বাংলাদেশের প্রথম রকস্টার আজম খানের আজ মৃত্যুদিন। কেন এই শিল্পী খুব দ্রুত তরুণদের মন জয় করলেন? ‘বাংলাদেশ’ গান গেয়ে একদিন তিনি যেভাবে সারা দেশ কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন, পরে তাঁর গানে সেই উত্তাপ আর থাকল না কেন?
আজম খান বাংলাদেশের এক দুর্ভাগা রকস্টারের নাম। কথাটি শুনে অনেকেই চমকে যেতে পারেন, থমকেও যেতে পারেন। আপনারা হয়তো বলবেন, যাঁকে এ দেশে ব্যান্ডসংগীতের গুরু বলে মহিমা দেওয়া হয়, ১৯৭২ থেকে ২০১১—এই ৩৯ বছরের সংগীতজীবনে যিনি অসংখ্য জনপ্রিয় রক গানের গায়ক, যাঁকে দেখে পরবর্তী প্রজন্মের অনেকেই ব্যান্ডসংগীতের জগতে এসেছেন বা আসার অনুপ্রেরণা পেয়েছেন, তাঁর নামের সঙ্গে কীভাবে এবং কোন যুক্তিতে যুক্ত হতে পারে ‘দুর্ভাগা’ বিশেষণ!
আপনাদের কথাগুলোতে যুক্তির জোর আছে বৈকি!
কিন্তু মুক্তিযুদ্ধফেরত যে দ্রোহী তরুণ ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষাপটে ‘রেললাইনের ওই বস্তিতে/ জন্মেছিল একটি ছেলে/ মা তার কাঁদে/ ছেলেটি মারা গেছে’খ্যাত ‘বাংলাদেশ’ গান গেয়ে সবাইকে একই সঙ্গে স্তম্ভিত ও বিমোহিত করেছিলেন, অচিরকালের মধ্যেই তাঁর গান থেকে সেই দ্রোহ নির্বাপিত হলো কেন? জীবনের শুরুতে দৈনন্দিনতার আবহমাখা নতুন ধরনের কথার মধ্যে রক সুরের বিট বসিয়ে যিনি ঝংকার তুলেছিলেন, ‘এত সুন্দর দুনিয়ায় কিছুই রবে না রে/ হে আল্লাহ রে হে আল্লাহ রে’ (হে আল্লাহ রে হে আল্লাহ রে), পরের দিকে তাঁর গিটারের কলতানে এমন ধারার গান, এই মরমি ও বিদ্রোহী সুর আর সেভাবে ধ্বনিত হলো না কেন?
গান আজম খান অজস্রই করেছেন। সেগুলো জনপ্রিয়তাও পেয়েছে। কিন্তু গায়ক–জীবনের সূচনালগ্নে দেশ–কাল–সমাজ ও সময়ের যে নিরেট বাস্তবতা এই কিংবদন্তি শিল্পীর গানে অনুরণিত হতে আরম্ভ করেছিল, তা কি অক্ষুণ্ন ছিল শেষ অব্দি?
উত্তর হলো, না। এরপর আবার প্রশ্ন উঠবে, তবে ছিল না কেন?
