। এক. তিনি বা তাঁরা চাননি এগুলো অন্য কোথাও স্থানান্তরিত হোক। দুই. দারিদ্র্য মোচনে বংশধরদের কর্মসংস্থান ও আবাসনের ব্যবস্থা করাসহ তাঁদের সামান্য কিছু দাবিদাওয়া পূরণ করুক সরকার, এটি তাঁরা চেয়েছিলেন। কিন্তু সরকার সেগুলো আমলে নেয়নি।
যা হোক, দেখেশুনে আমাদের মন বিষণ্নতায় ভরে গেল। হরিনাথের নিজ হস্তে ব্যবহৃত মূল জিনিসগুলো আজ এই ভাঙা ঘরে অরক্ষিত অবস্থায় নষ্ট হতে চলেছে। অথচ ঠিক সামান্য দূরত্বে সরকারের বিপুল অর্থায়নে নান্দনিক স্থাপনায় শোভিত ‘কাঙাল হরিনাথ জাদুঘর’ নামে নির্মিত অত্যাধুনিক এ স্থাপনায় নকল জিনিসপত্র প্রদর্শনীতে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। আমার কাছে এটি এক অদ্ভুত বৈপরীত্য বলেই মনে হয়।
ঢাকায় ফিরে এ নিয়ে বন্ধুবান্ধব ও বিভিন্ন ফোরামে আলাপ করে তেমন কোনো সমাধান পেলাম না। শেষে জাদুঘরটির তত্ত্বাবধায়ক ও এর নিয়ন্ত্রণ সংস্থা জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালকের সঙ্গে দেখা করে বিষয়টি জানালাম। বললাম, একজন দর্শনার্থী ও কাঙাল হরিনাথের গুণমুগ্ধ হিসেবে এর কোনো উপযুক্ত সমাধানের উপায় বের করা যায় কি না। তিনি জানান, মাত্র কয়েক মাস হলো তিনি দায়িত্বে এসেছেন। এ বিষয়ে অতটা অবগত নন। তবে এ বিষয়ে যিনি জানেন এবং তথ্য-উপাত্তসহ ধারণা দিতে পারবেন, তাঁর দপ্তরের সেই ব্যক্তিকে তিনি ডেকে এনে আলাপ করিয়ে দিলেন। তাঁর সঙ্গে আলাপে যেটুকু সারকথা পেলাম, তা সংক্ষেপে এ রকম: প্রকল্প গ্রহণ, যাচাই-বাছাই ও বাস্তবায়নে, অর্থাৎ জাদুঘর নির্মাণকালে একটি কমিটি করা হয়েছিল। সেই কমিটিতে দেশের বরেণ্য কয়েক ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট ছিলেন। তাঁরা চেষ্টা করেছিলেন সরকারি বিধিবিধান মেনে জাদুঘরটি হরিনাথ মজুমদারের বসতবাড়িতেই নির্মাণ করতে। কিন্তু তখন হরিনাথ মজুমদারের বংশধরদের কিছু অযৌক্তিক দাবির কারণে সেটি সেখানে হয়নি।
এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে আমি বর্তমান বংশধরের পক্ষে গীতারানী মজুমদারের লিখিত দাবি বা আবেদনের (সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সরকারি দপ্তর বরাবর ইতিপূর্বে দাখিলকৃত বা প্রেরিত আবেদনপত্রের ফটোকপি সংযুক্ত ) প্রসঙ্গে বললাম। বললাম, সেখানে মোট পাঁচটি দাবি রয়েছে। এক. গীতারানী মজুমদারের দুই ছেলে ও তাঁদের বউদের জাদুঘরে চাকরি প্রদান। দুই. জীবিত থাকা পর্যন্ত তাঁকে সম্মানী প্রদান করা। তিন. তাঁর দুই পুত্রের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করা। চার. কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের ব্যবহৃত কাঙাল কুটির ভবনটি সংস্কার ও সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ করে দেওয়া। পাঁচ. কাঙাল হরিনাথের সমাধিঘরটি মেরামত করা। এই আবেদন বা দাবিগুলোর কোনোটিই তো খুব বিশাল কিছু বা বেশি অযৌক্তিক দাবি বলে মনে হয় না। বরং কাঙাল হরিনাথ মজুমদার নামে প্রতিষ্ঠিত সরকারি জাদুঘরটিতে হরিনাথের ব্যবহৃত আসল জিনিসের পরিবর্তে নকল জিনিস প্রদর্শনের আয়োজন কতটা নৈতিক বা যৌক্তিক, সেই প্রশ্ন সামনে চলে আসে।