আজ ৬ ডিসেম্বর মরমি কবি হাছন রাজার মৃত্যুদিন
হাছন রাজার নাম নিয়ে বিভ্রান্তির শেষ নেই।
হাছনের জন্মভিটায় এই বিভ্রান্তি সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে। সুনামগঞ্জের তেঘরিয়া গ্রামে যে বাড়িতে তাঁর জন্ম হয়েছিল, সেটা এখন একটি জাদুঘর। না, কোনো রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় নয়, পারিবারিক উদ্যোগে বাড়ির টঙ্গিঘরের দুই কামরাকে যে জাদুঘর বানানো হয়েছে, তার সামনে সাইনবোর্ডে লেখা, ‘হাসন রাজার বাড়ি’। ভেতরে জাদুঘরের সাইনবোর্ডে লেখা ‘হাসন রাজা মিউজিয়াম’। এটুকু পার হয়ে যদি কেউ হাছন রাজার জন্মভিটায় তাঁর পঞ্চম উত্তরপুরুষের ঘরে যান, দেখবেন পৌরসভার সরকারি যে ফলক লাগানো সেখানে লেখা ‘হাছন রাজা’র বাড়ি।
আবার সুনামগঞ্জে যেখানে হাছন রাজা শায়িত, তাঁর ফলকে লেখা ‘হাসন’। এই এপিটাফ আর হাছন রাজার বাড়ির একটি অংশ ছাড়া সুনামগঞ্জে শিল্পকলা একাডেমির যে মিলনায়তন আছে, সেখানে তাঁর নাম ‘হাছন’ই আছে।
হাছন রাজার দুটি জমিদারি ছিল। একটা তাঁর বাবার থেকে পাওয়া, সেটা ছিল বিশ্বনাথের রামপাশায়। সেখানে যে কবরস্থানে হাছন রাজার বাবা ও ভাই শায়িত, সবখানে তিনি ‘ছ’যুক্ত হাছনেই আছেন। এমনকি সিলেট শহরের জিন্দাবাজারে হাছনের যে জাদুঘর আছে, সেখানেও তিনি ‘হাছন’। অথচ দীর্ঘদিন ধরে বাংলা একাডেমির একটা ভুল নামায়নের কারণে দেশের সব পত্রপত্রিকা আর লেখক–গবেষকেরা হাছন রাজার নাম ভুল বানানে ‘স’ যুক্ত করে ‘হাসন রাজা’ লিখে এসেছেন।
জীবদ্দশায় হাছন রাজা তেমন মর্যাদা পাননি। এমনকি তাঁর মৃত্যুর তিন বছর আগে রবীন্দ্রনাথ যখন সিলেটে আসেন, হাছনের বয়স তখন ৬৫ বছর। যদিও তাঁর আত্মীয়দের একজন এই অনুষ্ঠানের আয়োজক ছিলেন, রবীন্দ্রনাথের সামনে তাঁকে এনে পরিচয় করিয়ে দেননি বা তার প্রয়োজন বোধ করেননি। হাছনের মৃত্যুর চার বছর পর রবীন্দ্রনাথের হাতে তাঁর ৭২টি কবিতার একটি খাতা যায়। এবং সে সময় ভারতের বিশ্ব–দর্শন সম্মেলনে হাছনের নাম উল্লেখ না করেও রবীন্দ্রনাথ তাঁর দুটি কবিতার পঙ্ক্তি নিজে ইংরেজিতে অনুবাদ করে উদ্ধৃতি দিলে হাছন রাজার নাম মানুষের কৌতূহলের বিষয়ে পরিণত হয়।
আলোচনায় এলেন হাছন রাজা
হাছন রাজা তাঁর জীবিতকালে সবচেয়ে অনাদরের পাত্র ছিলেন নিজের সন্তানদের কাছে। এর একমাত্র কারণ ছিল তাঁর সম্পদের উত্তরাধিকারের ভাগ–বাঁটোয়ারা। প্রচণ্ড রমণীমোহন এই জমিদারের বহুগামিতার খবর সবাই জানত। রেজিস্ট্রি করা স্ত্রী ছিলেন ৯ জন। এর মধ্যে ৫ জনের গর্ভে সন্তান হয়। এই সন্তানেরা সিলেট শহর, বিশ্বনাথ, সুনামগঞ্জে তাঁর সম্পত্তির উত্তরাধিকারের ভাগ বণ্টনেই শুধু আগ্রহী ছিলেন। জীবদ্দশায় দুটি বই লিখেছিলেন তিনি। এগুলো তাঁর উত্তরাধিকারীরা সংরক্ষণ করেননি। তবে তাঁর সৃজনকর্ম লালনের জন্য ধীরে ধীরে কিছু উত্তরাধিকারীর আবির্ভাব হতে থাকে।
