আমাদের চারপাশে, জনপরিসরে, জনসংস্কৃতির মধ্যে কত কিছুই না ঘটে! এখানে ছেলে হিসেবে পরিচয় দিলে এক রকম সুবিধা, আর মেয়ে পরিচয় দিলে ঘটে অন্য রকম বাস্তবতা। কেন এমন ঘটে?
‘এইটা কি ছেলে না মেয়ে’—প্রতিদিন রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় প্রায়ই এ প্রশ্ন আমার কানে আসে। কখনো আমাকে শোনানোর জন্য বলা হয়, কখনো মানুষ নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে।
আমি কি ছেলে না মেয়ে—এ প্রশ্ন যে আমার জীবনে সাম্প্রতিককালে মানে পাঁচ বছর আগে চুল ছোট রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর উত্থাপিত হয়েছে, বিষয়টা এমন নয়। অনেক ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি, ‘আল্লাহ আমাকে ভুল করে মেয়ে বানিয়েছেন।’ তবে এ কথা সত্য যে যেসব দায়িত্ব আমি নিতে পছন্দ করতাম, যে ধরনের জামাকাপড় বা জুতা পরতে পছন্দ করতাম, যে রকম খেলাধুলার প্রতি আমার আগ্রহ ছিল, সেগুলোর বেশির ভাগই সাধারণত ছেলেরা করে থাকে। সেখান থেকেই আমার লিঙ্গ বিষয়ে একটা ভ্রান্তি ঘটেছে বলে মানুষের ধারণা।
কিন্তু আবার আমার সব বৈশিষ্ট্যই যে ‘ছেলেদের’ মতো, বিষয়টা এমনও না। লোকে আমাকে ‘রুড’ বলে। তবে আমার মধ্যে সহিংসতার ‘স’-ও নেই। মারামারি, কিলাকিলির বিরুদ্ধে আমার অবস্থান খুব শক্ত। বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটানো আমার সবচেয়ে প্রিয় টাইম পাস, গ্যান্দা বাচ্চা থেকে শুরু করে সব ধরনের বাচ্চা কোলে নেওয়ার ব্যাপারে আমার দক্ষতা ভালো ইত্যাদি।
মানুষের ধারণার থেকে আমার নিজের ধারণার দিকে এলে আমার লিঙ্গ বিষয়ে ভ্রান্তি ঘটেছে, এমনটা কখনো মনে হয়নি। কিন্তু জেন্ডার বিষয়ে ভ্রান্তি বা সঠিক অবস্থা—দুই ক্ষেত্রেই আমি নিরপেক্ষ। সমাজবিজ্ঞান পড়তে এসে শিখেছি জেন্ডার রোল হচ্ছে সামাজিক ব্যাপার। অর্থাৎ এতে ছেলে বা মেয়েদের কিছু নির্দিষ্ট এবং অবশ্যই আলাদা ধরনের আগ্রহ, কাজ, দায়িত্ব প্রভৃতি নিতে শেখানো হয়। প্রজাতিগতভাবে মেয়েরা বংশরক্ষা বা সন্তান জন্মদানের কাজটি করে থাকে—এটা যেমন একটা লিঙ্গভিত্তিক বা শারীরবৃত্তীয় ব্যাপার, জেন্ডারের ক্ষেত্রে বিষয়টা এমন না। তাদের মধ্যে কাজ, আগ্রহ বা দায়িত্বের যে ভাগাভাগিটা করা হয় তার সঙ্গে সব সময় শারীরিক সক্ষমতা বা অক্ষমতার ব্যাপার থাকে না। মিনা কার্টুনে মিনা-রাজুর কাজ বদলাবদলি দেখেনি, এমন মানুষ খুব সম্ভবত পাওয়া যাবে না।
এখন বলি, আমার জেন্ডার বিষয়ে ভ্রান্তি বা সঠিকতার ব্যাপারে আমি নিরপেক্ষ, এটা বলতে আমি কী বোঝাচ্ছি। আর সেটা বলার জন্যই রাস্তাঘাটে মানুষ আমাকে দেখে কী ভাবে, সেই প্রসঙ্গের অবতারণা করা হয়েছে। কারণ, আমি আসলে কী করতে পারি, কী করতে পারি না—কতটুকু নিরাপত্তার সঙ্গে করতে পারি—এই সবকিছুর সঙ্গে মানুষ আমাকে নিয়ে কী ভাবছে, তার সরাসরি সম্পর্ক আছে।
আমার একটা নারীর শরীর আছে এবং সেটা নিয়ে এ দেশের পথেঘাটে পুরুষের আগ্রহের কারণে ছোটবেলা থেকেই আমাকে অনেক সহিংস এবং ‘ভায়োলেটিং’ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে (ছেলেরা প্রায়ই দাবি করে থাকেন, বাংলাদেশের রাস্তাঘাট ছেলেদের জন্যও নিরাপদ না কাজেই পরিষ্কার করে যাই, আমার মূল ভয়টা মার খাওয়ার বা ছিনতাই হয়ে যাওয়ার নয়, যৌন সহিংসতার; উভয় অভিজ্ঞতাই আমার আছে)। সেসব অভিজ্ঞতার বিশদে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। কারণ, যাঁরা নারী, তাঁদের কমবেশি অভিজ্ঞতা আছে, পুরুষদের মধ্যে একটা বড় অংশই সহিংসতা করেন, যাঁরা করেন না, তাঁদের সংবেদনশীল ধরে নিচ্ছি; এবং ধরে নিচ্ছি তাঁরা এসব ব্যাপারে জানতে, সচেতন থাকতে এবং প্রতিরোধ করতে চেষ্টা করেন।
