দেখা না দিলে যে কারণে বন্ধু কথা কয় না

কিছুদিন আগে হাশিম মাহমুদের কণ্ঠে প্রথম শোনা গেল গানটি। মুহূর্তেই তা ভাইরাল হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এরপর কোক স্টুডিও বাংলা নতুন সংগীতায়জনে আবারও নিয়ে এল ‘দেখা না দিলে বন্ধু কথা কইয়ো না’। আর এ গানের সঙ্গে আরও গান শুনতে শুনতে মনে এল প্রশ্ন, বাঙালির এত ‘দেখা’র তৃষ্ণা কেন?

কোক স্টুডিও বাংলার ‘দেখা না দিলে বন্ধু কথা কইয়ো না’ গানে আলেয়া বেগমের পরিবেশনা

আমাদের এত ‘দেখা’র তৃষ্ণা কেন? সম্প্রতি নতুন সংগীতায়জনে বাজারে চাউর হয়েছে যে গান, ‘দেখা না দিলে বন্ধু কথা কইয়ো না’, এই গানেও আছে দেখার প্রবল পিপাসা।

আদতে কেন দেখতে চাই আমরা? শুধু তো ‘দেখা’ই নয়, ওই ‘দেখা’র বিষয়টি নিয়ে আবার মাতোয়ারাও হই! কিন্তু দেখুন, এই একবিংশ শতাব্দীর প্রযুক্তি ও মেটানির্ভর দুনিয়ায় আমরা আবার এ-ও কবুল করে নিচ্ছি যে আগের মতো দেখা হওয়ার তেমন জরুরত আর নেই, এখন শুধু সংযুক্ত থাকলেই চলে।

এত কিছুর পরও দেখা হওয়ার জন্য আমাদের হাপিত্যেশ যায় না। কেন? কী কারণে আমরা বলি যে ‘দেখা না দিলে বন্ধু কথা কইয়ো না’?

‘দেখা না দিলে বন্ধু কথা কইয়ো না’ গানের গীতিকার ও প্রথম গায়ক হাশিম মাহমুদ

একে কেবল গানের একটি চরণ হিসেবে বিবেচনা করলে পুরোটা ধরা যাবে না। এটি হলো, বাংলা অঞ্চলের মানুষের এক সাধারণ অভিব্যক্তি। লোকসমাজের ভাষায় কিরাকসমও বলতে পারি, এমন একটি কিরাকসম—‘তুই যদি আমাকে দেখা না দিস, তাহলে আমার সঙ্গে তোর কথা বলারও দরকার নেই।’
এমন ধরনের কথা অবশ্য প্রায়ই বলি আমরা। বন্ধু বন্ধুকে বলে, মা ছেলেকে বলে, প্রেমিক তার প্রেয়সীকে বলে—মোট কথা সবাই-ই সবাইকে বলে থাকে। কিন্তু আজকের মেটা-দুনিয়ায়, যেখানে ‘দেখা’ নামের প্রত্যয়টিকে প্রায় টুটিয়ে দিতে চলেছি আমরা, সেখানে হামেশা এমন কথা কেন বলি?

শুধু এই গান কেন, বাংলার অজস্র ঐতিহ্যবাহী লোকগানের ছত্রে ছত্রে আছে ‘দেখা’র কথা, দর্শনের আলামত। দেখা ছাড়া বাঙালির ভাব, প্রেম—যা-ই বলি না কেন, তা যেন যথেষ্ট ডাঙর হয় না। একালের হাশিম মাহমুদের গানটি যেমন, তেমনি সেকালের লালন সাঁইয়ের ‘আমি একদিনও না দেখিলাম তারে’ অথবা রবীন্দ্রনাথের ‘এত দিন যে বসেছিলেম পথ চেয়ে আর কাল গুনে/ দেখা পেলেম ফাল্গুনে’—সবখানেই ‘দেখা’ পাওয়ার জন্য আমাদের কী ব্যাকুল তিয়াস! কাকে দেখার জন্য আবেগ এমন উথলে ওঠে? হতে পারে সে ‘মনের মানুষ’, হয়তো ‘সহজ মানুষ’। সে কি ‘মানুষ-গুরু’ও নয়? শাহ আবদুল করিমের ভাষায়, ‘দেখা দেও না, কাছে নেও না, আর কত থাকি দূরে,/ কেমনে চিনিব তোমারে? ’—এমন অভিমানী আর প্রশ্নাতুর গলায় যাকে ডাকি, সে তো প্রেমিক কি প্রিয়জনও হতে পারে।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা ‘লালন সাঁই’, ১৮৮৯

