সম্প্রতি কোক স্টুডিও বাংলা মুক্তি দিয়েছে ‘নদীর কূল নাই কিনার নাই রে’ গানটি। আব্বাস উদ্দীন আহমদের গাওয়া বিখ্যাত এ গান এবার নতুন করে গেয়েছেন বগা তালেব। গানটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ সাড়া পড়েছে। প্রায় এক শ বছরের পুরোনো এই গান নতুন প্রজন্মকে কেন আবার আপ্লুত করল?
ছলাৎছল জলের শব্দ শুনি, অনুভব জাগে নদীর। সেই নদীর সুর-শব্দ বিষাদ জাগায়। এরপর ‘নদীর কূল নাই কিনার নাই রে’ গানটিতে আমরা কেবলই ভেসে ভেসে যাই। ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এখন জোরেসোরেই বইছে নদীর কলতান। সম্প্রতি কবি জসীমউদ্দীনের লেখা এই বিখ্যাত লোকগান নতুন আঙ্গিকে মুক্তি দিয়েছে কোক স্টুডিও বাংলা।
অর্ণবের সংগীতায়োজনে এবার গানটি আমরা শুনছি তরুণ শিল্পী রিপন কুমার সরকারের কণ্ঠে। সবার কাছে এই শিল্পী বগা তালেব নামেই পরিচিত।
গানটি যতবার শুনি, ততবার মনের ভেতর হাহাকার জাগে। ভাবি, কিংবদন্তি শিল্পী আব্বাস উদ্দীন আহমদের কণ্ঠে এ গান তো আগেও শুনেছি, ভালোও লেগেছে; কিন্তু আজ এতকাল বাদে আমাদের নাগরিক মানসে এ গান হঠাৎ কেন এতটা তোলপাড় তুলল? আর শুধু আমাদেরই নয়, এই শতাব্দীর শুরু থেকে প্রথম দশকের মধ্যে যাঁদের জন্ম, যাঁদের পরিচিতি ‘জেন জেড’ নামে, এই প্রজন্ম গানটি নিয়ে এত উদ্বেল কেন?
প্রশ্নের জবাব পেতে প্রায় শতাব্দীপ্রাচীন ভাটিয়ালি শ্রেণির এই গানের অন্তর খুঁড়ে এর সংগীতায়োজন ও গায়কির দিকে যেমন ফিরে তাকানো দরকার, তেমনি বিশ ও একুশ শতকের সমাজের মধ্যেও খানিকটা চোখ ফেরানো যেতে পারে।
১৯৩৫ সালে প্রকাশিত ‘রঙ্গীলা নায়ের মাঝি’ বইয়ে ‘নদীর কূল নাই কিনার নাই রে’ গানটি সূচিবদ্ধ করেন জসীমউদ্দীন। এরপরই ‘গ্রামোফোন কোম্পানি’ আব্বাস উদ্দীন আহমদের কণ্ঠে বের করে গানটির রের্কড। নিরাভরণ আর অসম্ভব দরদি গায়কি দিয়ে গানের অন্তর্গত হাহাকার তিনিই প্রথম মূর্ত করে তুলেছিলেন।
আব্বাস উদ্দীনের কণ্ঠে তো বটেই, প্রায় এক শতাব্দী পর একই সুরে বগা তালেবের কণ্ঠেও গানটি সমান ভালো লাগল। সাহস করে আরেকটু এগিয়ে বলা যায়, অর্ণবের দুর্দান্ত কম্পোজিশন আর বগা তালেবের একূল-ওকূল দুকূলপ্লাবী কণ্ঠ বিশ শতকের এই গানকে একবিংশ শতাব্দীর নতুন পরিসরে দারুণভাবে প্রসারিত করেছে।
এসব তথ্য মাথায় রেখে এবার ‘নদীর কূল নাই কিনার নাই রে’ গানের অন্দরে একটু ঢুঁ মেরে আসা যাক।
গানটি খুব দীর্ঘ নয়, ছোটই। আর এতে রয়েছে এমন এক হাহাকার, যা আদিগন্ত বিস্তৃত এক অসীম জলরাশির কথা আমাদের মনে করিয়ে দেয়। এর কথা ও সুরের ব্যঞ্জনায় মুহূর্তেই মনের মধ্যে ঢেউ তোলে বেদনাতুর এক দুঃখের নদী, যার কূল নেই, কিনার নেই।
নদীটি শেষাবধি যেন মানুষের জীবনের সঙ্গে মিশে বেদনার এক অনুরণন তৈরি করে। তাই ‘নদীর কূল নাই কিনার নাই রে’ শুনতে শুনতে আমাদের মনে হয়, জীবন নামের যে নদীর মধ্যে আমরা আবদ্ধ, তারও তো কূল–কিনারা নেই কোনো। অথবা কোনো এক মাঝির কথা কি আমাদের মনে পড়ে, যে কেবলই নৌকা বেয়ে যাচ্ছে অন্তহীন নদীতে—নদী না জীবননদী?
