‘হাত বাড়িয়ে ছুঁই না তোকে মন বাড়িয়ে ছুঁই...’ কবিতায় এমন সহজ–অনায়াস অভিব্যক্তিই পাঠকপ্রিয় করে তুলেছে তাঁকে। বাংলাদেশের জনপ্রিয় কবি নির্মলেন্দু গুণের আজ ৮০তম জন্মদিন। তাঁকে নিয়ে আয়োজন
এ লেখার শিরোনামটা সিদ্ধান্তসূচক। ফলে পদ্ধতিগত দিক থেকে কিছুটা ত্রুটিপূর্ণ বটে। কিন্তু কিছু সিদ্ধান্ত তো আমাদের চারপাশে অর্থবহভাবে তৈরি হয়েই থাকে। এসব ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তের কার্যকারণই শুধু চিহ্নিত করা যায়। এ লেখার উদ্দেশ্যও তা–ই। লেখার শিরোনামের মধ্যকার ‘জনপ্রিয়’ শব্দটি ঘিরে কারও কারও মধ্যে একটা সন্দেহের গুমোট পাক খেয়ে উঠতে পারে। ‘কবিতার এই আকালের যুগে’ সন্দেহ হওয়াটা খুব অমূলক নয়। সংশয়বাদীদের সন্দেহটা ভাঙাতে এখানে আমি নির্মলেন্দু গুণের বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থের সংস্করণ বা পুনর্মুদ্রণের সংখ্যার একটা তালিকা হাজির করতে পারতাম। পারতাম কিছু সমীক্ষা তুলে ধরতে। কিন্তু সেটা করণিক কার্য হবে মাত্র।
বাংলাদেশের কাব্য-কবিতা–শিল্পসাহিত্য বিষয়ে যাঁদেরই একটু প্রাথমিক খোঁজখবর আছে, তাঁরা বোধ করি খুব বেশি দ্বিমত করবেন না যে নির্মলেন্দু গুণ যথেষ্ট পাঠকপ্রিয় কবি। এখানে শুধু একটা তথ্য দিয়ে রাখি। আমার কাছে কাকলী প্রকাশনীর নির্বাচিতা নামে নির্মলেন্দু গুণের নির্বাচিত কবিতার যে সংকলনটা আছে, সেটা ২০২০ সাল পর্যন্ত নবম সংস্করণে পৌঁছেছে। অবশ্য গুণের কোনো একটা বিশেষ কাব্যগ্রন্থের কোনো একটা সংস্করণ দেখে তাঁর বই বিক্রির সঠিক সংখ্যা বোঝা যাবে না। কারণ, তিনি একই বই একই সময়ে একাধিক প্রকাশনীকে দেন প্রকাশের জন্য। ব্যাপারটার মধ্যে কেউ বাণিজ্য-বাণিজ্য গন্ধ পেতে পারেন। কিন্তু বলা দরকার, নির্মলেন্দু গুণ প্রথম যৌবনেই কবিতার মধ্যে বলে নিয়েছিলেন যে কবিতা কেবল তাঁর ‘নেশা’ নয়, ‘প্রতিশোধ গ্রহণের হিরণ্ময় হাতিয়ার’ও নয় শুধু। কবিতা যুগপৎভাবে তাঁর ‘পেশা’ও বটে। (দেখুন: ‘অসমাপ্ত কবিতা’/প্রেমাংশুর রক্ত চাই)
নির্মলেন্দু গুণের কাব্যগ্রন্থ মানুষ পড়ে। কিছুটা স্থূল হলেও এর আরও একটা অসাহিত্যিক প্রমাণ হাজির করা যেতে পারে। সেটা হচ্ছে, তিনি বহুকাল ধরে লেখালেখি করেই জীবিকা নির্বাহ করেন। অন্য কোনো কাজ করেন বলে অন্তত আমার জানা নেই। যত দূর জানি, এ ধরনের লেখক বাংলাদেশে দুজন আছেন। একজন প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদ। অন্যজন জীবিত নির্মলেন্দু গুণ। জনপ্রিয়তাই হুমায়ূনকে সর্ব-আরামের আকর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চাকরিটাও ছাড়তে উদ্বুদ্ধ করেছিল। নির্মলেন্দু গুণও একসময় সাংবাদিকতা করতেন। লিখে জীবিকা নির্বাহ করতে পারবেন—এই আত্মবিশ্বাস থেকেই সম্ভবত সাংবাদিকতার মতো কবিতাচর্চার অনুকূল পেশাটাও ছেড়ে দিয়েছেন। বাংলাদেশে সব কবি-সাহিত্যিক মিলে হাহাকার করেন যে এ দেশে লেখালেখিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করা যায় না। এই মাতমের মধ্যেই লেখালেখি করে নির্মলেন্দু গুণ দিব্যি একটা জীবন পার করে দিচ্ছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, গুণের কবিতার কোন গুণ তাঁকে এতটা জনপ্রিয় করে তুলেছে; কবিতাকে পেশা হিসেবে নেওয়ার সাহস জুগিয়েছে!