বাঙালির ‘দেখা’র সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের যোগাযোগ গভীর। আর ‘দেখা’র আকর্ষণও বড় তীব্র। তাই ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’র ‘মহুয়া’ পালায় নায়িকা মহুয়াকে দেখার জন্য নায়ক নদের চাঁদ পথেই মেলা করে, ঘুরেফিরে আসে পুকুরঘাটেই। আর বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’-এ কৃষ্ণকে একনজর দেখার আকাঙ্ক্ষায় রাধা রীতিমতো হাড়ই কালা করে ফেলে। হাড় কালা হওয়ার পরেই বুঝিবা ‘দেখা’র মর্ম সার্থক হয়। সাধারণত আমাদের এই মুলুকে দেখার ব্যাপারটি এতটাই আবেগমথিত যে সেটি প্রায় ক্ষেত্রেই আমাদের দৈনন্দিন যুক্তিবোধের বাইরে দিয়ে হাঁটে। কিন্তু চমকপ্রদ ব্যাপার হলো, যুক্তি ও কাণ্ডজ্ঞানকে অবলম্বন করে চলা এই ‘আধুনিক’ সময়েও ‘দেখা’ রূপী ‘দর্শন’কে আমরা সঙ্গে নিয়ে চলি।

পাশ্চাত্যের সাহিত্য তথা গান-কবিতায় ‘দেখা’ প্রত্যয়টির যে অভিব্যক্তি, তা এ অঞ্চল থেকে ভিন্ন। কথাটি আরেকটু ঠিকঠাক বলা হবে এমতো বললে যে পশ্চিমের দর্শন সব সময় যুক্তির পথরেখা বেয়ে চলে, যুক্তিশীল নৈয়ায়িকতার বাইরে সে খুব একটা যায় না। বিপরীতে বাংলার দর্শন বরাবরই ভাবের অনুগামী। দর্শনগত এই বাস্তবতার দরুন ‘দেখা হওয়া’ অথবা ‘দেখা দেওয়া’—দুই ক্ষেত্রেই বাঙালি খুব বেশি যুক্তির ধার ধারে না। এ ক্ষেত্রে বরং তার মধ্যে কাজ করে একধরনের জোর, গায়ের জোর নাকি? আরও মসৃণভাবে বললে বলা যেতে পারে ‘অধিকার বোধ’। উদাহরণ হিসেবে এখানে ‘দেখা না দিলে বন্ধু কথা কইয়ো না’—কথাটিই আবার লেখা যাক। এই বাক্যের ভেতরে যে জোর ও অধিকার বোধ যুগপৎভাবে প্রবাহিত, ইউরোপীয় উপনিবেশিক শিক্ষায় শিক্ষিতদের কাছে তা ‘অস্বাভাবিক’, এমনকি ‘অযৌক্তিক’ও মনে হতে পারে।

কোক স্টুডিও বাংলার ‘দেখা না দিলে বন্ধু কথা কইয়ো না’ গানে তিন শিল্পীর পরিবেশনা

এখন শুরুর প্রশ্নটিতে পুনরায় চোখ ফেরাই, আমাদের এত ‘দেখা’র তৃষ্ণা কেন?

উত্তরটি পেতে হলে হাঁটতে হবে বাংলার লৌকিক দর্শনের গলিপথে।

পাশ্চাত্যের মতো বাংলা অঞ্চলের মানুষ দর্শনকে স্বতন্ত্র একটি শাস্ত্র হিসেবে পাঠ করেনি। দর্শন আমাদের কাছে এসেছে মূলত ধর্মচর্চার ভেতর দিয়ে। আমাদের ধর্মচর্চার মধ্যে ভাবের যে প্রসারণ, সেগুলোকে আত্মিকৃত করে পরিপুষ্ট হয়েছে এখানকার দর্শন। সহজ কথায়, বাঙালির দর্শন প্রকারান্তরে তার ভাবচর্চারই অংশ। বিভিন্ন সময়ে নানা ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষের গমনাগমনের ফলে ধীরে ধীরে এই জনপদে রচিত হয়েছে সমন্বয়ধর্মিতার আবহ। আর এই সমন্বয়ের উদ্ভাস সৌরভ ছড়িয়েছে বাংলার দর্শনের পরতে পরতে। সেটি যেমন স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টির, দেহের সঙ্গে আত্মার, তেমনি আলোচ্য ‘দেখা’র সঙ্গে অনুভবের।