কান টানলে যেমন মাথা আসে, তেমনি একে একে এক প্রশ্ন আরেক সওয়ালের লেজ ধরে দেয় টান। তাই প্রশ্নগুলোকে এক পাশে রেখে বরং এটিই বলা যাক যে স্বাধীন বাংলাদেশের নিয়তির সঙ্গে যেন আষ্টেপৃষ্ঠ বাঁধা পড়েছিল রকস্টার আজম খানের নিয়তিও।
যে অমিত সম্ভাবনা আর স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয়, সেই সম্ভাবনা ও স্বপ্ন ফিকে হতে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পরেই। স্বপ্নভঙ্গের ঘটনাও ঘটে বিস্তর। ১৯৭১ থেকে ১৯৮১—মাত্র ১০ বছরে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পরতে পরতে যে দোলাচল আর উত্থান-পতন, আজম খানের ক্ষেত্রেও তো একই ঘটনা ঘটেছিল; অন্তত তাঁর সংগীতজীবনের পাটাতনে নজর দিলে তা-ই মনে হয়।
১৯৭৩ সালে ‘উচ্চারণ’ নামের ব্যান্ড গঠনের এক বছরের মধ্যে তা ভেঙে যাওয়া, যাঁদের নিয়ে তিনি ব্যান্ড গড়েছিলেন, বিভিন্ন তাঁবুতে তাঁদের সটকে পড়া—কেউ কেউ বলেন, ‘উচ্চারণ’-এর এই ভাঙনের পেছনে নাকি তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর কারও কারও প্রচ্ছন্ন ইশারা ছিল। এ প্রসঙ্গে ‘হিস্ট্রি অব বাংলাদেশ রক: দ্য লেগাসি অব আজম খান’ বইটির শরণ নেওয়া যেতে পারে। আজম খানের জীবন ও সংগীতের ভেতর-বাহির ঘেঁটে এটি লিখেছেন আরেক খ্যাতিমান ব্যান্ডসংগীত শিল্পী মাকসুদুল হক। আর ‘বাংলাদেশের রকগাথা: আজম খানের উত্তরাধিকার’ শিরোনামে এর অনুবাদ করেছেন তানভীর হোসেন। এ বইয়ে আজমের ‘বাংলাদেশ’ গানটি লেখা এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনে সেটি পরিবেশনের পর তাঁর সংগীতজীবনে যে বিপত্তি নেমে আসে, সে সম্পর্কে বিশদে লিখেছেন মাকসুদ। নিজেকে ওই গান প্রচারের সময়কার প্রত্যক্ষদর্শী দাবি করে মাকসুদ লিখেছেন, ‘সাদাকালো টেলিভিশনের পর্দার সামনে আমরা সেদিন রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছিলাম। আজম খান মঞ্চে এসে নিজের স্বভাবসুলভ ঢঙে গাইতে শুরু করলেন। তূরীয় আনন্দে হেডব্যাংগিং করতে করতে তিনি শুরু করলেন...এরপর তাঁর তিনটি গানে সাজানো সেটটির আগে যখন তিনি এলেন, তখন কাঁপিয়ে দেওয়ার মতো একটা ঘোষণা দিলেন। বললেন, “যাঁরা ইতিমধ্যেই মৃত বা মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন, এই নতুন গানটি তাঁদের জন্য।”...“বাংলাদেশ” গানটি ছিল সুপারহিট। এর জনপ্রিয়তা ছিল আঁকাশছোয়া।...রাতারাতি গানটি মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। জীবনের দুঃখ-দুর্দশাকে উপজীব্য করে কেউ অন্তত এমন একটা গান বেঁধেছেন, এ বিষয়টি আমাদের অভিভাবক ও বয়োজ্যেষ্ঠদেরও গভীরভাবে নাড়া দেয়।... গানটার ক্ষুরধার কথাগুলো আজম খান লিখেছিলেন সেই দুর্ভিক্ষের একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে।...বিটিভিতে প্রচারের পরপরই “বাংলাদেশ” গানটিকে অনানুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ করা হয়।’
‘এরপর তাঁর তিনটি গানে সাজানো সেটটির আগে যখন তিনি এলেন, তখন কাঁপিয়ে দেওয়ার মতো একটা ঘোষণা দিলেন। বললেন, “যাঁরা ইতিমধ্যেই মৃত বা মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন, এই নতুন গানটি তাঁদের জন্য।”... “বাংলাদেশ” গানটি ছিল সুপারহিট। এর জনপ্রিয়তা ছিল আঁকাশছোয়া।...রাতারাতি গানটি মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। জীবনের দুঃখ-দুর্দশাকে উপজীব্য করে কেউ অন্তত এমন একটা গান বেঁধেছেন, এ বিষয়টি আমাদের অভিভাবক ও বয়োজ্যেষ্ঠদেরও গভীরভাবে নাড়া দেয়।...গানটার ক্ষুরধার কথাগুলো আজম খান লিখেছিলেন সেই দুর্ভিক্ষের একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে।...বিটিভিতে প্রচারের পরপরই “বাংলাদেশ” গানটিকে অনানুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ করা হয়।’
দীর্ঘদিন ধরে ব্যান্ডসংগীতের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও শুরুর পর্বে আজম খানের গানে দ্রোহের যে আঁচ আর দৈনন্দিনতার যে ছোঁয়া পাওয়া যেত, তাঁর নিজের অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন এবং নিপীড়নমূলক রাজনৈতিক বাস্তবতার দরুন সেই দ্রোহের আগুন দিনে দিনে ছাই হয়ে গিয়েছিল। সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক—নানান বৈতরণি ডিঙাতে ডিঙাতে তিনি যেন হয়ে উঠেছিলেন অনেকটাই নিঃসঙ্গ। তাই পরের দিকে এই তারকার সাংগীতিক উচ্চারণে আগুন যতটুকু ছিল, তাকে ‘ছাইচাপা আগুন’-এর সঙ্গে তুলনা করলে বোধকরি অত্যুক্তি হবে না!
