গতকাল ১৭ এপ্রিল ছিল লাতিন আমেরিকার কিংবদন্তি কথাশিল্পী গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের মৃত্যুদিন। ‘সিরিয়াস’ ধারার সাহিত্যিক হয়েও বিশ্বব্যাপী কেন জনপ্রিয়তা পেয়েছেন তিনি? তাঁর উপন্যাসের চরিত্ররা বারবার কেন যৌনতার দ্বারস্থ হয়?
‘একদিন সকালে অস্বস্তিকর স্বপ্ন দেখে জেগে উঠে গ্রেগর সামসা দেখতে পায়, নিজের বিছানায় সে একটা আরশোলায় রূপান্তরিত হয়েছে।’
‘মেটাফরফসিস’—ফ্রানৎস কাফকা
উপন্যাসের শুরুর বাক্যটা লেখা নাকি সবচেয়ে কঠিন ও গুরুত্বপূর্ণ। কাহিনি, প্লট, চরিত্র কেমন হবে, তার একটা আগাম বার্তা পাওয়া যায় প্রথম বাক্যে। অতিদূর বন্দরের আলো অনুসরণ করে জাহাজ যেমন নোঙর করে, পাঠকও পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ওলটানোর আগে প্রথম বাক্য থেকে একটা ধারণা পান। খুব কম ঔপন্যাসিক আছেন, যাঁরা শুরুর বাক্য নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারেন। একের পর এক পৃষ্ঠা ছিঁড়ে কিংবা ব্যাক স্পেস দেওয়ার পর হঠাৎ বিদ্যুৎ–চমকের মতো পাওয়া যায় প্রথম লাইন। প্লট-চরিত্র ভেবে রাখলেও যথাযথ বাক্য না পাওয়ায় কত উপন্যাস যে এখনো ভ্রুণেই রয়ে গেল, সে শুধু লেখকেরাই জানেন। আবার কোনো প্রকার আগাম প্লট-চরিত্র ছাড়াই স্বপ্নে পাওয়ার মতো একটি বাক্য থেকেই সৃষ্টি হতে পারে মহৎ কোনো উপন্যাস। জানা নেই ‘নিঃসঙ্গতার এক শ বছর’ লেখার সময় গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস (৬ মার্চ ১৯২৭-১৭ এপ্রিল ২০১৪) এ দুইয়ের কোনটির ভেতর দিয়ে এগিয়েছেন। তবে সেই শুরুর বাক্যটি নিশ্চিত আজও আপনাকে বরফ আবিষ্কারের শীতল অনুভূতি এনে দেবে। স্মৃতি হাতড়ে প্রথম বাক্যটি আবার পড়া যাক—‘বহু বছর পর, ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়িয়ে কর্নেল অরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার মনে পড়ে যাবে সেই দূর বিকেলের কথা, যেদিন তাকে সঙ্গে নিয়ে বরফ আবিষ্কার করেছিল তার বাবা।’
ঈশ্বরের ‘ধ্বনি’থেকে যেমন দুনিয়ার সৃষ্টি, তেমনি এই বাক্য থেকেই যেন শুরু হয়েছে মার্কেসের কল্পিত গ্রাম মাকোন্দো। আমাদের চেনা জগতের বাইরের বুয়েন্দিয়া পরিবারের শত বছরের নিঃসঙ্গতার গল্প। বিশ্বসাহিত্যে মার্কেসের এ বাক্যের মতো প্রভাববিস্তারী শুরু খুব কমই আছে। তবে অনেকে মনে করেন, ফ্রানৎস কাফকার ‘মেটামরফসিস’-এর শুরুর বাক্য থেকে প্রভাবিত হয়ে এমন লম্বা ও কাব্যিক বাক্য লিখেছেন তিনি।