কৃষিনির্ভর বৃহৎ বঙ্গে কালে কালে বিচিত্র জাতি-ধর্মের ভাব, আচার ও সংস্কৃতি একে অপরের মোহনায় মিলেছে—ভারতবর্ষ তথা বাংলা অঞ্চলের এই ঐতিহাসিক বাস্তবতা আমলে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে’—সেভাবেই মিলেমিশে গঠিত বাংলার ভাবতরঙ্গে দেহসম্ভূত দেহাত্মবাদ সাধনার বিষয় তো বটেই, দর্শন হিসেবেও বিশিষ্টতা পেয়েছে। ‘যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে, তা আছে দেহ ভাণ্ডে’, এটি যেমন সুফিতন্ত্রের আলাপ, একইভাবে শরীরকে সাধনার কেন্দ্ররূপে গণ্য করে কথাটি বলেছেন বাউলেরাও। এর আগের বৌদ্ধ সহজিয়া ও নাথপন্থীদের কাছেও দেহ খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেই সূত্রে বলা যায়, অখণ্ড বাংলা ভূখণ্ডে বৌদ্ধ, হিন্দু ও মুসলমান—মোটাদাগে এই ধর্মসম্প্রদায়ের ভেতর দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মার্গ সাধনার যেসব ধারা বিকশিত হয়েছে, তার মধ্যে বৌদ্ধধর্মাবলম্বী বৌদ্ধ সহজিয়া, ইসলামবাহিত সুফিবাদি ঘরানা, হিন্দুধর্মের অন্তর্গত গৌড়ীয় বৈষ্ণব আর নাথ ও বাউলপন্থীদের কাছে দেহ একটি বড় আকর, সাধনার কেন্দ্রস্থল। আর এ দেহের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি হয়ে আছে ‘দেখা’। মূলত ইন্দ্রিয়ের মধ্য দিয়ে প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়। চোখ নামের দেখন-ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে যেভাবে দেখা যায়, একইভাবে দিব্যদৃষ্টি বা দিব্যজ্ঞানেও দেখা মেলে অনেক কিছুর। ফলে বৌদ্ধ সহজিয়া থেকে শুরু করে নাথপন্থা, সুফিবাদ, শ্রীচৈতন্যের গৌড়ীয় বৈষ্ণব বা বাউল মত—বাংলার সব ধর্ম-দর্শনের ভেতরেই ‘দেখা’র একটা স্বতঃ মূল্য রয়েছে। ‘দেখা’র মাধ্যমে সবাই তার ‘পরম’ তথা পরম সঙ্গী বা পরম আরাধ্যকে পেতে চাই। তাই এর পশ্চাতে যতটা না যুক্তি ক্রিয়াশীল, তার চেয়ে বেশি কাজ করে ভক্তি ও সমর্পণ। গানের ভেতরে দ্বিজ দাস যেমন বলেন, ‘দরশন পাই না যাহার/করি না প্রণাম।’ এ কারণেই পশ্চিমের ‘ফিলোসফি’ শব্দটির মধ্যে যদি থাকে যুক্তিসিদ্ধ জ্ঞানের তালাশ, আমাদের দর্শনে তবে আছে ভক্তির নিবাস। আর বাংলার তল্লাটে ‘দর্শন’ কথাটির অর্থই তো দেখা! ইন্দ্রিয়কে আশ্রয় ও তৃপ্ত মাধ্যমেই যার কার্যসিদ্ধি ঘটে।

একালের হাশিম মাহমুদের গানটি যেমন, তেমনি সেকালের লালন সাঁইয়ের ‘আমি একদিনও না দেখিলাম তারে’ অথবা রবীন্দ্রনাথের ‘এত দিন যে বসেছিলেম পথ চেয়ে আর কাল গুনে/ দেখা পেলেম ফাল্গুনে’—সবখানেই ‘দেখা’ পাওয়ার জন্য আমাদের কী ব্যাকুল তিয়াস! কাকে দেখার জন্য আবেগ এমন উথলে ওঠে?

