যেভাবে ‘মুখ ও মুখোশ’ সিনেমার নায়িকা হয়েছিলেন পিয়ারী বেগম

ঢাকায় মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’–এর নায়িকা পিয়ারী বেগম মারা গেছেন গতকাল। আবদুল জব্বার খান পরিচালিত এই চলচ্চিত্র ছাড়া আর কোনো সিনেমায় অভিনয় করেননি তিনি। সেই প্রতিকূল সময়ে কীভাবে ‘মুখ ও মুখোশ’–এর নায়িকা হয়েছিলেন তিনি?

শেষ বেলায় পিয়ারী বেগম
ছবি: সংগৃহীত

পিয়ারী বেগম ঢাকায় মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’ (১৯৫৬)–এর নায়িকা। পর্দায় তাঁর চরিত্রের নাম ছিল রাশিদা। সম্প্রতি তিনি পর্দার আড়ালে চলে গেলেন চিরতরে। আমাদের সোনালি যুগের আরও একটি প্রদীপ নিভে গেল।

১৯৫৩ সালে পূর্ববঙ্গ সরকারের পরিসংখ্যান ব্যুরোর পরিচালক ড. আবদুস সাদেকের আহ্বানে ঢাকায় আয়োজিত সভায় অবাঙালি চিত্রব্যবসায়ী ফজলে দোসানী বললেন, ‘এখানকার আবহাওয়া খারাপ, আর্দ্রতা বেশি। কাজেই এখানে ছবি তৈরি সম্ভব নয়।’ প্রতিবাদ করলেন আবদুল জব্বার খান, ‘কলকাতায় যদি ছবি হতে পারে, তাহলে ঢাকায় হবে না কেন? মি. দোসানী, আপনি জেনে রাখুন, যদি এক বছরের মধ্যে কেউ ছবি না করে, তবে আমি জব্বার খানই তা বানিয়ে প্রমাণ করব।’

আবদুল জব্বার খানের এই চ্যালেঞ্জকে প্রথম প্রথম কেউ স্বাগত জানাননি। কিউ এম জামান বললেন, ‘ভুল করলে হে, সিনেমা তুমি করতে পারবে না।’ আবদুল জব্বার খান হাল ছাড়েননি। নিজের ক্ষুদ্র সামর্থ্য নিয়েই কাজ চালিয়ে যান। অতঃপর বহু বাধা–বিপত্তি পেরিয়ে পথিকৃৎ এই মানুষ ১৯৫৬ সালে ‘মুখ ও মুখোশ’ নির্মাণ করেন।

শিল্পী সংগ্রহ করতে গিয়ে আবদুল জব্বার খান মহা মুশকিলে পড়েছিলেন। পাগলের মতো এখানে–ওখানে ছুটতে হয়েছে। কলিম শরাফী ও তাঁর স্ত্রী কামেলা শরাফী তখন বেশ নামী নাট্যশিল্পী। কর্মসূত্রে সে সময় তাঁরা থাকেন চট্টগ্রামে। তাঁদের নায়ক ও নায়িকা চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব দিতে জব্বার খান হাজির হন সেখানে। কলিম শরাফী সানন্দ সম্মতি দিলেও শেষ পর্যন্ত এ সিনেমায় তাঁদের আর কাজ করা হয়ে ওঠেনি। এরপর পূর্ণিমা সেনগুপ্তাকে কাস্ট করা হলো চট্টগ্রামের পাথরঘাটা থেকে। কিন্তু নায়িকা কোথায়?
আবদুল জব্বার খান পরিচালিত ‘মুখ ও মুখোশ’ সিনেমার পোস্টার

