বাস্তব জীবনে যিনি ‘সুবোধ’ ও মার্জিত মানুষ বলে পরিচিত, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা যায় তাঁর অন্য রূপ। মন্তব্য, মতামত ও স্ট্যাটাস দেওয়ার সময় অনেক ক্ষেত্রেই সীমা অতিক্রম করে ফেলন, এমন লোকের সংখ্যা কম নয়। বাস্তবে মার্জিত আচরণ করলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কেন সহিংস হয়ে উঠি আমরা?
কয়েক বছর আগেই রাজধানীজুড়ে চোখে পড়ছিল ‘সুবোধ’-এর গ্রাফিতি বা দেয়ালচিত্র। এসব দেয়ালচিত্রের একমাত্র চরিত্র ‘সুবোধ’। এর সব কটিতে লেখা: ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, এখন সময় পক্ষে না,’ ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, মানুষ ভালোবাসতে ভুলে গেছে,’ ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, তোর ভাগ্যে কিছু নেই,’ কিংবা ‘সুবোধ এখন জেলে, পাপবোধ নিশ্চিন্তে বাস করছে মানুষের মনে।’ আর প্রতিটি দেয়ালচিত্রের লোগো আকারে ব্যবহার করা হয়েছে একটি শব্দ—‘হবেকি’। তাহলে কি বাস্তবের ‘সুবোধ’–এর আশ্রয় হয়ে ওঠে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, যেখানে সে নির্বিঘ্ন ভাঙতে পারে সব আগল? সোচ্চার হতে পারে, এমনকি বলতে পারে কটু কথাও! আদতে এর পেছনে কাজ করে কোন মনস্তত্ত্ব?
উনিশ শতকের শেষার্ধে যখন মানুষের মননের অতল মাপার চেষ্টা করছেন সিগমুন্ড ফ্রয়েড, তখন তিনি বলেন যে মানুষের মনোজগৎ তিন ভাগে বিভক্ত—ইড, ইগো আর সুপার–ইগো। তিনটি ভাগের মধ্যে ক্রিয়া–প্রতিক্রিয়া, সংঘাত–সংঘর্ষ বা সম্মিলনের মধ্য দিয়েই তৈরি হয় মানুষের ব্যক্তিত্ব।
জন্ম থেকে ব্যক্তিত্বের মধ্যে যেসব প্রবৃত্তি প্রোথিত, দৈহিক গঠনতন্ত্রে উপস্থিত এবং শুধু আমোদপ্রাপ্তির নীতিতে পরিচালিত, তাকেই ফ্রয়েড বলেন ইড। মূলত আবেগ ও আকাঙ্ক্ষার উৎস যে ইড, তার বিবরণ দিতে গিয়ে অস্ট্রীয় এই মনোস্তত্ত্ববিদ বলছেন, ‘এটি আমাদের ব্যক্তিত্বের অন্ধকার ও অগম্য অংশ।’ যুক্তি এবং স্বাভাবিক সচেতন জীবনের সঙ্গে এর কোনো লেনদেন নেই। এক সাইকো অ্যানালাইসিস–বিষয়ক বক্তৃতায় ফ্রয়েড বলেন, ‘পরস্পরবিরোধী আবেগ একে অপরকে বাতিল না করে পাশাপাশি অবস্থান করে।’ এ বিষয়ে তাঁর আরও কথা আছে। তিনি বলেন, ‘ইড সংস্কারের বিচার করতে জানে না, ভালো–খারাপ, নৈতিকতাকে চেনে না, সে প্রবৃত্তিগত মানসিক শক্তি অবমুক্ত হওয়ার অপেক্ষায় থাকে। আমাদের মতে, ইডে কেবল সেটাই আছে।’
বাস্তবে আপনাকে ‘সুবোধ’ করে রাখে আপনার ইগো। সুপার-ইগোর কর্তৃত্ব মেনে নিয়ে ইডকে নিয়ন্ত্রণের ঘেরাটোপে বন্দী রাখে। সামাজিকভাবে স্বীকৃত আচরণের মধ্য দিয়ে যেকোনো ধরনের সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি এড়ায়। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপনার মনোজগতের বিভাজন সেই সূত্র অনুসরণ করে না। তাই নিয়মগুলোও পাল্টে যায়।