নির্মলেন্দু গুণ সার্বক্ষণিক কবি। যেকোনো সময় যেকোনো কিছু তাঁর কবিতার বিষয় হয়ে উঠতে পারে। প্রেমিকার নীল রঙের ব্রা থেকে লেনিন পর্যন্ত সবই কখন অতর্কিতভাবে কবিতা হয়ে উঠবে গুণের গুণী হাতে, তা যেন কেউ বলতে পারে না।
নির্মলেন্দু গুণের কবিতার পাঠকপ্রিয়তার অন্যতম কারণ এর প্রসাদগুণ; সহজবোধ্যতা; চিন্তার সার্বভৌমত্ব। গুণ লিখতে বসে কারও ধার-না-ধারা কবি। কে কোন কথা কীভাবে বলেছে, সেসবের তিনি কোনো দিনই ধার ধারেননি। ব্যক্তিগত হৃদয়, মনন ও সৃজনপ্রক্রিয়ার ওপরই তাঁর সবচেয়ে বেশি আস্থা। কারও কোনো জনপ্রিয় তত্ত্ব বা চিন্তার ধারেকাছে জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে মাথা নত করা তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ। ঔদ্ধত্য, নৈরাজ্য আর স্বরাটব্যক্তিত্ব নির্মলেন্দু গুণের কবিতার তিন বড় শক্তি। নিজেকে আলাদাভাবে শনাক্ত করতে এক কবিতায় তিনি বলেছেন, আমার বেশভূষা রবীন্দ্রনাথের মতো হলেও আমি কিন্তু রবীন্দ্রনাথ না; আমি নির্মলেন্দু গুণ।
রাজরাজড়া থেকে বেশ্যা পর্যন্ত সবাই তাঁর কবিতার ভূগোলে বাঙ্ময় হয়েছে। এই অভাবনীয় বৈচিত্র্যময় বিষয়ের প্রকাশের ব্যাপারে তিনি বরাবরই অকপট; ভানভণিতাহীন; সর্বসংস্কারমুক্ত। তাঁর কবিতা পড়লে মনে এই প্রতীতী জন্মে যে গুণ যা বোঝেন না, তা নিয়ে কবিতা লেখেন না। গুণের দুর্বল কবিতাটাও অপরিচ্ছন্ন নয়। তাঁর প্রায় সব কবিতাই আবিলতা ও ধোঁয়াশামুক্ত; ‘ক্রিস্টাল ক্লিয়ার’। শুধু বিষয়ের ক্ষেত্রে নয়, তাঁর কবিতার ভাষা থেকে শুরু করে শিল্পসজ্জা পর্যন্ত সবকিছুর মধ্যেই একটা আলোঝলমলে ব্যাপার আছে। ফলে গুণের কবিতা পাঠ করতে গেলে ভাব ও ভাষার দুর্বোধ্যতাকে মোকাবিলা করতে হয় না। সহজবোধ্যতার এই গুণটি গুণের কাব্যজীবনের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত জারি আছে। বাংলাদেশের কবিতা ভাব ও ভাষার দুর্বোধ্যতা বা অস্পষ্টতার কারণে যে ক্রমাগত সাধারণ শিক্ষিত পাঠকের আগ্রহের বাইরে চলে গেছে, নির্মলেন্দু গুণের কবিতার ক্ষেত্রে তা কখনো ঘটেনি। ফলে তাঁর কবিতা পাঠকসমাজে অন্য অনেকের চেয়ে বহুগুণ বেশি আদৃত হয়েছে। গুণ তাঁর কবিতার গুণটি সম্পর্কে নিজেই বলেছেন, ‘আমার যা বলবার স্পষ্ট করেই আমি তা বলবার চেষ্টা করি। যা কঠিন, আমার মন তাতে সহজে সাড়া দেয় না। সহজ করে পাওয়ার মধ্যে একটা সহজ আনন্দ আছে। চারপাশের কঠিনের ভিড়ে আমি চাই সহজ করে বলতে। জানি এ-স্বভাব নাগরিক কবির নয়, লোককবির। মৈমনসিংহ গীতিকার কবিদের মধ্যে আমার জন্ম। আমার জীবনের প্রথম ষোলো বছর কেটেছে গ্রামের আউল-বাউল আর চাষাভুষাদের মধ্যে। ...