৯ জুন প্রয়াত হয়েছেন সিরাজুল আলম খান। তাঁকে নিয়ে রাজনীতিসচেতন মানুষের অঢেল কৌতূহল। কারও কাছে তিনি রহস্যপুরুষ, কারও কাছে মিথ, কারও কাছে একটি প্রজন্মের তরুণদের ‘বিপথগামী’ করার মূল কারিগর। তাঁর প্রতি মানুষের এত কৌতূহল কেন?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সিরাজুল আলম খানকে (১৯৪১-২০২৩) কেন্দ্র করে চলে আসা প্রায় ছয় দশকের রাজনৈতিক বিচার ও বিশ্লেষণও বহুধা ধারায় বিভক্ত। তিনি কারও কাছে হয়ে উঠেছেন রহস্যপুরুষ, কারও কাছে মিথ, কারও কাছে লিজেন্ড, কারও কাছে কাল্ট। আবার কারও কাছে হিরো, কারও কাছে অ্যান্টিহিরো বা প্রতিনায়ক। ট্র্যাজিক-হিরোও কি নন?
এসব কারণেই হয়তো চল্লিশ বছরের বেশি সময় ধরে আমাদের জনপরিসরের মধ্যে নানাভাবে তিনি আলোচিত হয়ে আসছেন। তাঁকে নিয়ে মানুষের এত আগ্রহের কারণ কী?
রাজনীতির ক্ষমতাবাদী চোরাগলিতে আমৃত্যু সক্রিয় থেকে অনেকেই প্রাসঙ্গিক থাকার বরমাল্য পরতে পারেন না। অথচ প্রথাগত রাজনৈতিক ক্ষমতাকাঠামোর বাইরে জীবন যাপন করেও সিরাজুল আলম খান আমৃত্যু আলোচনায় থেকে গেলেন। এই প্রভাব সন্দেহাতীত দুর্দমনীয় এবং একে বেপরোয়া বলে নাকচ করা কোনো বুদ্ধিদীপ্ত আত্মশ্লাঘা নয়। প্রথাগত রাজনীতির জনপ্রিয়ধারার প্রবল প্রতাপের বলে বলীয়ান হলে সমকাল সক্রিয় অনেককেই নায়ক বানায়। আবার এই একই ধারায় রাজনীতিতে সক্রিয় না থাকতে পারার কারণে সেই সমকালই কাউকে ব্রাত্য ও বিচ্ছিন্ন প্রতিনায়ক বানিয়ে রাখে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই দুই ধারাকেই একদম নিজের করকমলে নামিয়ে এনেছেন মাত্র একজনই, তিনি সিরাজুল আলম খান।
দীর্ঘকাল রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় থেকেও একপ্রকার দীর্ঘ ‘রাজনৈতিক সন্ন্যাস’ গ্রহণ করেও সিরাজুল আলম খানের এই যে ব্যাপক সক্রিয় পরিসর তৈরি হওয়া, সেটা যেন এ দেশের জনসংস্কৃতি (পপুলার কালচার) এবং একই সঙ্গে লোকসংস্কৃতির (ফোক কালচার) অংশ হয়ে উঠেছে।
সিরাজুল আলম খানের প্রভাব বাংলাদেশের রাজনীতিতে শুরু হয়ে গিয়েছিল তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়জীবনেই। অর্থাৎ ষাটের দশকের প্রায় আদিতেই। ষাটের দশক এই দেশের ছাত্ররাজনীতির ইতিহাসের সবচেয়ে অসামান্য সময় হিসেবে স্বীকৃত। সিরাজুল আলম খান সেই অগ্নিগর্ভ সময়েরই সৃষ্টি। ধীরে ধীরে তিনি মহিরুহ হয়ে উঠেছেন। তেজস্বী ও আগুয়ান এক স্বপ্নবিভোর তরুণ প্রজন্মকে ছাত্ররাজনীতিতে হাতেখড়ি দিয়েছেন। ছাত্র ইউনিয়নের মতো ক্যাডারভিত্তিক ছাত্রসংগঠনের সুবর্ণ সময়েও তিনি ছাত্রলীগের মাধ্যমে তৈরি করেছিলেন একটি সামর্থ্যবান কর্মী বাহিনী। অনিবার্যভাবেই এ ঘরানার কাছে হয়ে উঠেছিলেন ‘দাদাভাই’।
সিরাজুল আলম খান যখন নিজেকে ছাড়িয়ে যাচ্ছেন একমেবাদ্বিতীয়ম উচ্চতায় ছাত্রনেতা হিসেবে, তাঁর বয়স তখন মাত্র ২০-২২ বছর। তাঁর রাজনৈতিক জীবন পরিভ্রমণ করলে পাওয়া যাবে, ১৯৬৩-৬৫ মেয়াদে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক (সভাপতি কে এম ওবায়দুর রহমান) হওয়া ছাড়া প্রথাগত রাজনীতিতে আর কোনো বড় পদে তিনি কখনোই ছিলেন না। এর আগে, ১৯৬০-৬৩ মেয়াদে শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন (সভাপতি) ও শেখ ফজুলল হক মণি (সাধারণ সম্পাদক) ছাত্রলীগের যে কমিটির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, সেখানে তিনি ছিলেন সহসাধারণ সম্পাদক (মণি অসুস্থ হলে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক), এই যা। এত অল্প সময় তাঁর নেতৃত্বের পরিব্যপ্তি, অথচ তিনি কী এক সুদূরপ্রসারী রাজনীতিমনস্ক প্রভাবই না তৈরি করে গেছেন পরবর্তী সময়ের ছাত্রনেতাদের ওপর!