গানটি আমরা কানে শুনি। আর আমাদের চোখে ভেসে ওঠে দীন–হীন এক মাঝির কল্পনা। তখন একলহমায় ভাবের রাজ্যে ভেসে যাই আমরা।
কিন্তু এসব তো বাঙালির বিংশ শতাব্দীর আবেগ। একুশ শতকের গতিশীল সময়েও কি একই আবেদন পাওয়া গেল গানটিতে?
অর্ণব ও বগা আরও অনেকের সঙ্গে বিটিএস ও পপসংগীত শোনা ‘জেন জেড’ প্রজন্মকেও বাংলার মাটিবর্তী এই গান শোনাতে চেয়েছেন বলে মনে হয়। তাই সংগীত আয়োজন তথা গানের পরিবেশনায় কালের স্পর্শ যোগ করেছেন তাঁরা।
বহু বছর ধরে ‘নদীর কূল নাই কিনার নাই রে’ আমাদের কাছে এমন আবেগ আর আবেদনেই হাজিরা দিয়ে আসছে। যেন গাঢ় বা মিহি বেদনার একপ্রকার হাহাকার গানটি মধ্যে আমরা পাই অনেকটা যেন বিনা আয়োজনেই। এর পেছনে গানের কথার যতটা অবদান, কথার সঙ্গে মিলিয়ে সুরের ভূমিকাও কম নয়।
বিশ শতকে আব্বাস উদ্দীন আহমদ গানটি যখন গলায় তুলেছিলেন, তখন গ্রামোফোনের আমল। বাংলায় নগরসভ্যতা কেবল পাকাপোক্ত হতে শুরু করেছে।
নদীর সঙ্গে মানুষের সংযোগ তখনো প্রগাঢ় ও অটুট। যদিও জীবিকার তাগিদে গ্রাম ছেড়ে, নদীকে দূরে রেখে মানুষ সে সময় ঠাঁই গাড়তে শুরু করেছে কলকাতা বা ঢাকায়। আব্বাস উদ্দীনের গলায় ওই সময়ই প্রথম গানটি শুনতে পান তাঁরা। ফলে সদ্য গ্রাম ছেড়ে শহুরে নাগরিক হয়ে ওঠার চেষ্টারত মানুষের কাছে এ গান জনপ্রিয় হতে সময় লাগেনি। গানটি মূলত মানুষের স্মৃতির মধ্যে, শেকড়ের তলদেশে হানা দিয়েছিল। গানে যেমন বলা আছে, ‘আমি এই দেখিলাম সোনার ছবি আবার দেখি নাই রে…’—এ কথার মতোই আমাদের অবচেতনে জমে থাকা স্মৃতিগুলো, ছবিগুলো স্পষ্ট হয়ে হারিয়ে যেতে যেতে রেখে যায় বিচ্ছেদের কষ্ট। মানুষের স্বভাবই এমন যে অন্য অনেক কিছু ভুলে গেলেও বিচ্ছেদের স্মৃতিকে সে সব সময় সঙ্গে নিয়ে চলে।
নগরে যে মানুষ চাকরি করে, লড়াই করে, আদতে সে তো কোথাও পৌঁছাতে চায়। কিন্তু আমরা চাইলেই কি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছুতে পারি, নাকি অভীষ্টকে পাওয়ার জন্য লড়তে লড়তে শেষ করে ফেলি নিজের তাবৎ প্রাণরস? অতঃপর মনের কোণে হাহাকার ও দিকচিহ্নহীনতা ছাড়া কী আর সম্বল থাকে মানুষের!
