ভাস্কর শামীম সিকদারের পকেটে কেন পিস্তল ছিল

গতকাল প্রয়াত হয়েছেন ভাস্কর শামীম সিকদার। ভাস্কর্যশিল্পের জন্য তো বটেই, নিজের মতো পোশাক–পরিচ্ছদ পরা এবং চলাফেরার কারণে ঢাকা শহরে আলোচিত ছিলেন তিনি।

নিজের ভাস্কর্যের সামনে শামীম সিকদার

বিশেষ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম—এ রকম একটি ভাস্কর্য আছে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনে (বিএফডিসি)। বাংলাদেশের শত শত ছবিতে এটি দেখা গেছে। একেবারে সাধারণ গ্রামীণ দর্শক, যিনি হয়তো ঢাকায়ও আসেননি, কিন্তু সিনেমার মধ্যে ভাস্কর্যের নজরুলকে দেখেছেন—যুবক নজরুল দাঁড়িয়ে আছেন প্রেমিক-ভঙ্গিতে, হাতে বাঁশি। কিন্তু অনেকেরই হয়তো জানা নেই, এফডিসির নজরুল শিল্পকর্মটির ভাস্কর শামীম সিকদার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি সড়কদ্বীপে অবস্থিত ‘স্বোপার্জিত স্বাধীনতা’, জগন্নাথ হলের মাঠে দাঁড়ানো ‘বিবেকানন্দ’—এগুলো শামীম সিকদারের কাজ। নিউ ইস্কাটনে তাঁর একটি ভাস্কর্যবাগান আছে। জগন্নাথ হলের পেছনে উদয়ন স্কুল ও সলিমুল্লাহ হলের মুখে সড়কে তাঁর শিল্পকর্মের সবচেয়ে বড় উন্মুক্ত গ্যালারি এখন ঢাকায়। এখানে প্রায় শ খানেক ভাস্কর্য তিনি করে রেখে গেছেন। এ ছাড়া দেশে-বিদেশে তাঁর আরও অনেক কাজ সংগ্রহে রেখেছেন বিভিন্ন কলারসিক ও প্রতিষ্ঠান। চারুকলার ভাস্কর্য বিভাগ থেকে অধ্যাপক হিসেবে অবসর নেওয়ার পর শামীম সিকদার চলে যান লন্ডনে।

শামীম সিকদার

১৯৫২ সালে জন্মেছিলেন তিনি, মারা গেলেন ২১ মার্চ ২০২৩। বলতে পারি, ভাস্কর হিসেবে শামীম সিকদারের জীবনে প্রভাব রেখে থাকতে পারেন পঞ্চাশের দশকেই নিজের কাজে স্বাক্ষর রাখা ভাস্কর নভেরা আহমেদ। বাংলাদেশের নারী বলতে যা বোঝায়, চলনেবলনে ও সৃজনে নভেরা আহমেদ এবং পরে শামীম সিকদার যেনবা তার বাইরেই ছিলেন। দুজনের পোশাক–পরিচ্ছদও তাই প্রথাগতভাবে শাড়ি-ব্লাউজ ছিল না। শামীম সিকদার জিনস-শার্ট আর পায়ে কেডস পরতেন। পকেটে সত্যিকারের পিস্তল ঝুলিয়ে রাখতেন। কেন রাখতেন? বড় ভাই সিরাজ সিকদারের মতো তিনিও কি নিজেকে বিপ্লবী মনে করতেন?

শামীম সিকদার নিজেই গাড়ি চালিয়ে আসতেন চারুকলায়, আমরা ছাত্ররা তাকিয়ে দেখতাম। শামীম ম্যাডাম এককথায় ‘ডেসপারেট অ্যাপ্রোচে মুভ’ করতেন। ঢাকা শহর যেনবা তাকিয়ে দেখেছে ভাস্কর শামীম সিকদারকে, যার বড় ভাইয়ের নাম সিরাজ সিকদার, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে শ্রেণিবদলের রক্তাক্ত আলোচিত-সমালোচিত সেই বিপ্লবী সিরাজ সিকদার।

সিমেন্ট, কাঠ, ব্রোঞ্জ, প্লাস্টার অব প্যারিস, কাদা, কাগজ, লোহা ও গ্লাস ফাইবারকেও মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছেন শামীম সিকদার। একুশে পদক পেয়েছেন তিনি। পেয়েছেন দেশ-বিদেশের আরও অগণন পদক ও সম্মাননা। বাংলাদেশ তাঁকে চেনে-জানে, তিনি কে?