এককথায় ছাত্রলীগপন্থী ছাত্রদের জন্য তিনিই ছিলেন সেই গন্তব্যপুরুষ, যিনি নেতাও নির্বাচন করছেন, নীতিও নির্ধারণ করছেন, আর হয়ে উঠছেন ছাত্রলীগের তাত্ত্বিক গুরু।
শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের হাত ধরে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে আসতে না আসতেই ১৯৬২ সালে তিনি তৈরি করে ফেলেছিলেন সংগঠনের অভ্যন্তরস্থ বাহিনী নিয়ে ‘নিউক্লিয়াস’ নামের এক রহস্যজনক গোপন সংগঠন, যেখানে তাঁর নেতৃত্বসঙ্গী হয়েছেন মাত্র দুজন—আবদুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদ। এটি সংগঠন না কোনো কোর টিম, নাকি ছাত্রলীগের স্টিয়ারিং কমিটি—এসবের কিছুই আসলে পরিষ্কার ছিল না বহুদিন। এমনকি বঙ্গবন্ধুকে পর্যন্ত এসব বিষয়ে তাঁরা জানিয়েছেন অনেক পরে। আবদুর রাজ্জাকের বয়ানমতে, ১৯৬৬ সালে কিছুটা, ১৯৬৯ সালে পুরোটা।
এসব ঘটনায় সিরাজুল আলম খানের সংশ্লিষ্টতা কী, কেন অথবা কোনটা সত্য, তা বাংলাদেশের রাজনীতিতেই শুধু নয়, আলোচনার খোরাক হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের উত্তর প্রজন্মের রাজনীতিতে, জনপরিসরে। বহু প্রশ্ন, কিন্তু ততোধিক উত্তর ঘুরে বেড়ায় সুরাহাহীনভাবে। এতে সৃষ্টি হয় বড় বড় আরও অনেক প্রশ্ন।
ছাত্রলীগের জেলা নেতৃত্বের সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদকদের রিক্রুট করেই গোপনে দাঁড়িয়েছিল নিউক্লিয়াস। সারা বাংলাদেশে পরে যার কর্মীর সংখ্যাই হয়ে গিয়েছিল প্রায় সাত হাজার। এটিই পরে প্রকাশ্যে হয়ে ওঠে ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’। আরও পরে নিউক্লিয়াস থেকে সিরাজ-রাজ্জাক এবং এর বাইরে মণি-তোফায়েলকে (তোফায়েল আহমেদ) নিয়ে গড়ে ওঠে এর রাজনৈতিক উইং বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ), সামরিক উইং ‘জয় বাংলা বাহিনী’। এই বিএলএফ মুক্তযুদ্ধকালে ভারতে গিয়ে নাম নেয় ‘মুজিব বাহিনী’। সিরাজ ও মণির দুটি ধারা একত্রে কাজ করল বটে, তবে গোপনে অনেক কিছুই রয়ে গেল নিউক্লিয়াসের ‘ব্রেন চাইল্ড’।
সত্তরের নির্বাচন ও মুক্তিযুদ্ধকালে ডাকসুর ভিপি-জিএস ছিলেন যথাক্রমে আ স ম আবদুর রব ও আবদুল কুদ্দুস মাখন এবং ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক যথাক্রমে নূরে আলম সিদ্দিকী ও শাহজাহান সিরাজ—বঙ্গবন্ধুর প্রবাদপ্রতিম ‘চার খলিফা’। রব-সিরাজ ছিলেন সিরাজুল আলম খানের অনুসারী।
এই যে গোপনে এবং গভীর অন্তরালে থেকে একটা সংগঠনের মধ্যেই আরেকটা সাব–গ্রুপ তৈরি করে ফেলা সম্ভব হলো, তার বাহ্যিক কারণ আমরা দেখছি বিবিধ—অনেক প্রথমেরই জন্মদাতা—পতাকার নকশা থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা, ছয় দফা থেকে এগারো দফা, ১৯৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ—ছাত্রলীগ বলয়ের প্রায় সব নীতিনির্ধারণেই তাঁদের সংশ্লিষ্টতা। কিন্তু রহস্যজনকভাবেই আমরা আভ্যন্তরীণ উদ্দেশ্যটা নিয়ে সন্দিহান থেকে যাচ্ছি।