বুদ্ধপূর্ণিমার রাতে পদ্মা নদীতে একটা বইঠার নৌকায় বসে আমি হয়তো ভাবতে চেয়েছিলাম স্থিরতা, নির্মলতা, একাগ্রতা; অথবা জগতের সব প্রাণের সুখী হওয়ার ফর্মুলা। কিন্তু আমি ভেবে গেলাম এত ভয়, মানুষের প্রতি এত অবিশ্বাস, অসহায়ত্বের বোধ আর নিজের পরিচয় প্রকাশ করা নিয়ে যত দ্বন্দ্ব হাজির হলো, সেসব নিয়ে। আমি ছেলে না মেয়ে, সেটা আমার জন্য একেবারেই গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে এ পরিচয় আমার জীবনের কত কিছুই না নিয়ন্ত্রণ করে!
সাধারণত আমি তিন-চার মাস পরপর চুল ছোট করি এবং চুল কাটার পর এক মাসের মতো আমি যদি শার্ট পরে বের হই, তাহলে পথেঘাটে বেশির ভাগ মানুষ ধরেই নেন, আমি একটা ছেলে। এ রকম একটা সময়ে যখন আমি বাসে উঠি, তখন সাধারণত একটু ভিড় হলে কন্ডাক্টর এসে আমাকে বলেন, ‘ছোট ভাই একটু দাঁড়াও, মহিলাটাকে বসতে দাও।’ এ পরিস্থিতিতে আমি কিছুই না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে যাই। কারণ, লোকে যদি আমাকে ছেলে ভাবে, তাহলে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোর মধ্যে কারও আমাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ধাক্কা দেওয়া বা বুকে হাত দেওয়ার কারণ ঘটবে না।
যখন মানুষ আমাকে ছেলে ভাবে, তখনো যে আমার কোনো অসুবিধা হয় না, তা নয়। আমি খেয়াল করলাম যে এ দেশের মানুষজন খামোকা আরেকজনের গায়ে হাত দেয়। পেছন থেকে সামনে যাচ্ছে, পিঠে হাত দিয়ে সরিয়ে সামনে যাবে, বাসের মধ্যে হাত রাখার জায়গা পাচ্ছে না তো ঘাড়ে হাত রাখবে, ডিরেকশন জানতে চাইলে সেটা বোঝানোর সময় গায়ে হাত দেবে ইত্যাদি। ব্যাপারগুলো আমার অস্বস্তিকর লাগে, কিন্তু ছেলেদের আসলে কেমন লাগে, জানি না।
যাহোক, যেহেতু মানুষজন আমাকে কখনো ছেলে ভাবে, কখনো মেয়ে ভাবে, কখনো আমি ছেলে না মেয়ে বুঝতে পারে না, সেহেতু কখনো কখনো আমার আসলে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ থাকে যে মানুষ আমাকে ছেলে ভাবলে আমার সুবিধা নাকি মেয়ে ভাবলে। আমি এখন ঢাকায় থাকি এবং আমার নিজের কাজের বা সাংস্কৃতিক পরিসরে জেন্ডার কোনো বিষয় নয়, এসব জায়গায় নিজের নিরাপত্তা নিয়ে কখনোই ভাবিত হই না।
কিন্তু যখন পাবলিক স্পেস বা জনপরিসরে যাওয়ার প্রসঙ্গ আসে, বিশেষ করে ঢাকার বাইরে এবং একা একা এবং ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে, তখন এ সিদ্ধান্তটা নিয়ে আমি সিরিয়াসলি চিন্তা করি।
৪ মে বুদ্ধপূর্ণিমা ছিল। একমাত্র পূর্ণিমা যেটা জাতীয় ছুটি, তো ভাবলাম এটা উদ্যাপন করা জরুরি। গাছের মধ্যে, পাহাড়ের মধ্যে বা পানির মধ্যে পূর্ণিমা দেখাটা উদ্যাপন করার একটা উপায় হতে পারে। আমি পানির মধ্যে দেখার সিদ্ধান্ত নিলাম। তবে পানি তো যে-সে পানি হলে হবে না, নদী বা সমুদ্র বা হাওর হতে হবে। এখন কি নিকলী যাব, নাকি মৈনটঘাট যাব নাকি গুলিয়াখালি যাব—এটা নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলাম। তার থেকে বেশি চিন্তায় পড়ে গেলাম পূর্ণিমা দেখতে হলে রাত পর্যন্ত থাকতে হবে। রাতের বেলা আমি যেখান থেকেই আসি না কেন—একা একা কীভাবে আসব?