১৯৭৭-এরপর থেকে আজম খানের কণ্ঠে যেসব গান আমরা শুনতে পাই, তার বেশির ভাগই অন্যের লেখা ও সুর করা। প্রেম–বিরহ ও রোমান্টিকতাই সেসব গানের প্রধান আধেয়। তবে এই গানগুলোতেও আজম খান যে শ্রোতা-দর্শকের মন ছুঁয়ে গেলেন, এর কারণ যেমন রক সংগীতের ধ্বনি ও তাল, তার চেয়েও বেশি হলো তাঁর নিজস্ব গায়নভঙ্গি।
কী ছিল আজম খানের গায়কিতে? সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষ কেন গ্রহণ করল অজানা-অচেনা এই তরুণকে?
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নকে বাস্তবের মটিতে প্রোথিত করেছে। আর মুক্তিযোদ্ধা আজম খান এ দেশের মানুষকে প্রথমবারের মতো দিয়েছেন বাংলায় ব্যান্ডসংগীত উদ্যাপনের স্বাদ ও সাহস। এই তথ্যগুলো সবারই জানা।
আমরা এ-ও জানি, মুক্তিযুদ্ধের সময় ২ নম্বর সেক্টরে মেজর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে অসমসাহসে যুদ্ধ করেছিলেন ২১ বছরের তরুণ আজম খান। ১৯৫০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় জন্ম নেওয়া এবং একই নগরের কমলাপুরে বেড়ে ওঠা এই তরুণের সংগীতে হাতেখড়ি হয় তাঁর মা যোবেদা খাতুনের মাধ্যমে। তখন চারপাশে পরাধীন পাকিস্তানের বাস্তবতা। ১৮ বছর বয়সে তিনি যুক্ত হন ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠীর সঙ্গে। এই সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে সে সময় বামপন্থী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের যোগ ছিল। আর এই সংগঠনভুক্ত হয়ে নবম শ্রেণিপড়ুয়া আজম খানও বামপন্থার পাদদেশে শামিল হন। পরবর্তীকালের বাংলা ব্যান্ড সংগীতের এই পথিকৃতের গানের জগৎ এবং তাঁর গানে দৈনন্দিন ঘটনাপ্রবাহ ও দ্রোহের স্ফুলিঙ্গ কীভাবে উত্থিত হলো, বিষয়টি বুঝতে হলে বামপন্থার সঙ্গে তাঁর এই যোগসাজশকে আমলে নেওয়া জরুরি।
অবশ্য এ ঘটনা যখন ঘটছে, তত দিনে পাকিস্তানবিরোধী গণ-আন্দোলন পালে হাওয়া পেয়েছে। এরপরের ঘটনাও সবার জানা, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এক নদী রক্ত পেরিয়ে লাল-সবুজ পতাকায় ঢাকা বাংলাদেশের জন্ম হলো।
যুদ্ধজয়ের পর ১৯৭২ সাল থেকেই গান নিয়ে আবার মাতলেন আজম খান। গেল শতকের ষাটের দশকে বিশ্বব্যাপী যে রক সংগীতের উত্থান, আগেই বলেছি, সত্তরের দশকের শুরুতে বাংলাদেশে সেই ধারায় বাংলা ব্যান্ডগানের পত্তন হলো আজম খানের হাতে। ইল্যান্ডের বিখ্যাত ব্যান্ড বিটলসের জন লেনন, জর্জ হ্যারিসন প্রমুখ শিল্পী ছিলেন তাঁর আদর্শ। তাঁদের গানের উন্মাতাল সুর ও কথা বিশ্বের নানা সামাজিক বাস্তবতাকে যেমন ধারণ করেছিল, আমাদের এখানে আজম খানও এগোলেন সেই ধারায়। তাঁর প্রধম দিককার হিট গান ‘হে আল্লাহ হে আল্লাহ রে’–এর শুরুতে আমরা শুনতে পেলাম গিটারের তীব্র জ্যামিং। এরপরই শুরু হলো, ‘এত সুন্দর দুনিয়ায় কিছুই রবে না গো/ হে আল্লাহ হে আল্লাহ রে...।’ গানের আবহ মরমি হলেও কথাগুলো ছিল খুবই সাধারণ, সহজবোধ্য। আবার ওই শুরুর পর্বেই ‘হাইকোর্টের মাজারে’ শিরোনামের গানটিতে উঠে এসেছে রাজধানী ঢাকার হাইকোর্টের মাজার। ‘হাইকোর্টের মাজারে/ কত ফকির ঘোরে/ আসল ফকির কয়জনা’—গানটির আদতে মধ্যে কী আছে? মরমিয়া গড়নের এ গানেও পাওয়া যায় খুব সাধারণ ওই আটপৌরে কথাই। কথিত আছে, হাইকোর্টের মাজারের ফকিরদের দেখে তিনি গানটি লেখেন। আবার তাঁর বিখ্যাত ‘আলাল ও দুলাল’ গানে উঠে আসে চিরচেনা পুরান ঢাকার চিত্র, ‘আলাল ও দুলাল/ আলাল ও দুলাল/ তাদের বাবা হাজি চান/ চানখাঁ পুলে প্যাডেল মেরে পৌঁছে বাড়ি/ আলাল ও দুলাল/ আলাল যদি ডাইনে যায়/ দুলাল যায় বাঁয়ে/ তাদের বাবা সারা দিন খুঁজে খুঁজে মরে।’
গদ্য ঢঙের এবং দৈনন্দিন কেজো কথাগুলোকে সুরের মধ্যে ভাসানো এমন গান এর আগে শুনেছিলাম কি আমরা?
বাংলাদেশের সংগীতে ‘উচ্চারণ’ ব্যান্ডের মাধ্যমে এই প্রথম উচ্চারিত হলো নগর ঢাকার বাস্তবতা। এখানকার মানুষ যে ভাষা ও ভাবে কথা বলে, গানেও তার প্রতিফলন মিলল।
বেশ অনেক কাল ধরেই বাংলা গানের কথাগুলো ছিল সাহিত্যগন্ধী, কাব্যের শাসনে শাসিত ও ছন্দোবদ্ধ। এসব গানে দীর্ঘদিন আমরা যেসব উপাদান পেয়ে আসছিলাম, তার মধ্যে চাঁদ, সূর্য, প্রিয়া, ফুল, পাখি—এগুলোর আধিক্যই ছিল বেশি।
অন্যদিকে আজম খানের লেখা ও গাওয়া গানগুলোতে সেই কাব্যিক বাস্তবতার ঠাঁই একদমই মিলল না। পরিবর্তে সে স্থানে পাওয়া গেল তাঁর চারপাশের দেখাশোনার জগৎ, নিরেট বাস্তবতা। এমনকি তাঁর প্রেমের গান থেকেও উধাও হলো এসব অনুষঙ্গ। ‘পাপড়ি’ গানটির দিকে তাকালে বিষয়টি হয়তো স্পষ্ট হবে, ‘সারা রাত জেগে জেগে,/ কত কথাই আমি ভাবি।/ পাপড়ি কেন বোঝে না?/ তাই ঘুম আসে না।/ পাপড়ি কেন বোঝে না?/ তাই ঘুম আসে না।’
বলাবাহুল্য, একেবারেই সরল–সহজ, সাধারণ কথায় প্রেমের অনুভূতিগুলো ধরতে চাওয়া হয়েছে এখানে। ফলে এসব গানের সঙ্গে আমাদের বোঝাপড়াও হয়েছিল খুব সহজেই। আর আজম খানের এ গানগুলো তো কেবল ছন্দ ছাড়া নয়, ছিল খানিকটা ছন্নছাড়াও।