সেখানেই আমার কবিসত্তার জন্ম হয়েছে।’ (নির্বাচিতা গ্রন্থের ‘প্রথম সংস্করণের ভূমিকা’ দ্রষ্টব্য)
ভাটি অঞ্চলের ওই ‘লোককবি’দের সহবত কি তবে ভাটির মানুষ নির্মলেন্দু গুণের কবিতার মধ্যে আখ্যানধর্মিতার লক্ষণকে প্রকটিত করে তুলেছে! গুণের কবিতায় একাধারে কথক এবং কবির সহাবস্থান লক্ষ করা যায়। কবিতায় তিনি তাঁর কহতব্যকে অধিকাংশ সময় আখ্যানের মোড়কে মুড়িয়ে বলেন এবং এর ভেতরেই কবিত্বের ঝলক দেখান। ফলে পাঠকের সঙ্গে সহজেই তাঁর কবিতা কার্যকরী যোগাযোগ করে উঠতে পারে। গুণের অধিকাংশ জনপ্রিয় ও বিখ্যাত কবিতাই গল্পচ্ছলে লেখা মূর্ত কবিতা। যেখানে অখণ্ড গল্প নেই, সেখানেও টুকরো টুকরো গল্প থাকে। যেখানে তা–ও থাকে না, সেখানে তিনি থাকেন সাধারণ মানুষের যাপিত জীবনের পর্যাপ্ত অনুষঙ্গের জগতের ভেতর। তাঁর মনোলগ কবিতাও কথকতা। ফলে গুণের কবিতা কখনো পাঠককে ছেড়ে দেয় না। ‘টেক্সট’–এর মধ্যে পাঠকের অপরায়ণ ঘটে না। তা সে সাধারণ পাঠকই হোক আর বিদগ্ধ পাঠকই হোক। কে না জানে, মূর্ত কবিতার কারবারি বড় কবিরাই সাধারণত পৃথিবীজুড়ে জনপ্রিয় হয়ে থাকেন। গুণের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম হয়নি।
বহু মানুষের সত্তার সঙ্গে যুক্ত কবিতা বহু মানুষের প্রিয়তা অর্জন করে—এটাই স্বাভাবিক। সারা পৃথিবীর ইতিহাসে তো তা-ই দেখি। গুণের কবিতা বাংলাদেশের মানুষের সত্তার খুব ঘনিষ্ঠ বিভিন্ন রাজনৈতিক ইতিহাসের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। কবি হিসেবে গুণের জন্মই তো উনসত্তরের গণ–অভ্যুত্থানের গর্ভ থেকে। প্রেমাংশুর রক্ত চাই কাব্যগ্রন্থের প্রায় প্রতিটি কবিতা সেই সাক্ষ্যই বহন করছে। এ ছাড়া ছয় দফা, মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৭৫-এর ট্রাজেডি, স্বৈরশাসনবিরোধিতা—কোথায় নেই গুণের কবিতা! তাঁর অনেক কবিতা প্রায় নির্বিকল্পভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে দরকার হয়ে পড়ে। এসব কবিতার অনেকগুলো আবার সাধারণ মানুষের মুখে মুখে চালু আছে। এই তো গুণের কবিতার জনপ্রিয়তার সাতকাহনের এক কাহন!