বন্ধুদের দুই-তিনজনকে বললাম। কেউ কেউ ব্যস্ত, কারও কারও বেশি আগ্রহ নেই, সুতরাং আমি আসলে একাই। কিন্তু এ রকম যদি কাউকে পাওয়া না যায় (যেটা আসলে জীবনের বেশির ভাগ সময় ঘটার সম্ভাবনা), তাহলে কি সব সময়ই আমার সব প্ল্যান বাদ দেব? ‘নিরাপদ’ না দেখে? বাংলাদেশে এসব আবেগপ্রবণ চিন্তা করে লাভ নেই।
আমি একটা মেয়ে এবং আমার নিরাপত্তার গ্যারান্টি কেউ দেবে না। গত এক-দুই বছরে বেশ কয়েকবার বেড়ানোর প্ল্যান বাদ দিতে হয়েছে বন্ধুদের সঙ্গে সময় মেলেনি বলে। এই যে অন্যদের ওপর নির্ভরতা (যদিও যৌক্তিক)—এটাতে আমি অনেকটাই অসহায় বোধ করলাম। ভাবলাম অনেক দিন সাহস করে কিছু করি না, একটু বেড়িয়ে আসি।
৪ তারিখ বিকেলে একটা শার্ট আর জিনসের প্যান্ট পরে বের হলাম, ঈদের পরেই চুল কেটেছি। তাই ধরে নিলাম যে ঢাকার প্রান্তের মানুষের আমাকে মেয়ে ভাবার কোনো কারণ নেই। বেড়ালাম ঠিকই, মৈনটঘাট গেলাম, রাত সাড়ে আটটার বাসে ফেরত আসতে পারলাম। বাসের কন্ডাক্টর, পাশের যাত্রী, নৌকার মাঝি—সবাই আমাকে ছেলেই ভাবল। দুই ঘণ্টা নৌকায় ঘুরলাম, মাঝির সঙ্গে অনেক কথা হলো; একবারের জন্যও তার মনে হলো না যে আমি একটা মেয়ে হতে পারি। কম বয়সী মাথাপাগল ছেলে একা একা বেড়াতে চলে এসেছি ভেবে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি যে একা একা চইলা আইছ, বাপ-মা চিন্তা করব না পুলায় কই গেল!’ আমি তাঁর ভুল ভাঙালাম না, মাঝনদীতে ভুল ভাঙানোর ভরসাও পেলাম না, কিন্তু ব্যাপারটা খুব আরামদায়ক হলো না।
চারদিকে পানি, স্রোতে নৌকা দুলছে, মাঝেমধ্যে ট্রলার যাচ্ছে, বড় বড় লঞ্চ যাচ্ছে—সেসব বড় বড় মেশিনের যানের তৈরি করা স্রোতে বইঠার নৌকা আরও জোরে জোরে দুলে ওঠে। দৃষ্টিসীমার মধ্যে পদ্মার এক দিকে সূর্য নেমে যাচ্ছে, অন্যদিকে বুদ্ধপূর্ণিমার গোল বড় চাঁদ দৃশ্যমান হচ্ছে। আকাশ গাঢ় নীল হয়ে আসছে, ফাঁকে ফাঁকে ভেড়ার লোমের মতো আর পাখির ডানার মতো মেঘ। দিনের এই সময়টা আমার খুব প্রিয়।
বুদ্ধপূর্ণিমার রাতে পদ্মা নদীতে একটা বইঠার নৌকায় বসে আমি হয়তো ভাবতে চেয়েছিলাম স্থিরতা, নির্মলতা, একাগ্রতা; অথবা জগতের সব প্রাণের সুখী হওয়ার ফর্মুলা। কিন্তু আমি ভেবে গেলাম এত ভয়, মানুষের প্রতি এত অবিশ্বাস, অসহায়ত্বের বোধ আর নিজের পরিচয় প্রকাশ করা নিয়ে যত দ্বন্দ্ব হাজির হলো, সেসব নিয়ে। আমি ছেলে না মেয়ে, সেটা আমার জন্য একেবারেই গুরুত্বপূর্ণ না। তবে এই পরিচয় আমার জীবনের কত কিছুই না নিয়ন্ত্রণ করে!