বাংলা অভিধানে ‘দর্শন’ শব্দটিকে ‘দেখা’ রূপে চিহ্নিত করে এর অর্থ সম্বন্ধে আরও যা বলা হয়েছে, তা হলো, অবলোকন, সাক্ষাৎকার, ভক্তিভরে দেখা, জ্ঞান, শাস্ত্র ইত্যাদি। তবে এত সব অর্থদ্যেতনা ছাপিয়ে দর্শন মানে যে দেখা, বঙ্গীয় অঞ্চলের মানুষেরা এ সত্যকে সব সময় স্বীকার করেছে। ‘বাংলার দর্শন: প্রাক্-উপনিবেশ পর্ব’ বইয়ের শুরুতে কথাটি আরও বিশদে বলেছেন রায়হান রাইন। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বাংলার দর্শনকে এ দেশে সূত্রাবদ্ধ করার ক্ষেত্রে তিনি অগ্রগণ্য। তাঁর ভাষ্যে, ‘দর্শন কথাটির মধ্যে সাক্ষাৎজ্ঞানের ব্যঞ্জনা আছে। ইন্দ্রিয় ব্যবহার করে প্রত্যক্ষভাবে দেখাই দর্শন। এ ক্ষেত্রে জ্ঞানের পরিণতি হবে প্রত্যক্ষ কোনো অনুভব। আমরা ইন্দ্রিয় মারফত প্রত্যক্ষ জ্ঞান পাই, আর বুদ্ধি-বিবেচনা দিয়ে যা পাওয়া যায়, সেটা পরোক্ষ, তাতে সাক্ষাৎজ্ঞানের অনুভব নেই।’

বাংলার দর্শনে ইন্দ্রিয়জাত ‘সাক্ষাৎজ্ঞানের অনুভব’ নামের বিশেষ শব্দবন্ধটি বেশ গুরুত্বের দাবি রাখে। কেননা, বাঙালির দর্শনশাস্ত্রে প্রথমত ‘দেখা’র তরফে যে ‘সাক্ষাৎজ্ঞান’ ঘটে, এর পরের ধাপেই আসে ‘অনুভব’। তাই দেখার মাধ্যমে তৈরি হওয়া অনুভবের সূত্র ধরেই আমরা পৌঁছে যাই যার যার প্রার্থিতজনের কাছে। এরপরই মনের হরষে দিওয়ানা কোনো আশিক হৃদয় গাইতে পারে, ‘দেখা না দিলে বন্ধু কথা কইয়ো না’র মতো আরেকটি গান, ‘বন্ধু মোর দেহ কাটি, বানামু এক নাও/ সেই নাওয়ের বাদাম তুলি, আঁচলখানা দাও।’

কোক স্টুডিও বাংলার ‘দেখা না দিলে বন্ধু কথা কইয়ো না’ গানে এরফান মৃধা শিবলুর পরিবেশনা

সাক্ষাৎজ্ঞানের অনুভব যদি না-ই ঘটে, ‘নাওয়ের বাদাম’ তুলবে কোন ছার! তাই এই গানের মধ্যে যেভাবে ‘আঁচলখানা’ চাওয়া হলো, এর তলে অনুভবের তরঙ্গ আছে বৈকি, অধিকার বোধও কি নেই!

বলা যেতে পারে, এখানে দর্শনগত যে অধিকারবোধ, তা তৈরি হয়েছে দেখন-ইন্দ্রিয়ের আকাঙ্ক্ষা থেকে। অন্যপক্ষে জনপ্রিয় এই লোকগানে দেহ কেটে নৌকা বানানোর ঘোষণাটি, তা-ও কিন্তু বাংলার দর্শনের উল্লিখিত অনুভব তথা সেই সাক্ষাৎজ্ঞানের অনুভবকেই মনে করায়, যার ভরকেন্দ্র আদতে ‘দেখা’।