যে দেশের নারীরা ঢেঁকিতে ধান ভেনে চাল বের করে স্বামীর জন্য রান্না করে পাখা দিয়ে হাওয়া দেয় গরম ভাতে, সেই দেশেরই নারী শামীম সিকদার। শামীম নাম তো এ দেশে সচরাচর পুরুষবাচকই, কিন্তু এদেশে শামীম নামটি জানামতে কেবল একজন নারীরই, তিনি শামীম সিকদার, পুরো নাম শামীম আরা সিকদার। অথচ বাংলাদেশ এমন একটি দেশ, যেখানে চিত্রকলাই যে সামগ্রিকভাবে ঘরে ঘরে খুব বেশি আদৃত, তা–ও নয়, তাহলে ভাস্কর্যের গ্রহণযোগ্যতা সামাজিকভাবে কীভাবে বাড়বে? সেখানেই ভাস্কর হিসেবে শামীম সিকদার কাজ করে গেলেন, নাম করলেন। নিজের স্বাক্ষর রেখে গেলেন। এটি বাংলাদেশের বর্তমান ও আগামী দিনের অনাগত নারী-পুরুষের জন্য প্রেরণা হয়ে থেকে যাচ্ছে, যেভাবে আমরা নভেরাকে মনে রেখে যাচ্ছি।

কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে শামীম সিকদার

অসংখ্য ভাস্কর্য নির্মাণের পাশাপাশি শামীম সিকদার গ্রন্থ রচনা করেছেন বেশ কিছু। যেমন ‘ইনার ট্রুথ অব স্কাল্পচার: আ বুক অন স্কাল্পচার’, ‘স্কাল্পচার কামিং ফরম হ্যাভেন, কনটেম্পোরারি আর্ট সিরিজ অব বাংলাদেশ’। কবি জাকারিয়া চৌধুরী তাঁর স্বামী ছিলেন। তাঁদের একটি পুত্র ও একটি কন্যাসন্তান আছে।

বাংলাদেশের আরেক মনীষী লেখক-চিন্তক আহমদ ছফার অকৃতদার জীবনের সঙ্গেও ভাস্কর শামীম সিকদারের সময় ও জীবন জড়ানো কিছু মিথ এখনো ফেরি করে বেড়ায় ঢাকার শিল্পসাহিত্যের হাওয়া। অথচ সময় গড়িয়ে গেছে। সময় কোথায় গড়িয়ে গেছে? সময়ের ভ্রমণটা ঠিক দেখা যায় না। ঢাকা শহর আছে, কিন্তু সেই ষাটের দশক নেই, সত্তরের দশক নেই, আহমদ ছফা নেই, আবুল হাসান নেই, সুরাইয়া খানম নেই, ২১ মার্চ থেকে শামীম সিকদারও নেই। তিনিও অনন্তের পথে চলে গেলেন। যেনবা জীবন চলে গেলেও শামীম শিকদার থেকে গেলেন তাঁর শিল্পসম্ভারে, তাঁকে নিয়ে বিস্তর আলোচনায় মুখর ঢাকা শহর।

বাংলাদেশের আরেক মনীষী লেখক-চিন্তক আহমদ ছফার অকৃতদার জীবনের সঙ্গেও ভাস্কর শামীম সিকদারের সময় ও জীবন জড়ানো কিছু মিথ এখনো ফেরি করে বেড়ায় ঢাকার শিল্পসাহিত্যের হাওয়া।

অথচ সময় গড়িয়ে গেছে। সময় কোথায় গড়িয়ে গেছে? সময়ের ভ্রমণটা ঠিক দেখা যায় না। ঢাকা শহর আছে, কিন্তু সেই ষাটের দশক নেই, সত্তরের দশক নেই, আহমদ ছফা নেই, আবুল হাসান নেই, সুরাইয়া খানম নেই, ২১ মার্চ থেকে শামীম সিকদারও নেই। তিনিও অনন্তের পথে চলে গেলেন। জীবন চলে গেলেও শামীম সিকদার থেকে গেলেন তাঁর শিল্পসম্ভারে, তাঁকে নিয়ে বিস্তর আলোচনায় মুখর ঢাকা শহর। তিনি থেকে গেলেন চারুকলায়, থেকে গেলেন এ দেশের যত মেয়ে এ মুহূর্তে ভাস্কর্য বিভাগে অধ্যয়ন করছে, শক্তি হিসেবে তাঁদের ভেতরে। আর ভাস্কর্য যেহেতু একেকটা স্থাপনা, সহজে সরানো যায় না, শামীম সিকদারকেও সরানো যাবে না।