তবে আমাদের ছকে বাঁধা সামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে ইড খাপ খায় না। আমাদের প্রবৃত্তিগত আবেগ ও আকাঙ্ক্ষার তাগিদ বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে তা পূরণের উদ্যোগ নেয় ইগো। ফ্রয়েডের মতে, ইগো হলো ইড ও বাস্তবতার মধ্যে মধ্যস্থতাকারী। আর এই মধ্যস্থতা করতে গিয়ে অনেক সময়ই ইডের অবচেতন নির্দেশকে অগ্রাহ্য করে ইগো। বাস্তবতার সঙ্গে ইডের সংঘর্ষ এড়াতে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে অনেক আবেগ ও আকাঙ্ক্ষার অবদমনও ঘটায় সে।
মূলত ‘ইগো’ শব্দটি ফ্রয়েড ব্যবহার করেছিলেন ‘আত্মসচেতন’ অর্থে। তবে পরে এর মনোস্তাত্ত্বিক ভূমিকার বিস্তার ঘটিয়ে তিনি এর সঙ্গে বিচার, সহ্যক্ষমতা, নিয়ন্ত্রণ, পরিকল্পনা, প্রতিরক্ষা, তথ্য সমন্বয়, বুদ্ধিবৃত্তিক কর্ম ও স্মৃতির মতো বিষয়গুলো যোগ করেন। ফ্রয়েডের মতে, ‘ইগো হচ্ছে ইডের সেই অংশ, যা বাহ্যিক জগতের সংস্পর্শে পরিবর্তিত হয়েছে। আমরা সাধারণভাবে যাকে যুক্তি বলি, ইগো তারই প্রতিনিধিত্ব করে, যা কিনা আবার ইডের বিপরীত এবং যা ধারণ করে অনুভূতি…। এটা অনেকটা দড়ি–টানাটানির মতো ব্যাপার। পার্থক্যটা হলো, দড়ি–টানাটানি হয় এমন দুটি দলের মধ্যে যারা সমকক্ষ, কিন্তু ইগোর চেয়ে ইড অনেক বেশি শক্তিশালী। ইগো আদতে ইডের আদিম চাহিদা, বাস্তবতার আরোপিত নানা সীমাবদ্ধতা এবং সুপার–ইগোর কঠোর নৈতিকতার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখায় চেষ্টারত।’ আর এটা করতে গিয়ে ইগো প্রতিরক্ষার কিছু কৌশল অবলম্বন করে। ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ নানা আবেগকে ঢেকে ফেলে সাংঘর্ষিক অবস্থান এড়ানোর চেষ্টা করে। বলা ভালো, এসব কৌশলের মধ্যে রয়েছে বাস্তবতাকে স্বীকার না করা, অবদমন করা, কল্পনার জগতে হারিয়ে যাওয়া, এক জায়গার ক্ষোভ অন্য জায়গায় বা বস্তুর ওপর আরোপ করা ইত্যাদি।
অন্যদিকে সুপার–ইগো প্রতিনিধিত্ব করে সাংস্কৃতিক শাসনকাঠামোর। মা–বাবা বা অন্য কর্তৃত্বশীল ব্যক্তিত্ব এবং সাধারণ সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল থেকে যা আমরা ধারণ করি, সাধারণভাবে যাকে আমরা ‘বিবেক’ বলি। ফ্রয়েডের মতে, সুপার–ইগোকে বলা চলে, ‘অভিভাবকের কর্তৃত্বের সমন্বিতকরণের সফল উদাহরণ’ এবং মানুষ বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্য যাঁরা ‘অভিভাবকের জায়গা নেন, যেমন প্রশিক্ষক, শিক্ষক