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু ফিরে এলেন। তিনি তখন তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের সবচেয়ে জনপ্রিয়তার শিখরে। দেখা গেল, বঙ্গবন্ধুর ‘ডান হাত’ সিরাজুল আলম খান আশ্চর্যজনকভাবে ধীরে ধীরে দূরে চলে যাচ্ছেন। এ-ও সম্ভব! বঙ্গবন্ধুর মতো মহিরুহর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন তাঁরই প্রিয় শিষ্য! যুবলীগের দায়িত্ব চলে যাচ্ছে শেখ ফজলুল হক মণির হাতে। আরও নানা কিছু মিলিয়ে সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের সিরাজের বহু প্রস্তাব বাস্তবায়ন প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন মনে হয়। নিউক্লিয়াসের সেই যে বাহিনী, দেখা যায় তাদের হাত ধরেই তৈরি হয়ে যায় ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’-এর স্লোগান দেওয়া জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর, দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র ১০ মাসের মাথায়। নেপথ্যে থেকে দলটির পৌরহিত্য করেন সিরাজুল আলম খান, কিন্তু পদাধিকার নিয়ে সামনে আসেন না। তৈরি হয় জাসদের গণবাহিনী।
তারপর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের রক্তাক্ত হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া ধারাবাহিক বিশৃঙ্খলার পথ ধরে ৩ নভেম্বর ও ৭ নভেম্বরের ঘটনাবলি। এর মধ্যে ৭ নভেম্বরের ঘটনায় কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে জাসদ সরাসরি যুক্ত। অদ্ভুতুড়ে সব ঘটনা ঘটছে সদ্য স্বাধীন দেশে এবং অদ্ভুত সব কানাগলিপথ! রহস্যকেও হার মানায় যেন!
এসব ঘটনায় সিরাজুল আলম খানের সংশ্লিষ্টতা কী, কেন অথবা কোনটা সত্য, তা বাংলাদেশের রাজনীতিতেই শুধু নয়, আলোচনার খোরাক হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের উত্তর প্রজন্মের রাজনীতিতে, জনপরিসরে। বহু প্রশ্ন, কিন্তু ততোধিক উত্তর ঘুরে বেড়ায় সুরাহাহীনভাবে। এতে সৃষ্টি হয় বড় বড় আরও অনেক প্রশ্ন।
সিরাজুল আলম খানও সরাসরি মুখ খোলেন না। শুধু কিছু উত্তর তিনি দিয়ে যান শামসুদ্দিন পেয়ারার লেখা ‘আমি সিরাজুল আলম খান: একটি রাজনৈতিক জীবনালেখ্য’ আর মহিউদ্দিন আহমদ লিখিত ‘প্রতিনায়ক: সিরাজুল আলম খান: নিউক্লিয়াস-মুজিববাহিনী-জাসদ’ গ্রন্থে। তবু রহস্য ঘোচে না। জানার আকাঙ্ক্ষা শেষ হয় না! এই জানার কাঙ্ক্ষা থেকেই তাঁর প্রতি মানুষের কৌতূহলের জন্ম। আর বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক উত্থান-পতনময় সময়ের সাক্ষী তিনি। সেই সময় নিয়ে, যখন তেমনভাবে শব্দ করেন না তিনি, তখনই কৌতূহলের মাত্রা আরেক প্রস্থ বেড়ে যায়। তাঁকে ঘিরে পক্ষে-বিপক্ষে তৈরি হয়েছে অনেক মিথ। এসব মিথ জনপরিসরের ভেতরে বাহিত হয়েও তাঁকে রহস্যপুরুষে পরিণত করেছে বলে মনে হয়।
মাত্র ৩৫ বছর বয়সে ভারতবর্ষের শিক্ষার ইতিহাস ঔপনিবেশের দখলে নিয়ে গিয়েছিলেন থমাস ব্যাবিংটন ম্যাকওলে। মাত্র ৩৫ বছরের আরেকজন তরুণ কী নির্মোহভাবেই না বাংলাদেশের রাজনীতির একটা ভিন্নধারার প্রবক্তা হয়ে, অনেক বিরল ঘটনা ও অঘটনঘটনপটীয়সী এক অগ্নিসময়ের জন্ম দিয়ে শেষমেশ নিজেকে গুটিয়ে নিলেন।
গোপন ও রহস্যময় কোনো কিছুর প্রতি মানুষের আগ্রহ খুবই প্রবৃত্তিগত। চিরনির্ঘুম রাজনীতি থেকে তাঁর দীর্ঘ সন্ন্যাসজীবনের পরও সিরাজুল আলম খান তাই আজও বাংলাদেশে এত জনপ্রিয় ও লোকপ্রিয় লোকসংস্কৃতির অংশ। এ সংস্কৃতি সততধারায় বহমান। মানুষের মনের জিজ্ঞাসা তাঁকে ও তাঁর রাজনৈতিক মতিগতিকে রাজনৈতিক কারণেই চিরঘুমে যেতে দেবে না। জনপরিসরের রাজনৈতিক আলোচনায় তিনি প্রাসঙ্গিক পুরুষই রয়ে যাবেন।