তত দিনে ভাষা আন্দোলন সংঘটিত হয়ে গেছে। জেগে উঠেছে বাঙালি জাতিসত্তা। সেই বাস্তবতায় ‘মুখ ও মুখোশ’ চলচ্চিত্রের নির্মাণ একটি যুগান্তকারী ঘটনা বটে। এটি কেবল একটি চলচ্চিত্রের মুক্তির বিষয় ছিল না, এটি ছিল একটি চ্যালেঞ্জ। স্বাধীন জাতিসত্তা নির্মাণ পর্বে তাৎপর্যপূর্ণ একটি ঘটনা।

শিল্পী সংগ্রহ করতে গিয়ে আবদুল জব্বার খান মহা মুশকিলে পড়েছিলেন। পাগলের মতো এখানে-ওখানে ছুটতে হয়েছে। কলিম শরাফী ও তাঁর স্ত্রী কামেলা শরাফী তখন বেশ নামী নাট্যশিল্পী। কর্মসূত্রে সে সময় তাঁরা থাকেন চট্টগ্রামে। তাঁদের নায়ক ও নায়িকা চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব দিতে জব্বার খান হাজির হন সেখানে। কলিম শরাফী সানন্দ সম্মতি দিলেও শেষ পর্যন্ত এ সিনেমায় তাঁদের আর কাজ করা হয়ে ওঠেনি। এরপর পূর্ণিমা সেনগুপ্তাকে কাস্ট করা হলো চট্টগ্রামের পাথরঘাটা থেকে। কিন্তু নায়িকা কোথায়?

পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হলো: ‘এ দেশের প্রথম ছবিতে অভিনয়ের জন্য পাত্র-পাত্রী নেওয়া হবে।’ বিজ্ঞাপন দেখে অভিভাবকদের না জানিয়ে গোপনে যোগাযোগ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্সের ছাত্রী জহরত আরা। তাঁরই সঙ্গে আসেন ইডেন কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী পিয়ারী বেগম (নাজমা)। দুজন ছিলেন বান্ধবী। পাশাপাশি বাসা।

দুই বন্ধুর মিলন—পিয়ারী বেগম ও মাহবুবা রহমান

দুজনই অডিশন দিলেন। খবর পাওয়া গেল দুদিন পর, দুজনই সিলেক্টেড! খুশিতে দুই বান্ধবী পরস্পরকে জড়িয়ে ধরলেন।

তখন পিয়ারী বেগমের ভাবনা ছিল এমন—এত দিন মধুবালা, সুরাইয়া, নার্গিসের অভিনয় দেখে মুগ্ধতায় তাঁর দিন কেটেছে। এখন তাঁকেও সিনেমার পর্দায় দেখা যাবে! তাও আবার দেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্রে নায়িকার ভূমিকায়? ব্যাপারটা তাঁর জন্য উত্তজনাকরই ছিল বটে।

‘চিত্রালীতে’ পিয়ারী বেগমের ছবি ছাপা হলো বড় করে। তাঁর বাবা প্রথমে আপত্তি করলেও পরে সম্মতি দিয়েছিলেন।

মনে রাখা দরকার, পঞ্চাশের দশকে সে সময়ের ঢাকায় কোনো সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের মেয়ের পক্ষে চলচ্চিত্রে অভিনয় করা দুঃসাধ্য ব্যাপার ছিল। খুব ছোট বয়স থেকে পিয়ারী বন্ধুদের নিয়ে পাড়ায় নাটক করতেন। নির্দেশনা দিতেন জহরত আরার ভাই মুসলেহ উদ্দিন, পরবর্তীকালের বিখ্যাত সুরকার-সংগীত পরিচালক।

বড় হয়ে বেতার নাটকে অংশ নেওয়ার সুযোগ হয়েছে পিয়ারীর। মঞ্চনাটক করেছেন। কিন্তু চলচ্চিত্রে অভিনয়ের কোনো পরিবেশ দেশে তখনো তৈরি হয়নি। সুযোগ এল আবদুল জব্বার খানের হাত ধরে। কিন্তু ‘মুখ ও মুখোশ’-এর পরে আর কোনো চলচ্চিত্রে অভিনয় করেননি পিয়ারী। এ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সূত্রেই আমিনুল হকের সঙ্গে পরিচয় ও পরিণয়।