এই বাস্তবতায় পুরো গানের মধ্যে যে একটা বিষাদময় হাহাকার, একটা দিকচিহ্নহীনতা, আব্বাস উদ্দীনের দরাজ কণ্ঠ তা যথার্থই ধরতে পেরেছিল। এ–ও বলা দরকার, আব্বাস উদ্দীনের কণ্ঠে গ্রামোফোন মারফত এই গান শোনার পরই সেই বিশ শতকে আমাদের নাগরিক মন গানটির আত্মার মধ্যে যা পেয়েছিল, তা আর কিছু নয়, সাংগীতিকার মোড়কে ওই দুকূলভরা হাহাকারই।
এ গানে তখন যন্ত্রানুষঙ্গ কমই ব্যবহৃত হয়েছিল—হারমোনিয়াম ও তবলার সঙ্গে শুধু দোতারা। কোনো এক অসীম দরিয়ার মাঝি প্রমত্ত জলাধারে খুঁজে পাচ্ছে না পার। এ কারণে তার বুকে গুঞ্জরিত হচ্ছে বেদনা—এ অনুভবই আব্বাস উদ্দীনের দরদি গলায়, গুটিকতক যন্ত্রের সংগতে উঠে ধরা দিয়েছিল তখন।
অবশ্য প্রথমে যখন এ শিল্পী ‘নদীর কূল নাই’ বাক্যাংশটুকু গাইতে গিয়ে ‘নাই’ শব্দটিকে প্রলম্বিত করেন এবং ‘কিনার নাই’ উচ্চারণ করতে গিয়ে গলাটাকে ঢেউয়ের মতন খেলান, সুরের মধ্য দিয়ে কেমন যেন একটা অসীমতার বোধ জাগে শ্রোতার মনে, তৈরি হয় গভীর–গহন এক ক্যানভাস।
গানটি তিনি শুরু করেন একটু মন্থর লয়ে। এরপর ‘ওপারে মেঘের ঘটা, কনক বিজলি ছটা’ বা ‘বিষম নদীর পানি, ঢেউ করে কানাকানি’—অংশগুলো গাওয়ার সময় দ্রুত লয়ের দিকে ধাবিত হয় সুর। অর্থাৎ গোটা গানের সুরবিন্যাসে চলে মন্থর আর দ্রুত লয়ের খেলা। ফলে মন্থর ও দ্রুত লয়ের দোলদুলুনির মধ্য দিয়ে গানটি যখন আমরা শুনি, আমাদের অনুভবে তখন কি নদীর ঢেউয়ের উত্থান–পতনের ছন্দ জেগে ওঠে না?
নদীমাতৃক বাংলাদেশের আমাদের স্মৃতির নিকটে, নদীর খুব কাছাকাছি—বলা ভালো, নদীমধ্যেই যেন চালান করে দেয় ‘কূল নাই কিনার নাই’! এক শতাব্দী ধরে এভাবেই গানটির সঙ্গে আমাদের ওঠাবসা এবং মাঝখানে কিছুটা বিচ্ছেদও।
এত দিন পর সেই গান নিয়ে আজকের বগা তালেব তবে কী করলেন?
তিনিও তো আমাদের ওই নদীমধ্যে, হাহাকারের সেই বিষণ্ন জলের ভেতরেই অবগাহন করালেন। তাহলে প্রায় এক শ বছর পর পুরোনো গানটির মধ্যে নতুন কী সুধা ঢাললেন শান্তিনিকেতনের দুই প্রাক্তনী—সংগীতকার অর্ণব ও গায়ক বগা?