বাংলাদেশের সাহিত্যে সাম্যের রূপায়ণ বরাবরই অতিমূল্যায়িত হয়েছে। আজও হয়। সাহিত্য মূল্যায়নের এই ব্যাপারটা ঘটে সাহিত্যের ওপরমহলে। এই চিলেকোঠার মূল্যায়নই ক্রমে গড়িয়ে ছড়িয়ে সাধারণ্যে প্রবেশ করে। ফলে ওই ‘বামাচারী’ লেখক সম্পর্কে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে একধরনের মিথ তৈরি হয়। নির্মলেন্দু গুণের কাব্য-কবিতার ক্ষেত্রে তেমনটি না ঘটলেও তিনি ওই সাম্যবাদী চেতনার কবিতার এলাকায়ও নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে। কবিসমাজ ও পাঠককুলে একটা বাড়তি সমীহ ও প্রিয়তা তিনি অর্জন করেছেন। তার আগে চাই সমাজতন্ত্র, চাষাভুষার কাব্য, ইসক্রা কাব্যগ্রন্থসহ এই ঘরানার অসংখ্য কবিতা আছে গুণের। এগুলো গুণের জনপ্রিয়তার পরিসর বাড়াতে বড় ভূমিকা পালন করেছে বলে মনে হয়। তিনি মার্ক্সবাদী কবি কি না, সে বিচার অবশ্য ভিন্ন।
খন্দকার আশরাফ হোসেন তাঁর এক লেখায় ‘গুণের বেগুণ’ আবিষ্কারে মনোযোগী হয়েছিলেন। সেখানে বাংলাদেশের কবিতায় অতিমাত্রায় নারী ও যৌনতার অনুপ্রবেশ ঘটানোর দায়ে নির্মলেন্দু গুণকে তিনি অভিযুক্ত করেছিলেন। কিন্তু আমার মনে হয়, গুণের জনপ্রিয়তার মূলে ওই নারী ও যৌনতাবিষয়ক কবিতাগুলো বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। অমীমাংসিত রমণী কাব্যগ্রন্থ থেকে তাঁর এই যাত্রা শুরু। এরপর বিভিন্ন সময়ে নারী ও সংস্কারহীন যৌনতা প্রাধান্য পাওয়া কবিতাগুলো যথেষ্ট পাঠকপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সর্বশেষ মুঠোফোনের কাব্য, নিশিকাব্য, বাৎসায়ন কাব্যগ্রন্থগুলোর মাধ্যমে গুণ ভিন্নভাবে যেন হানা দিলেন। এর ভেতর দিয়ে ‘বাহ্যিক আদর্শ শাসিত’ পাঠকসমাজের গোপন বাজারটি তিনি দখল করে নিলেন। ফলে গুণের জনপ্রিয়তার পরিসর আরও বিস্তৃত হলো বলে মনে হয়।
নির্মলেন্দু গুণ সার্বক্ষণিক কবি। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ভাষায়, ‘পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত কবি’। যেকোনো সময় যেকোনো কিছু তাঁর কবিতার বিষয় হয়ে উঠতে পারে। প্রেমিকার নীল রঙের ব্রা থেকে লেনিন পর্যন্ত সবই কখন অতর্কিতভাবে কবিতা হয়ে উঠবে গুণের গুণী হাতে, তা যেন কেউ বলতে পারে না। কবিতা ‘দিব্যমুহূর্তের’ ব্যাপার বা ‘একটি কবিতার জন্য অহর্নিশ অনন্ত প্রতীক্ষা’—এসব অসাধারণত্ব