গ্যাবো বেঁচে থাকতে জানিয়েছিলেন, কোনো জাদুবাস্তবতা নয়, লাতিন আমেরিকার জীবনটাই এমন অতিলৌকিক, অবাস্তব ও রহস্যে ভরা। এই কারণেই হয়তো ‘কলেরার দিনগুলোতে প্রেম’ উপন্যাসে শৈশবের প্রেমিকা ফারমিনা ডাজাকে ভুলতে ফ্লোরেন্তিনো আরিজার ৬২২ নারীর সঙ্গে শোয়াকে অবাস্তব মনে হয় না। বয়স ৭০ পেরিয়ে গেলেও সাগরে ভাসমান জাহাজে দুজনের মিলনকে মনে হয় স্বাভাবিক।
মার্কেসের গল্প বলার ভঙ্গিটাই এমন—কাব্যিকতায় মোড়ানো বড় বড় বাক্য। তবে সেসব কোনোভাবেই হেলে যায় না, বরং আরেকটি বাক্যের সেতু গড়ে দেয়। বাংলা সাহিত্যে হুমায়ূন আহমেদের পর থেকে সব ক্ষেত্রে ছোট ছোট বাক্যে কথা বলার একটা প্রবণতা লক্ষ করা যায়। সে হোক গল্প-উপন্যাস বা পত্রপত্রিকায়। অসামঞ্জস্যপূর্ণ, জটিলতা এড়াতে এবং পাঠকের মনোরঞ্জনের চেষ্টার তাগিদে হয়তো এমনটা হয়ে আসছে। কিন্তু বড় বাক্য লেখার পরও যে মার্কেসের পাঠক কমেনি! মার্কেস পাঠ হলো, দূরের গন্তব্যে যেতে যেতে কোনো ছায়াঢাকা গাছের তলায় জিরোনো। তারপর আবার গান গেয়ে হাঁটা শুরু করা। বড় বড় বাক্যের মধ্যখান দিয়ে মার্কেস হঠাৎ ‘সাবধান গরুর দল, জীবন দুই দিনের’ মতো কৌতুকপ্রদ ও দার্শনিক কথা বলে দেন। টানা পাঠের মধ্যে তাতে পাঠক একটু স্বস্তি পান। মার্কেস এমনভাবে গল্প বলেন, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ঊর্ধ্বে উঠে আপনাকে বসে শুনতে হবে। এই গল্প বলা তিনি রপ্ত করেছেন শৈশবে, দাদিমার কাছ থেকে। কলম্বিয়ার যে গ্রামে বেড়ে উঠেছেন, ‘নিঃসঙ্গতার এক শ বছর’-এর মাধ্যমে তার স্মৃতি রোমন্থনের জন্যও বেছে নিয়েছেন দাদিমার মতো আয়েশি ভঙ্গিতে গল্প বলাকে। শুরুতে সেই বরফ আবিষ্কারের পর গ্যাবো উপন্যাসের জাল বিস্তার শুরু করেন। মাকোন্দো পত্তনের পর উরসুলাকে সাক্ষী রেখে শত বছরের বুয়েন্দিয়া পরিবারের সাত প্রজন্মের গল্প বলেছেন কখনো এককভাবে, কখনো সমান্তরালে।
পুরো বুয়েন্দিয়া পরিবারের ভেতর দিয়ে মার্কেস বর্ণনা করেছেন লাতিন আমেরিকার জীবন ও সংস্কৃতি। মুহূর্তে মুহূর্তে এই বর্ণনাকে মনে হবে অতিলৌকিক। তবে অবিশ্বাস্য বলে উড়িয়ে দিতে পারবেন না। এখানেই মার্কেসের লেখার সার্থকতা। সাহিত্যের ভাষায় একে হয়তো ‘ম্যাজিক রিয়ালিজম’ বা জাদুবাস্তবতা হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে। তবে গ্যাবো বেঁচে থাকতে জানিয়েছিলেন, কোনো জাদুবাস্তবতা নয়, লাতিন আমেরিকার জীবনটাই এমন অতিলৌকিক, অবাস্তব ও রহস্যে ভরা। এই কারণেই হয়তো ‘কলেরার দিনগুলোতে প্রেম’ উপন্যাসে শৈশবের