আগেই বলেছি, মূল সুর তাঁরা অনুসরণ করেছেন বটে, কিন্তু এবার এই বাংলা গানের মধ্যে প্রাচ্য সংগীতযন্ত্র বাঁশি, সারেঙ্গীর সঙ্গে অবলীলায় অর্ণব ঢুকিয়ে দিয়েছেন পাশ্চাত্যের পিয়ানো, ক্ল্যারিনেট ইত্যাদি। আর পাশাপাশি বাস্তবিকভাবে যোগ করেছেন পানির শব্দ। ব্যস, এতেই গানে সুর-তাল মোটামুটি ঠিক থেকেও পরিবেশ বা পরিসর গেছে পাল্টে।
বগার জোরালো কণ্ঠ, সুরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গলার ভাঙা-গড়া—এ যেন নদীর ভাঙা-গড়ার মতোই। ‘নদীর কূল নাই’ গাইতে গিয়ে ‘নাই’-এর ওপর গলাটি তিনি ভাসিয়ে দেন। উদারা-মুদারা ছাড়িয়ে ‘নাই-ই...’ বলে যখন টান দেন তারা থেকে, সে সময় আব্বাস উদ্দীনের গলার টানও আমাদের মনে পড়ে। তবে বগা এই ‘নাই’ শব্দটি এবং ‘নদীর কিনার নাই’-এর ‘কিনার’কে টেনে নিয়ে যান অনেকক্ষণ ধরে, বিশ শতকের চেয়ে আরও জোরালোভাবে। তাঁর গলার তেজ আমাদের মোহিত করে, আমরা স্থির হয়ে যাই।
না, কথাটি বোধ হয় ঠিক হলো না, বলা দরকার, এই ফিউশনের মাধ্যমে ‘কূল নাই কিনার নাই’–এর পরিসর আরও বেশি জীবন্ত হয়েছে। গানটিতে আগে থেকেই হাহাকারের মূর্ছনা ছিল, নতুন এই সংগীত আয়োজনে এবার তা যেন বিলাপের সুর আর কান্নার ঘোর নিয়ে ধ্বনিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে গায়ক বগা তালেবের যে দুকূলপ্লাবী কণ্ঠের কথা শুরুতেই বলা হয়েছে, বলার অপেক্ষা রাখে না, ওই কণ্ঠই আসল তুরুপের তাস।
বিশ শতকে আব্বাস উদ্দীন যখন গানটি গেয়েছিলেন, সে সময় পৃথিবী আজকের মতো গতিশীল ও দৃশ্যনির্ভর ছিল না, মানুষের এত ব্যস্ততাও ছিল না। কৃষিসভ্যতার অংশ হয়ে প্রকৃতি আর নদ–নদীঘেরা ‘পাখির নীড়ের মতো’ নাগরিক বাংলায় তখন প্রায় সবারই ছিল দুদণ্ড শান্তির অবসর।
কিন্তু এখন কি তা আছে? বর্তমানে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রেক্ষাপটে শুরু হয়েছে এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রতাপ। কেবল যুগ নয়, শতাব্দীই তো বদলে গেছে। যন্ত্রের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রুদ্ধশ্বাসে ছুটছে মানুষ। মেটা–পৃথিবীতে শুধু শারীরিক নয়, ভার্চ্যুয়ালিও মানুষ এখন অস্তিত্বশীল। আগের চেয়ে অনেক অনেক বেশি গতিশীল হয়েছে দুনিয়া। এই বাস্তবতায় নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন সবার হাতের মুঠোয়, এ সময় ‘নদীর কূল নাই’ বলে হাহাকার উদ্যাপনের সময় কোথায়!
তাই এই গান যদি উদ্যাপন করাতে হয়, তা করাতে হবে যুগোপযোগী করে এবং মানুষের ওই গতিদৌড়ের মধ্যেই। নতুনভাবে গাওয়া গানটির পরিবেশনায় সেই যুগোপযোগিতা ও গতিদৌড়ের নমুনা লেপ্টে আছে।
অর্ণব ও বগা আরও অনেকের সঙ্গে বিটিএস ও পপসংগীত শোনা ‘জেন জেড’ প্রজন্মকেও বাংলার মাটিবর্তী এই গান শোনাতে চেয়েছেন বলে মনে হয়। তাই সংগীতায়োজন তথা গানের পরিবেশনায় কালের স্পর্শ যোগ করেছেন তাঁরা।
‘নদীর কূল নাই কিনার নাই রে’—এই টানের মধ্যকার যে বিষাদ, সেই বেদনার সুর অনুভব করে, নিত্যকার দৌড়ের ময়দানে থেকেও মানুষ গানটি শুনুক, অতঃপর চোখ মেলে একবার তাকিয়ে দেখুক নিজের দিকে, বিষয়টি বোধ হয় সংগীতকারের মাথায় ছিল। আর এই বিবেচনাও বোধ হয় কাজ করেছে যে একদা আব্বাস উদ্দীন যেভাবে প্রায় নিরাভরণ গলায় গানটি গেয়েছিলেন, ওই একইভাবে পরিবেশন করলে এখনকার গতিশীল নেটিজেনরা হয়তো আকৃষ্ট হবে না। সংগত কারণে গানের একদম শুরু থেকেই ব্যবহার করা হয়েছে ক্ল্যারিনেট; এবং ক্ল্যারিনেটের সুরে এখানে যে গভীর-গহিন বিষাদ উৎপন্ন হয়েছে, তাতেই বুঝিবা খানিকক্ষণের জন্য হলেও থেমে গেছে আমাদের গতিশীল দৌড়।
আর যে মুহূর্তে আমাদের কানে ক্ল্যারিনেটের সুরটি ঢুকেছে, প্রথমেই যে আমরা বিষাদাচ্ছন্ন হয়েছি, এতটা বলা যাবে না, বরং ভেবেছি, ‘দেখি না কী হয়’! তারপর ‘সুরটা জোস তো’—এসব ভাবতে ভাবতে একসময় আচ্ছন্ন হয়েছি গানের ওই বিষাদ-বেদনার নীলে।
আব্বাস উদ্দীন বেদনাহত এ গান গেয়েছিলেন সম্পূর্ণ এককভাবে। তবে এবার ‘বিষম নদীর পানি’কে আরেকটু প্লাবিত করতেই এখানে দেখা গেল কোরাস। আবার কোনো কোনো অংশে লয়টা আগের চেয়ে একটু বাড়িয়ে দেওয়া হলো। আদতে সবটাই করা হয়েছে যুগের দাবি মেনে।
কিন্তু এতে সরাসরি পানির শব্দ ব্যবহার করা হলো কেন?