দীর্ঘ সময় পর পিয়ারী বেগমের খোঁজ পড়ে ২০১৬ সালে। এর সঙ্গে বর্তমান লেখকের একটু যোগসূত্র আছে। সে বছর ছিল ‘মুখ ও মুখোশ’ তথা দেশীয় চলচ্চিত্রের ষাট বছর পূর্তি। নানা রকম অনুষ্ঠানের তোড়জোড় চলছে। মোস্তফা কামাল সৈয়দ তখন এনটিভির ‘হেড অব প্রোগ্রাম’। একদিন বিকেলে তাঁর কক্ষে বসে কথা হচ্ছিল নানা বিষয়ে।

আমি একটি আইডিয়া শেয়ার করলাম। দেশীয় চলচ্চিত্রের ৬০ বছর পূর্তির এই বিশেষ মুহূর্তে একটা অনুষ্ঠানে ঢাকায় মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম পূর্ণাঙ্গ সবাক চলচ্চিত্রের নায়িকা এবং গায়িকাকে মুখোমুখি করতে পারলে কেমন হয়? এ–ও জানালাম, নায়িকা পিয়ারী বেগম ও গায়িকা মাহবুবা রহমান এখনো সুস্থ আছেন এবং আমার জানামতে, ‘মুখ ও মুখোশ’ মুক্তির পর দীর্ঘ ৬০ বছরে তাঁদের মধ্যে আর দেখা হয়নি।

আইডিয়াটা পছন্দ হলো মোস্তফা কামালের। বললেন, ‘এ তো দারুণ ব্যাপার!’ তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন। গবেষণা ও গ্রন্থনার দায়িত্ব পড়ল আমার ওপর। এনটিভির নিয়মিত আয়োজন ‘বন্ধু তোমারই খোঁজে’ অনুষ্ঠানে মুখোমুখি হলেন দুই কিংবদন্তি। শুটিং হলো রমনা পার্কে।

মাহবুবা রহমান ও পিয়ারী বেগম যখন মুখোমুখি হন, তখন তাঁদের চোখে–মুখে বন্ধুত্বের যে অকৃত্রিম উচ্ছ্বাস দেখলাম, সে দৃশ্য অবিস্মরণীয়। ষাট বছর পর দেখা হওয়া দুই বান্ধবীর আলাপ জমে উঠল। স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসলেন পিয়ারী বেগম। মাহবুবা রহমানকেও উৎফুল্ল দেখাল। তিনি শোনালেন সমর দাসের সংগীত পরিচালনায় তাঁর কণ্ঠে, ‘মনের বনে দোলা লাগে’ গানের নেপথ্যকথা, যে গানে পর্দায় ঠোঁট মিলিয়েছিলেন পিয়ারী বেগম।

অনুষ্ঠান প্রচারের পর মাঝেমধ্যে পিয়ারী বেগমের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ হতো। শারীরিকভাবে তখন বেশ সুস্থই ছিলেন। তারপর মাঝখানে বিরাট একটা বিরতি। তাঁরপর হঠাৎ একদিন সংবাদ শিরোনাম!

‘বন্ধু তোমারই খোঁজে’ অনুষ্ঠানে আলাপচারিতার একপর্যায়ে পিয়ারী বেগম বলেছিলেন, ‘আমার সঙ্গে যাঁরা অভিনয় করেছেন, তাঁদের অনেক মিস করি। আমার মনে পড়ে ইনাম ভাইয়ের কথা, সাইফুদ্দীন সাহেবের কথা। রহিমা খালা, বিলকিস বারী, পূর্ণিমার কথা। অনেকেই নেই। একদিন আমিও থাকব না!’

তিনি এখন নেই। সত্যিই নেই? আছেন। পিয়ারী বেগম বেঁচে থাকবেন পথিকৃতের অপরিবর্তনীয় মর্যাদায়।