হাছনকে দ্বিতীয় (প্রথমজন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) যিনি সুরমা নদী পেরিয়ে গঙ্গা হয়ে বিশ্ববাজারে ছড়িয়েছিলেন, তাঁর নাম নির্মলেন্দু চৌধুরী। গত শতকের চল্লিশের দশকে কলকাতায় গিয়ে আকাশবাণীর জন্য যে পাঁচটি গান তিনি গেয়েছিলেন, তাঁর তিনটি হাছন রাজার লেখা। পঞ্চাশের দশকে বাংলার লোকগান নিয়ে নির্মলেন্দু চৌধুরী সারা ভারত এবং ভারতের সাংস্কৃতিক দলের প্রতিনিধি হিসেবে পৃথিবীর নানা দেশে যেসব গান গেয়েছিলেন, তাঁর মধ্যেও ছিল হাছন রাজার গান। আর ঢাকায় বেতারের সম্প্রচার শুরু হলে ষাটের দশকের গোড়ার দিকে সিলেটের শিল্পীরা ঢাকায় এসে গান গাইলে দেশের লোক–গবেষকদের নজর পড়ে হাছন রাজার প্রতি। ১৯৬৩ সালে লোকসংস্কৃতিবিদ ড. আশরাফ সিদ্দিকী উদ্যোগ নিয়ে সুনামগঞ্জে হাছনের জন্মভিটায় যে উৎসব করেছিলেন, সেটা ছিল হাছন রাজার প্রথম স্মরণসভা। তা–ও তাঁর মৃত্যুর ৪০ বছর পর।
যেভাবে তিনি গান লিখতেন
১৯৬৫ সালে সিলেটে রেডিও স্টেশন চালু হয়। এই রেডিওর সূচনা ঘটে হাছন রাজার গান দিয়ে। এই গানগুলো সিলেট বেতারের যেসব সুরকার সুর করেছিলেন, এখন সেগুলোকেই আমরা হাছন রাজার গানের আদি সুর বলে জানি। আসলে হাছন রাজা নিজে শুধু নাম দস্তখত করতে পারতেন। বাংলা লিখতে ও পড়তে খুব পারতেন না। জানা যায়, তাঁর লেখাগুলো লিখে দিতেন মুহুরিরা এবং গান গাইতেন তাঁর সঙ্গী–সাথিরা। তিনি নৌকায় বসে বসে গানের ছত্র বলতেন আর তাঁর সঙ্গিনীরা সেগুলো নানান তালে গাইতেন। তাঁর কোনোটিরই কোনো রেকর্ড কোথাও নেই। জীবদ্দশায় তিনি কোনো আসরে যন্ত্রীদের নিয়ে সংগত করে গান গেয়েছেন, এমন নজির নেই। গান তিনি লিখে রাখতেন কবিতা লেখার মতো। কারণ, কবিতা লেখা তাঁর পারিবারিক সংস্কৃতি ছিল। তাঁর বৈমাত্রেয় বড় ভাই উবেদুর রেজা গান গাইতেন, লিখতেন। তাঁর আরেক বোন সইফা ছিলেন প্রথম বাঙালি মুসলমান কবি, তাঁর দুটি কাব্যগ্রন্থও ছিল। সেই ধারা অনুসরণ করেই হাছন রাজা গীতিকাব্য রচনা করেছিলেন।
নামবিভ্রাটের সূচনা
সত্তরের দশকে হাছন রাজা পুনরায় আলোচিত হতে থাকেন তাঁর নাতি ও নাতনি জামাই দার্শনিক অধ্যাপক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের হাতে পড়ে। হাছনের জীবন ও দর্শন নিয়ে এই দার্শনিকই প্রথম বড় বিশদে লিখতে শুরু করেন। তবে নতুন করে হাছন রাজাকে পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে তিনি হাছন রাজার নামের বানানের যে সংশোধনী করিয়েছিলেন, সেটাই পরবর্তীকালে সব বিভ্রান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ ১৯৮৩ সালে মরমী কবি হাসন রেজা নামে একটা বই লেখেন। এখানে তিনি জেনেশুনেই হাছনের নাম ‘স’ দিয়ে লিখেছেন এবং তাঁর আদিনাম ‘রেজা’ তিনি রেখেছিলেন। বলা ভালো, জন্মের পরে হাছনের বাবা আলী রেজা বড় পুত্র অবেদুর রেজার সঙ্গে মিলিয়ে তাঁর নাম রেখেছিলেন ওহিদুর