প্রেমিকা ফারমিনা ডাজাকে ভুলতে ফ্লোরেন্তিনো আরিজার ৬২২ নারীর সঙ্গে শোয়াকে অবাস্তব মনে হয় না। বয়স ৭০ পেরিয়ে গেলেও সাগরে ভাসমান জাহাজে দুজনের মিলনকে মনে হয় স্বাভাবিক। ‘কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না’ নভেলায় বন্দরে কর্নেলের দিনের পর দিনের অপেক্ষা, ‘গোত্রপিতার হেমন্ত’ উপন্যাসে গোত্রপিতার মৃত্যুর দুই শ বছর পরও স্বৈরাচারী শাসনের ভেতর দিয়ে তার জীবিত থাকা কিংবা ‘আমার দুঃখভারাক্রান্ত বেশ্যাদের স্মৃতিকথা’য় ৯০ বছরের বুড়োর প্রথমবার রজঃস্বলা হওয়া কুমারীর সঙ্গে শোবার ইচ্ছাকে মনে হয় না অতিকল্পিত।
উপন্যাস ও গল্পের এমন অতিকল্পিত তবে বাস্তবতার ভেতরের গল্পটা মার্কেসের পুরো সাহিত্য-জীবনজুড়ে। শুরুতে পেশায় ছিলেন সাংবাদিক। তবে সাংবাদিকতার মতো নিরেট সত্যকে বলতে চাননি সাহিত্যে। উপন্যাস বা গল্প যা-ই লিখেছেন, কবিদের মতো রূপক-প্রতীকীর ভেতর দিয়ে কথা বলেছেন মার্কেস। ‘সরলা এরেন্দিরা’ গল্পে এরেন্দিরার সামান্য ভুলের জন্য তার দাদিমা সারা জীবন যে শাস্তি দিয়ে যান, সেটি আমাদের ক্ষমতাবান ও ক্ষমতাহীনের অর্থটাকে আরও সরল করে দেয়। ‘থুত্থুড়ে ডানাঅলা বুড়ো’ বা ‘আমি তো কেবল একটি টেলিফোন করতে এসেছিলাম’ গল্পগুলোসহ তাঁর সব লেখার ভেতর দিয়ে মার্কেসের যে চেহারা আমরা দেখি, সেটি পুরোপুরি মানবিক। শোষিতদের পক্ষের। হাস্যরসের ভেতর দিয়ে এঁকেছেন একনায়কতন্ত্রের ভয়ংকর চিত্র। গ্যাবোর জন্মস্থান কলম্বিয়ায় সংঘাত যেন স্বাভাবিক ব্যাপার। একনায়কতন্ত্র ও স্বৈরাচারবিরোধী রক্তক্ষয়ী আন্দোলন দেখেই তার বেড়ে ওঠা। কলম্বিয়ায় মার্কিন সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রচেষ্টা, গ্রামে গ্রামে কলা কোম্পানির আগ্রাসন—সবই ধরা পড়েছে তাঁর লেখায়। কখনো হাস্যরসের ভেতর দিয়ে, কখনো প্রেমের মাধ্যমে।
মার্কেসের প্রধান চরিত্রগুলো পুরোপুরি ‘আনপ্রেডিক্টেবল’ বা অনির্দেশ্য। একেক বেলায় তারা একেক রূপ নিয়ে হাজির হয়। তাঁর প্রবল রসবোধ বা ‘সেন্স অব হিউমার’ প্রতিফলিত হয়েছে চরিত্রগুলোর মধ্যে। ‘নিঃসঙ্গতার এক শ বছরে’ হোসে আর্কাদিওর ভবঘুরে জীবন থেকে মাটিখেকো রেবেকার সঙ্গে জড়িয়ে সংসারী হয়ে ওঠা, কৈশোরের ভাবুক অরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া থেকে পরে কর্নেল অরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া হয়ে ওঠার ভেতর দিয়ে মার্কেজ বুঝিয়ে দিচ্ছেন—জীবন স্থির নয়। তার গতিপথ যেকোনো মুহূর্তে পাল্টাতে