আহমদ ছফা ও শামীম সিকদার।

কোনো ভাস্কর বা শিল্পীর কাজ সব দর্শকের একরকমভাবে ভালো বা মন্দ লাগার কথা নয়। এটাই স্বাভাবিক। শামীম সিকদারের কাজও সবার একই মাত্রায় ভালো লাগবে না, তা–ও স্বাভাবিক। তাই বলে কি তাঁকে অপমান করা কোনো ভালো কাজ হিসেবে গণ্য হতে পারে? নৈতিকভাবে ঠিক? মোটেও নয়।

চারুকলার বকুলতলায় শামীম সিকদারের একটি শিল্পকর্ম আছে—রংতুলি ও প্যালেট হাতে করে জয়নুল আবেদিনের দাঁড়িয়ে থাকার একটি ভঙ্গি। অনেক বছর ধরেই আমরা এটি দেখেছি, কিন্তু সাম্প্রতিক কয়েক বছর ভাস্কর্যটি পলিথিন দিয়ে মুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এখনো মোড়ানো আছে। কারা করল এটি? যে বা যাঁরা করেছেন, তাঁর বা তাঁদের কি কোনো কাজ আমরা দেখেছি? দেখিনি। তাহলে? যে চারুকলায় সারা জীবন অধ্যাপনা শেষে অবসরে গেলেন শামীম সিকদার, সেই চারকলা প্রাঙ্গণেই এটি তাঁর প্রাপ্য হতে পারে? অনুমানক্ষমতা থেকে বলতে পারি, এটি করা হয়েছে ঈর্ষাবশত। এখন তিনি, শামীম ম্যাডাম জগতের সব ঈর্ষা থেকে দূরে চলে গেলেন। ঈর্ষাকাতর ও অযোগ্যরাই তো এ দেশে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানে গেঁড়ে বসে থাকেন, কর্তৃত্ব চালাতে পছন্দ করেন। এভাবেই একাডেমিক শাসন জারি করে রাখা হয়। একাডেমিক লোকেরাই মনে করতে থাকেন, তাঁরাও নাকি সৃজন করে চলেছেন! যেমন এ দেশে বাজার-পুঁজির সাপোর্টে ছবি বানিয়েও কেউ কেউ যখন বলেন, তিনি স্বাধীন নির্মাতা, ব্যাপারটা হাস্যকর।

অবশ্য শামীম সিকদার একাডেমির বাইরের লোক নন। কিন্তু তিনি অনেক কাজ করেছেন। দেশের বাকি ভাস্কর সবাই মিলেও মনে হয় তত কাজ করেননি, শামীম সিকদার একাই যত কাজ করেছেন। সেই গুণ ও পরিশ্রম করার সামর্থ্য সবার থাকে না। আর ভাস্কর্য করতে তো গায়েগতরে পরিশ্রম করতে হয়, সেটিও সবাই পারেন না। নারী যখন ভাস্কর হন, হাতে থাকে তাঁর হাতুড়ি-বাটাল, তাই সেই নারীর কমনীয়তা কমে যেতে বাধ্য। একটা রুক্ষতা এসে যেতে পারে মুখে বা ত্বকে। শামীম ম্যাডামকে কি একটু রুক্ষ মনে হতো না? ক্ষতিকর হলেও তিনি নিয়মিত ধূমপায়ী ছিলেন। একদিন তাঁর প্যাকেট থেকে ক্লাসরুমে আমি একটি শলাকা চুরি করে ধরা পড়ে গিয়েছিলাম।

বাংলাদেশের মানুষ ভাস্কর শামীম সিকদারকে স্মরণে রাখবে, সেই কাজ তিনি করে গেছেন। ভাস্কর্যশিল্পের ইতিহাস তাঁকে বহন করে যাবে।