আরোপণমূলক কথাবার্তাকে প্রায় অর্থহীন করে দিয়েছেন তিনি। কবিতাকে করে তুলেছেন প্রতিদিনকার জীবনেরই সমান্তরাল একটি ব্যাপার। তিনি দেখালেন, কবিতা পড়ার জন্য বিশেষ কোনো প্রশিক্ষণের দরকার নেই। কবি হওয়াও কবিতা পড়ার শর্ত নয়। এসব ব্যাপারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তাঁর ৮০ বছর বয়সী তারুণ্য। তারুণ্য গুণের কবিতার বড় সম্পদ। কবিতায় ও যাপনে তিনি কখনো বুড়িয়ে যাননি। জীবন ও চারপাশ নিয়ে প্রথম জীবনেও তিনি হেঁয়ালি করেছেন, এখনো করেন। যাপন, বেশভূষা ও নেত্রকোনায় নিজ গ্রাম কাশবনে কাব্যকুঞ্জের কর্মকাণ্ড—এসবের ভেতর দিয়েও তিনি এখনো নানাভাবে মানুষের কৌতূহলকে জিইয়ে রাখতে পেরেছেন। কবিতা ও কবিতার বাইরের এসব ব্যাপার নির্মলেন্দু গুণকে জনসমাজে একটা প্রিয়তার জায়গায় বসিয়েছে বলে মনে হয়।
প্রশ্ন উঠতেই পারে, গুণ কি গণমানুষের মধ্যে জনপ্রিয়! এককথায় উত্তর—না। আমাদের ব্যবহৃত এই ‘জন’ বলতে অবশ্যই শুধু শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণিকেই বোঝাবে। বাংলা কাব্য-কবিতা থেকে বহু আগেই ‘গণমানুষ’ বা ‘জন-মানুষ’ উৎখাত হয়েছে। সে উনিশ শতকের ঘটনা। উপনিবেশকের রুচির প্রবল প্রতাপে কাব্য-কবিতা থেকে গণমানুষ শুধু উৎখাত হয়েছে, তা নয়, গণমানুষের ইতিহাসও বেহাত হয়ে গিয়েছে। তাঁরা ও তাঁদের সৃজনকর্ম যথাক্রমে ‘লোক’ ও ‘লোকসাহিত্য’ কোঠার মধ্যে চলে গেছে। ফলে গুণের কবিতার জনপ্রিয়তার কথা যখন বলছি, তখন অবশ্যই মনে রাখা দরকার যে আমরা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের মধ্যে প্রিয়তার কথাই বলছি।
এই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মন জয় করার সক্ষমতাও বাংলাদেশের খুব কম কবি–সাহিত্যিকের মধ্যেই দেখা যায়। বিদেশি সাহিত্যের অনুকরণে জাতে ওঠার আপ্রাণ চেষ্টায় অধিকাংশই প্রাণপাত করেন। ফলে দেশের বেশির ভাগ সাহিত্যিকের সাহিত্য স্বভাবতই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মানুষের কাছ থেকেও প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। নির্মলেন্দু গুণ এই শ্রেণিটার মধ্যে ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পেরেছেন। এটাকে গুণের একটা বড় কবি-কৃতিত্ব হিসেবে শংসা করাই যায়। সঙ্গে সঙ্গে এই শঙ্কাও জাগে যে গুণই কি বাংলাদেশের শেষ জনপ্রিয় কবি!