রেজা। কিন্তু এই নাম তাঁর মায়ের পছন্দ ছিল না। তিনি সিলেট আদালত ভবনের নাজির আব্দুল্লাহকে বলে নাম বদলান। ওহিদুর বদল করে নাম রাখা হলো হাছন রেজা। আর ১৭ বছর বয়সে বাবা ও বড় ভাইয়ের মৃত্যুর পর সুনামগঞ্জ, সিলেট, বিশ্বনাথের ৫ লাখ বিঘার জমিদারি পাওয়ার পর হাছন নিজেই নিজের নামের ‘রেজা’ বাদ দিয়ে ‘রাজা’রূপে প্রকাশিত হতে থাকেন। তখন তাঁর নাম হয় হাছন রাজা। কিন্তু এই মরমি কবির মৃত্যুর অন্তত ৫০ বছর পরে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ হাছন কেটে হাসনে রূপান্তর করেন। এর কারণ হিসেবে তিনি লেখেন যে হাছন আরবিতে যেভাবে তাঁর নাম লিখতেন, সেটা আরবি বর্ণ ‘সিন’ দিয়ে, সে কারণে এটা ‘হাসন’ হবে।
আদতে সিলেটের আঞ্চলিক উচ্চারণে ‘স’–এর স্থলে ইংরেজি ‘এস’–এর মতো একটা উচ্চারণ হয়। আর ও-কারের বদলে উ-কার হয়ে থাকে। যার নাম ‘হোসেন’, তাঁকে হয়তো ডাকা হয় ‘হুছেন’, যিনি ‘হাসান’, তিনি হন ‘হাছন’ এবং সেভাবে তাঁর নিজের নামও তিনি লেখেন।
তেঘরিয়ার জাদুঘরে হাছন রাজার সব পাণ্ডুলিপি, জমির দলিল, বন্দোবস্ত, এমনকি হাছনের নিজ খরচায় প্রকাশিত দুটি গ্রন্থেও ‘ছ’ দিয়েই হাছন লেখা। আর লেখা ‘রজা’ও।
আগেই বলা হয়েছে, হাছনের বাবার নাম ছিল আলী রেজা। স্থানীয় উচ্চারণে ডাকা হতো ‘আলীরজা’। ‘রেজা’র বদলে ‘রজা’ দলিলেও সেভাবে লেখা আলীরজা। এমনকি হাছন রাজার দুটি বইয়ের প্রচ্ছদেও লেখা ছিল ‘দেওয়ান হাছনরজা চৌধুরী’। দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফও তা খুব ভালো করে জানতেন। তারপরও সে গ্রন্থ ১৯৮৯ সালে যখন তিনি বাংলা একাডেমি থেকে পুনঃপ্রকাশ করলেন, তখন সেখানে লেখা হলো ‘হাসন রাজা’।
হাছনের নাম নিয়ে মূলত এর পর থেকেই বিভক্তির শুরু। তাঁর উত্তরসূরিরাও দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলেন। দুই ভাগেরই পঞ্চম, ষষ্ঠ পুরুষেরা ‘হাসন’ আর ‘হাছন’-এ বিভক্ত হয়ে হাছনচর্চা করতে থাকেন।
বিষয়টি দালিলিক প্রমাণাদিসহ আমি একবার বাংলা একাডেমিতে উপস্থাপন করি। তখন করোনাকাল। পরে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে একদিন বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক কবি হাবিবুল্লাহ সিরাজী আমাকে ফোন করে জানান, একাডেমির সভাপতি ড. আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে এক সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যে এখন থেকে বাংলা একাডেমি ‘ছ’ যুক্ত করে হাছন লিখবে।
১৯২২ সালের ৬ ডিসেম্বর যে রহস্যপুরুষের তিরোধান হয়েছিল, তিনি এখন তাঁর নামের বানান নিয়ে এই কাটাকুটি খেলা দেখে হয়তো নীরবে মুচকি হাসছেন। জীবদ্দশায় মানুষের কাছে হাছন রাজা কদর পাননি। তাই কি খেদসমেত লিখেছিলেন, ‘কানার হাতে সোনা দিলে লাল-ধলা চিনবে না’।
তিরোধানের শতবর্ষ পরও নতুনভাবে উদ্ভাসিত হচ্ছেন ‘বাউলা’ হাছন রাজা!