বাঙালির এই ‘দেখা’র প্রক্রিয়াটি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত এবং তার দর্শনের মতোই সমন্বিত। মানুষের ভেতরে যে মানুষের বাস, নিরন্তর তার সন্ধানে ছুটে চলি আমরা। লোককবি রশিদ উদ্দিনের ভাষায়, ‘পঞ্চ ভূতের ঘটে’ অর্থাৎ পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মধ্য দিয়ে মূলত আমরা মানুষকেই ভজনা করি। বলি, ‘মানুষ ধর মানুষ ভজ/ শোন বলি রে পাগল মন/ মানুষের ভিতরে মানুষ করিতেছে বিরাজন।’ তখন ভেতর থেকে কি ‘আমার বাস্তব বাহির হইয়া’ যায়? ভাবের হাটে রং খেলতে খেলতে দেহতত্ত্বের দুয়ার খুলে ‘দেখা’কে আমরা নতুনভাবে আবিষ্কার করি? না হলে মরমি কবি হাসন রাজা কেন বলবেন—‘রূপ দেখিলাম রে নয়নে, আপনার রূপ দেখিলাম রে...’। এ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, বাঙালির প্রতিটি ‘দেখা’ই নতুন! প্রতিটি দেখাতেই যেন সঞ্চারিত হচ্ছে নতুন আবেগ-অনুভূতি। ইন্দ্রিয়যোগ না ঘটলে কী আর এমন হয়! এসব পরিপ্রেক্ষিত মাথায় রেখে বাংলার দর্শনের তত্ত্ববস্তু আবারও বুঝে নেওয়া যাক, ‘বাংলার প্রাচীন তত্ত্বজ্ঞানীরা যখন দেহের অনুষঙ্গে বিশ্বজগৎ বুঝতে চেয়েছেন, কিংবা অন্বেষণ করেছেন মানুষের মুক্তি ও এর শর্তগুলোকে, কিংবা বাউল ফকিরেরা যখন দেহের ভেতরে “মানুষ রতন”কে উপলব্ধি করতে চেয়েছেন, এসব দেখা-বোঝার প্রক্রিয়া স্রেফ বুদ্ধিনির্ভর থাকেনি। তাঁরা জ্ঞানকে আত্মসত্তার অংশ করতে চেয়েছেন।’—এইটুকু বলে ‘বাংলার দর্শন’-এর ‘ভূমিকা’য় রায়হান রাইন আরও স্পষ্ট করে মেলে ধরেন ‘দেখা’র স্বরূপ, ‘বাংলা অঞ্চলের দর্শন-ধারাগুলোতে “দেখার বস্তু” সব সময় দেহ বা জগৎসত্তার অতিরিক্ত কোনো শাশ্বত সত্তা নয়। যেমন বাউল সাধকেরা যে “নিরাকার”-এর কথা বলেন, তার যুক্ততা “আকার”-এর সঙ্গে। সাকার রূপ ছাড়া নিরাকারের অস্তিত্ব নেই। রূপের কারণেই সম্ভব হয় নিরাকারের সাক্ষাৎজ্ঞান।’

বাংলার দর্শনে ইন্দ্রিয়জাত ‘সাক্ষাৎজ্ঞানের অনুভব’ নামের এই বিশেষ শব্দবন্ধটি বেশ গুরুত্বের দাবি রাখে। কেননা, বাঙালির দর্শনশাস্ত্রে প্রথমত ‘দেখা’র তরফে যে ‘সাক্ষাৎজ্ঞান’ঘটে, এর পরের ধাপেই আসে ‘অনুভব’। তাই দেখার মাধ্যমে তৈরি হওয়া অনুভবের সূত্র ধরেই আমরা পৌঁছে যাই যার যার প্রার্থিতজনের কাছে।

‘সাক্ষাৎজ্ঞান’ বা ‘দেখা’ বাংলার দর্শনের মর্মে লেপ্টে আছে। যাকে চাই, তাকে দর্শন করে প্রথমত সেই সত্তাকে আমরা ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করি; কল্পনায়, নিজের মনের কোণে তার প্রতিমা নির্মাণ করি। এসবের মধ্য দিয়ে লীন হই তার ভেতরে। বস্তুত এভাবেই সেই প্রিয়র সঙ্গে আমাদের ‘দেখা’ সার্থক হয়ে ওঠে!

শাহ আবদুল করিম (১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯১৬—১২ সেপ্টেম্বর ২০০৯)

অনেক যুগের পরম্পরায় প্রক্রিয়াটি চেতনে-অবচেতনে, আমাদের মন ও মগজে এমনভাবে মিশে গেছে যে সাকার বা নিরাকার ‘মানুষ রতন’রূপী প্রাণের সেই ‘সোনার নাগর’কে দেখার বাসনায় ক্ষণে ক্ষণেই মন আনচান করে। জেগে ওঠে প্রেমাকাঙ্ক্ষা। আর প্রেম এলে আসে ভাব, হাজির হয় বিরহ, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে আত্মরতিও। তখন প্রযুক্তি ও পুঁজির দুনিয়ায় শত শত রিল বানিয়ে যতই আমরা ‘চিল’ করি, ‘ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি’র ঘেরাটোপে বস্তুগতভাবে যতই তাঁবু গাড়ি না কেন, ‘দেখা’র অনন্ত তৃষা কখনোই আমাদের ছেড়ে যায় না। কারণ, বাঙালির এই দেখন-আকাঙ্ক্ষার মূলে রয়েছে আবহমানকাল ধরে চর্চিত এক ভাবদর্শন। তাই ‘এ জীবন যাবার কালে রে/ ও পাখিরে/ একবার যেন দেখি রে...’—এ রকম মরমি সুরের হাহাকার মাঝেমধ্যেই আমাদের ‘অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করে’, হয়তো আমাদের ক্লান্তও করে। অতঃপর সবশেষে আমরা এমন শর্ত আরোপ করি যে ‘দেখা না দিলে বন্ধু কথা কইয়ো না’।