এর আগে নাগরিক মানুষদের গান শোনার অভ্যস্ততার মধ্যে আসন গেড়ে ছিলেন রবীন্দ্র-নজরুল, গণসংগীত, লোকসংগীত এবং আধুনিক ধারার কিশোর কুমার, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, শ্যামল মিত্র, আব্বাসউদ্দীন আহমদ, আবদুল আলীম প্রমুখ শিল্পী। বলা দরকার, এসব গানের কাব্যসিক্ত বাণীর সঙ্গে মিলিয়ে গাওয়ার ভঙ্গিটিও ছিল সুরেলা। এমনকি গণসংগীত ও লোকসংগীতের কথায়ও অনেক ক্ষেত্রে জারি ছিল কাব্য ও ভাবসম্পদের শাসন। গানের কথাগুলো অনেকটা যেন ছিল দৈনন্দিনতার বাইরের সামগ্রী।
তবে সদ্য স্বাধীন দেশে সবকিছু যখন নতুন হাওয়ায় উদ্বেল, গানেও তখন নতুনত্ব এল। কী কথায়, কী গায়কিতে আজম খানই প্রথম নিয়ে এলেন সেই নতুন রকমের গান। তাঁর গানের কথায় একই সঙ্গে হাজির হলো টুকরা টুকরা দৈনন্দিনতা এবং স্বাধীনতা–উত্তর বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্নভঙ্গের বেদনা। আরও স্পষ্ট করে বললে, স্বাধীন দেশে নতুনভাবে গড়ে উঠছিল যে ঢাকা, সেই নগর আর নাগরিকদের মানসিকতা মূর্ত হলো তাঁর গানে। যুদ্ধফিরতি তরুণেরা আজম খানের গানের মধ্যে যেন নিজের ভাষা খুঁজে পেলেন, খুঁজে পেলেন নিজেদেরও।
একাত্তরে যে তরুণেরা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন, দুচোখভরা স্বপ্নকে সঙ্গী করে, তাঁরা ফিরে এসেছিলেন একধরনের গতি নিয়ে। আজম খানের রক গানে—গিটার, ড্রামসের উদ্দাম বিটের তরঙ্গে তরঙ্গে যে গতি উৎপন্ন হলো, এই শিল্পীর দ্রুত জনপ্রিয়তার পেছনে সেই গতিশীলতার কি ভূমিকা ছিল না? বরং এই শিল্পীর গানের কথার ভেতরে তরুণদের নিজেকে আবিষ্কার এবং রক সংগীতের সুরের গতিময় উন্মাদনা—দুইয়ে মিলে একটা মানিকজোড়ের ঘটনা ঘটল বেশ। যেনবা অনেক নদীর ঢেউ মিলল একই মোহনায়।
তা ছাড়া আজম খানের কণ্ঠের নিজস্ব এক গড়ন ছিল, তাঁর দ্রুত প্রসারের নেপথ্যে এটিও ছিল সমানভাবে ত্রিয়াশীল।
গায়নভঙ্গির দিক দিয়ে আজম খানের কণ্ঠটি ছিল বেশ উচ্চকিত, আবার দরদিও। এর আগে যেসব সংগীতশিল্পী আমাদের আচ্ছন্ন করেছিলেন, তাঁদের গায়কিতে পরিপাট্য ছিল অনেক বেশি, শুদ্ধতাও ছিল ঢের। গানকে সুনিয়ন্ত্রিত একটি সুরেলা আবহে শুনতেই অভ্যস্ত ছিলাম আমরা।
তবে গানের ক্ষেত্রে আজম খান গলার ওই পরিপাট্য আর শুদ্ধতার ধার ধারেননি। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি আসলে গায়ক না বেসিক্যালি, জেদের বশে এই লাইনে আসা।’ তিনি যে ‘বেসিক্যালি গায়ক’ ছিলেন না, এটিই বোধ হয় শাপেবর হয়েছিল তাঁর জন্য, নিজের মতো করে গাইতে পেরেছিলেন।