কারণটি বোধ করি এই যে একসময় নদীর সঙ্গে আমাদের যে সরাসরি সম্পর্ক ও যোগাযোগ ছিল, তা এখন একরকম চুকেবুকে গেছে। ফলে গানটিতে ব্যবহৃত পানির শব্দ আমাদের ইন্দ্রিয়ের মধ্যে নদীকে জীবন্ত করে তুলেছে যেনবা। আমরা যেন অকূল দরিয়ায় নিঃসঙ্গ মাঝির নাও বেয়ে চলাকে মর্মে মর্মে অনুভব করতে পেরেছি।
সর্বোপরি শিল্পী বগা তালেবের উদাত্ত কণ্ঠ আমাদের আচ্ছন্ন করেছে, আক্রান্তও কি করেনি?
বগার জোরালো কণ্ঠ, সুরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গলার ভাঙা-গড়া—এ যেন নদীর ভাঙা-গড়ার মতোই। ‘নদীর কূল নাই’ গাইতে গিয়ে ‘নাই’-এর ওপর গলাটি তিনি ভাসিয়ে দেন। উদারা-মুদারা ছাড়িয়ে ‘নাই-ই...’ বলে যখন টান দেন তারা থেকে, সে সময় আব্বাস উদ্দীনের গলার টানও আমাদের মনে পড়ে। তবে বগা এই ‘নাই’ শব্দটি এবং ‘নদীর কিনার নাই’-এর ‘কিনার’কে টেনে নিয়ে যান অনেকক্ষণ ধরে, বিশ শতকের চেয়ে আরও জোরালোভাবে। তাঁর গলার তেজ আমাদের মোহিত করে, আমরা স্থির হয়ে যাই। তখন গানের ভেতরকার নদীটি আগের চেয়ে আরও তীব্রভাবে অনুভব করতে করতে আমরা পানির শব্দ শুনি, বেদনার জলে অবগাহন করি।
গানের অন্তিমে তরুণ এ শিল্পীর গলায় ফুটে ওঠে অস্ফুট কান্না। ক্ল্যারিনেটের প্রগাঢ় বিষণ্ন সুর আগে থেকেই তো ঘন করে তুলেছিল পরিবেশ। তার মধ্যে বাঁশিতে অনুরণিত বেদনা, পানির আবহে বয়ে চলা বিষাদখোদিত গানটি সবশেষে কোথায়, কোন নদীতে যে নিয়ে যায়! দারুণ এক ফিউশনের মধ্য দিয়ে তেলে-জলে তা মিশেও যায়। এই সময়ে দাঁড়িয়ে, বিশ শতকের একটি গানে আমরা খুঁজে পাই একুশ শতকের সবকিছু।
বোধ করি এসবই আমাদের মাথার ও মনের অলিন্দে পলকেই একটা নদীর ছবি আঁকে। আর সেই নদীতে ভাসতে ভাসতে, বিষণ্ন ও স্মৃতিকাতর হওয়ার পরও আমরা ভাবি যে কোক স্টুডিও বাংলার গানটি তো শোনা হলো, এবার আব্বাস উদ্দীনের গলায়ও একবার শোনা যাক!
এরপর এই গানের নদীটির আসলেই কোনো কূল-কিনার থাকে না।