বা এমন কেউ, যাঁকে মানুষ আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে, তাঁদের প্রভাব মেনে নেওয়া। তার মানে, কোনো শিশুর সুপার–ইগো নির্মিত হয় তার অভিভাবকের সুপার–ইগোর আদলে এবং মূলত তা এমন এক বাহন, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে চলা মূল্যবোধ, ঐতিহ্য ও সংস্কার ধারণ করে চলেছে। সুপার–ইগোর অন্তর্ভুক্ত হলো, আদর্শ, আধ্যাত্মিক লক্ষ্য ও বিবেক, যা জৈবিক চাহিদা, কল্পনা ও আবেগের অভিব্যক্তির সমালোচনা করে এবং তার প্রকাশে বাধা দেয়। এভাবেই এটা ইগোকে সামাজিকভাবে স্বীকৃত আচরণের গণ্ডিতে বেঁধেও ফেলে।
ফ্রয়েডের এই মনস্তাত্ত্বিক বিভাজনের পর পেরিয়েছে প্রায় ১০০ বছর। একবিংশ শতকে মানুষ এখন দুই ভুবনের বাসিন্দা—‘অ্যাকচুয়াল’ (প্রকৃত বা বাস্তব) ও ‘ভার্চ্যুয়াল’। নেটিজেনদের সামাজিক বাস্তবতাও তাই এখন ক্রমেই খণ্ডিত। ইড, ইগো আর সুপার–ইগোর বিভাজনও তাই আর খাটছে না। প্রকৃত দুনিয়ায় ব্যক্তিকে ‘সুবোধ’ রাখা সুপার–ইগো ভার্চ্যুয়াল দুনিয়ায় এসে অস্তিত্ব হারাচ্ছে। কারণ, প্রজন্মান্তরে বয়ে চলা মূল্যবোধ, ঐতিহ্য ও সংস্কারের কোনো ভিত্তি নেই সীমানাহীন এই ভার্চ্যুয়াল জগতে। নেটিজেনরা যত বেশি সময় বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কাটাচ্ছেন, ততই সুপার–ইগোর আরোপিত আচরণগত বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত হচ্ছেন। কারণ, আপাতদৃষ্টে ভার্চ্যুয়াল জগৎ এমন এক ভুবন, যেখানে আপনি অভিব্যক্তির সংযমহীন প্রকাশ ঘটাতে পারেন। ফলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাস্তবতার নীতি অনুসরণকারী ইগো এবং অনিয়ন্ত্রিত আবেগ ও আকাঙ্ক্ষার উৎস ইডের মধ্যকার সীমারেখাও ম্লান হতে শুরু করে।
বাস্তবে আপনাকে ‘সুবোধ’ করে রাখে আপনার ইগো। সুপার–ইগোর কর্তৃত্ব মেনে নিয়ে ইডকে নিয়ন্ত্রণের ঘেরাটোপে বন্দী রাখে। সামাজিকভাবে স্বীকৃত আচরণের মধ্য দিয়ে যেকোনো ধরনের সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি এড়ায়। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপনার মনোজগতের বিভাজন সেই সূত্র অনুসরণ করে না। তাই নিয়মগুলোও পাল্টে যায়। ইড আর ইগোর সহাবস্থানে সুপার–ইগোর কর্তৃত্ব খর্ব হয়। আর সে কারণেই ‘সুবোধ’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গিয়ে নিঃসংকোচ হয়ে উঠতে পারে সহিংস।
সময় পক্ষে বা বিপক্ষে, যা–ই থাক না কেন, প্রকৃতপক্ষে ‘সুবোধ’ কখনো পালিয়ে যায় না; প্রথাবদ্ধ সামাজিকতার মধ্যে বাস করতে করতে অতঃপর ভার্চ্যুয়াল পৃথিবীর মেটা দুনিয়ায় নিজেকে সে যেভাবে দেখতে চায়, সেভাবেই আচরণ করে।