গড়নগতভাবেই রক এক ভিন্ন ধারার গান। আজম খান যখন এই ধারায় গাইতে শুরু করলেন, সে সময় বোধ করি তাঁর একটা বড় সম্বল ছিল তাঁর নিজস্ব গায়কি—উচ্চকিত কণ্ঠ, যা প্রথাগতভাবে অতটা সুরেলা নয়, বরং সুরের বিধ্বংসী উন্মাদনায়, গিটারের জ্যামিংয়ে, ড্রামসের বিটে সবকিছুকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে। আর এখানে কথা ও সুরের দ্বৈরথে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, যা প্রতিনিয়ত আমাদের ধাক্কা দেয়। আজম খানের একটি স্মৃতির উল্লেখ করে মাকসুদুল হক রক সংগীতে এই ‘ধাক্কা’ বিষয়টি নিয়ে এই শিল্পীর বোঝাপড়া উন্মোচন করেছেন তাঁর বইয়ে। সেখানে আজম খানের ভাষ্য এমন, ‘রক মানেই কোনো আওয়াজ নয়, বরং এটা হলো একের পর এক ধাক্বার প্রবাহ।’
সন্দেহ নেই, আজম খানের গানের ওই ‘ধাক্কার প্রবাহ’ই আমাদের অনুভূতিতে একসময় ঘা মেরেছিল। যে কারণে তারকা হতে তাঁর সময় লাগেনি। ১৯৭২ সালের শেষাশেষি বাংলাদেশ টেলিভিশনে তিনি ও তাঁর দল প্রথম যখন গাইলেন, ‘ওরে সালেকা ওরে মালেকা ফুলবানু পারলি না বাঁচাতে’, তখন থেকেই তরুণ্যের পছন্দের শিল্পী আজম খান। এই পছন্দ অব্যাহত থাকল পরের কয়েকটি প্রজন্মজুড়ে।
আজম খান কেন তরুণসমাজের কাছে খুব দ্রুত আইকনে পরিণত হলেন, তা বিশ্লেষণ করতে গেলে অনালোচিত আরেকটি কারণও সামনে আসবে।
গানের কথায় এই রকস্টার যেমন ঢাকাইয়া বা খাঁটি পূর্ব বাংলার আমেজ জারিত করেছেন, একইভাবে তাঁর গায়কির যে ধরন, তাতেও ছিল পূর্ববঙ্গের ছোঁয়া। আমাদের এখানে তখন যাঁরা গান করতেন, সবার ভেতরেই ছিল পরিপাট্য, একধরনের পূর্বধারণা বা শিখে–পড়ে আসার ব্যাপার ছিল। তা ছাড়া দেশভাগের আগে কলকাতা যেহেতু ছিল বাঙালির শিল্প–সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র, গানের ক্ষেত্রে তাই স্বভাবতই এখানে কলকাতাকেন্দ্রিক শিক্ষার একটা চল ছিল। সংগত কারণে অধিকাংশ শিল্পী এখানে কলকাতার গায়নভঙ্গিতে গান করতেন।
কিন্তু গানের তেমন কোনো প্রথাবদ্ধ শিক্ষা না থাকায় এবং অনেকটা ‘গাইতে গাইতে গায়েন’ হওয়ার কারণে আজম খানের গায়কি ছিল আলাদা। পূর্ববঙ্গের সাধারণ মানুষ যেভাবে জোরালো কণ্ঠে—কোনো কোনো ক্ষেত্রে অতটা পরিশীলনের তোয়াক্কা না করে—গান করে, তাঁর গায়কিতেও পাওয়া যায় সেই ধাঁচ। বললে ভালো হয় যে এই ধাঁচটাই তিনি পুরে দিয়েছিলেন পাশ্চাত্য থেকে আসা বাংলা রক গানের মধ্যে। আমাদের দেশে এই ধারার প্রবর্তকই তিনি। ফলে তাঁর গায়কি যে নতুন হবে এবং বাংলার মানুষ সেই গান যে গ্রহণ করবে, আপন বলে মেনে নেবে, এতে আর সন্দেহ কী!