পারে। অরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া, যিনি বত্রিশটা সশস্ত্র বিদ্রোহ সংগঠিত করে সব কটিতেই হেরে গিয়েছিলেন, এড়িয়ে গিয়েছিলেন প্রাণের ওপর চালানো চৌদ্দটা হামলা, তিয়াত্তরটা অ্যামবুশ আর একটা ফায়ারিং স্কোয়াড। পরবর্তী জীবনে উদ্দেশ্যহীন যুদ্ধের হতাশা থেকে তিনি কামারশালায় ছোট ছোট সোনার মাছ বানানোতে মনোনিবেশ করেছিলেন। কুমারী আমারান্ডা থেকে সুন্দরী রেমেদিওস, অরেলিয়ানো সেগান্দো, আমারান্ডা উরসুলা—সবাই যেন একেকটি ‘আনপ্রেডিক্টেবল’ চরিত্র।
এই অনির্দিষ্ট চরিত্রগুলো মার্কেসের লেখার অন্যতম শক্তি। তাঁর কথনভঙ্গি সরাসরি নয়। বর্ণনাভঙ্গি ‘সিম্বলিক’ বা রূপকধর্মী। বাস্তবতাকে বিভিন্ন আঙ্গিক থেকে দেখার অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ‘সরলা এরেন্দিরা’র কথা। চৌদ্দ বছরের এরিন্দিরার প্রেমে পড়ে ইউলিসিস যখন যা ধরতে যায়, তাই সোনা হয়ে যায়; তখন তার বাবা বুঝতে পারেন ছেলে প্রেমে পড়েছে। ইউলিসিস যে প্রেমে পড়েছে, তা মার্কেস সরাসরি বলে দিচ্ছেন না। স্পর্শ ও সোনার ভেতর দিয়ে বোঝাচ্ছেন—প্রেম কতটা আবেগের আর ভয়াবহ। একইভাবে আমরা দেখব, ‘কলেরার দিনগুলোতে প্রেম’ উপন্যাসে ফারমিনা ডাজার ঘ্রাণশক্তির পরিচয়। কীভাবে সে লুকিয়ে থাকা সন্তানকে ঘ্রাণেন্দ্রিয় দিয়ে খুঁজে পাচ্ছে। সন্তানের প্রতি মায়ের চিরায়ত ভালোবাসা ও ¯স্নেহ বা নারী জাতির প্রাণশক্তিকে মার্কেস বুঝিয়ে দিচ্ছেন ঘ্রাণের মাধ্যমে।
মার্কেসের গল্প-উপন্যাস মানেই প্রচুর যৌনতার উপস্থিতি। তাঁর লেখনীর খাতিরে যা যথেষ্ট উপভোগ্যও। মার্কেজের চেতনা আবর্তিত হয়েছে কার্ল মার্ক্স ও সিগমুন্ড ফ্রয়েডকে কেন্দ্র করে। যদিও সমালোচকেরা দাবি করেন, মার্কেজের লেখার মধ্যে আছে উইলিয়াম ফকনারের প্রভাব। গ্যাবো নিজেও একসময় তা স্বীকার করেছিলেন। তবে আদিম মাতৃতান্ত্রিক সমাজের একটা ছায়া রয়েছে তাঁর লেখায়। মার্কেজের চরিত্রগুলো নিঃসঙ্গতা থেকে বাঁচতেই বারবার যৌনতার দ্বারস্থ হয়। কিন্তু এই সাময়িক আনন্দ তাদের সুখ দিতে পারে না, মুক্তি দিতে পারে না বিচ্ছিন্নতাবোধ ও নিঃসঙ্গতা থেকে। ফলে পতন ঘটে ‘নিঃসঙ্গতার এক শ বছরের’ মাকোন্দো গ্রামের। একের পর এক যৌনসঙ্গও ‘কলেরার দিনগুলোতে প্রেম’ উপন্যাসে ফ্লোরেন্তিনো আরিজাকে তৃপ্ত করতে পারে না। মার্কেসের চরিত্রগুলোর এই যৌনতা অভ্যাসের চেয়েও বড় হলো, নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্তি এবং সারা দিনের খাটনি শেষের একমাত্র বিনোদন।