তবু আজম খান বাংলাদেশের এক দুর্ভাগা রকস্টার—লেখার সেই শুরুর কথাটিই এখানে আবার ধুয়া হিসেবে ব্যাবহার করা যাক।
১৯৭৪ সালে ‘বাংলাদেশ’ গানটি অনানুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ হওয়ার পর আজম খানের জীবনে বিপর্যয় নেমে আসে। সেই সময়ের বাস্তবতায় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি বৈরী হয়ে ওঠে তাঁর জন্য। এ সময় তিনি খানিকটা অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনেও অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। মাকসুদুল হকের বই থেকে আবারও উদ্ধৃত করি, ‘...আসক্তি আরও বেড়ে গেলে এবং সাথে নিজের ক্ষ্যাপাটে স্বভাবের কারণে একটা নার্ভাস ব্রেকডাউন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে আজম খানের। হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাঁকে।’
এই পরিস্থিতিতে একদিকে তাঁর ব্যান্ডে ভাঙন দেখা দেয়, অন্যদিকে তাঁর সতীর্থ অনেক শিল্পীর কাছেও আশ্রয় পাননি তিনি। সব মিলিয়ে এই রকস্টারের গানে দ্রোহের অপনোদন শুরু হয় মূলত এ সময় থেকে। না চাইলেও দিনে দিনে হয়তো জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে আপস করা শিখতে হচ্ছিল এই মুক্তিযোদ্ধাকে? আর তাঁর জীবনের সেই বিপৎসংকুল সময়টি বাংলাদেশের জন্যও ছিল ভীষণ ঝঞ্ঝাবিক্ষুদ্ধ। ১৯৭৫ সালে সপরিবার বঙ্গবন্ধু নিহত হলেন। এরপর অভ্যুত্থান–পাল্টা অভ্যুত্থানের ধারাবাহিকতায় অনেক বছর ধরে দেশে চলল স্বৈরশাসন। জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলেও আজম খান যে খুব আদৃত ছিলেন, এমন নয়। সামরিক শাসনের সময় দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্ধ হয়ে যায় কনসার্ট। সেই সূত্রে ওই সময় আজম খানও ছিলেন কনসার্টহীন। পরে কনসার্টকে কেন্দ্র করে নিষেধাজ্ঞার অর্গল খানিকটা উন্মুক্ত করা হলেও আজম খানের দু–একটি কনসার্টে ‘ঝামেলা’ হয়। নোয়াখালীতে তাঁর কনসার্ট চলাকালে এক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। শাসককুল ছাড়াও এ সময় আজম খানের প্রতিপক্ষ ছিলেন তাঁরই দু–একজন সতীর্থ শিল্পী। তিনি যাতে কোনোভাবেই কনসার্ট না পান, সেই ব্যবস্থা পাকা করতে তাঁর নামে চালানো হয় নানান রকম অপপ্রচার। ফলে ‘বাংলাদেশ’ গানে একদা যে তেজি আজম খান লিখেছিলেন, ‘কত আশা ছিল তাঁর জীবনে/ সব স্মৃতি রেখে গেল মরণে/ মা তাঁর পাশে চেয়ে বসে আছে/ হায়রে হায় বাংলাদেশ’, তাঁর গিটারে ও গলায় এমন গান আর উঠল কই!
একাত্তর থেকে পাওয়া তেজ বুকের ভেতরে পুষে রেখেই বোধ করি তিনি চলে গেলেন। শারীরিকভাবে জীবিত থেকে ‘মরণেই’ কি রেখে গেলেন ‘সব স্মৃতি’? যেভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন মফস্সলে অনেক মুক্তিযোদ্ধা বুকের দ্রোহকে নির্বাপিত করে ‘মৃত্যের মতো বেঁচে ছিলেন’, রাজধানী ঢাকার আজম খানের ক্ষেত্রেও কি এটি সত্য?
আজম খানের প্রথম দিকের গান যতটা দেশিয় বাস্তবতা আর দৈনন্দিতার স্পর্শঘেরা, ১৯৭৭–৭৮–এর পর থেকে তাঁর গানে সেই উত্তাপ অনুপস্থিত। পরের দিকে তিনি নিজে আর গান লেখেননি বললেই চলে, অন্যের কথা ও সুরে কেবল গলা মিলিয়েছেন।
এই বাস্তবতা মনে রেখে আমাদের দুর্ভাগা রকস্টার আজম খান কি শেষমেশ ওই ‘ফুল–পাখি–চন্দ্র–সূর্য’ময় কাব্যগন্ধী গানেও সুর মেলাননি? জীবনের প্রয়োজনে আমাদের তো অনেক কিছুই করতে হয়, তাই না?
১৯৭২ সালে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘রাজা যায় রাজা আসে’–এর উৎসর্গপত্রে কবি আবুল হাসান লিখেছিলেন, ‘আমার মা আমার মাতৃভূমির মতোই অসহায়।’ নানা কারণেই সম্ভবত আজম খানও ‘মাতৃভূমির মতোই অসহায়’ ছিলেন।
তবে তিনি ছিলেন আমাদের প্রথম রকস্টার। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম স্টারও কি নন? দুর্ভাগা রকস্টার হয়েও যিনি এই বাংলায় নতুন ধারার গানের দুয়ার খুলে দিয়েছিলেন।
কী আশ্চর্য! এখনো যখন ইউটিউবে তাঁর ‘বাংলাদেশ’ গানটি শুনি, আমাদেরও মনে হয়, আমরাও তো অসহায়! মাতৃভূমির মতো অসহায়!