লেখকের জন্ম বা মৃত্যুদিনেই কেন মনে পড়তে হবে যে তাঁদের লেখা কিছু হয় না

গতকাল সোমবার ওপার বাংলার কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার দেহত্যাগ করেছেন। হতে পারে, সাহিত্যিক হিসেবে তিনি বড়। আবার এমনও হতে পারে, তিনি আলোচনারও যোগ্য নন। কিন্তু যেদিন তিনি অন্য জগতের উদ্দেশে যাত্রা করলেন, সেই দিনটাতে কি তাঁকে আমরা সম্মানের সঙ্গে বিদায় জানাতে পারি না?

সমরেশ মজুমদার
ছবি: খালেদ সরকার

যে সাহিত্যিক আজ মারা গেলেন, তাঁকে সম্মানের সঙ্গে বিদায় নিতে দিন। এ বিদায় তাঁর প্রাপ্য। আপনার ব্যক্তিগত কোনো ক্ষতি তিনি করেননি, মানবতারও নয়। করলে বড়জোর সাহিত্যের কিছু ‘ক্ষতিবৃদ্ধি’ করেছেন।

সাহিত্যের বিশুদ্ধতা রক্ষার পবিত্র দায়িত্ব আপনাকে কেউ দেয়নি, আপনি নিজেই কাঁধে তুলে নিয়েছেন। খুবই গুরুদায়িত্ব আপনার কাঁধে, কিন্তু এটা মৃত ব্যক্তির ‘অপরাধ’ হতে পারে না। তাঁকে মাফ করে দিন। অন্য একদিন তাঁর সাহিত্য নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে বসবেন। আজ নয়। আজ তাঁর মৃত্যুর দিন।

জনপ্রিয় লেখকদের জন্মদিন বা মৃত্যুদিনেই কেন মনে পড়তে হবে যে তাঁদের লেখা কিছু হয় না। পারলে এই দিনে তাঁদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করুন, না পারলে চুপও থাকা যায়। চুপ থাকলে আপনাকে কেউ বোকা ভাববে না, বরং মুখ খুললেই সেই আশঙ্কা বেশি।

কেউ একজন আজ মারা গেলেন, হতে পারেন তিনি সাহিত্যিক, অভিনেতা, চলচ্চিত্রকার বা বিখ্যাত কেউ—মৃত্যুর পরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইদানীং তাঁর ওপর দিয়ে আলোচনা-সমালোচনার ‘টর্নেডো’ বয়ে যায়, এটা কি এখন দিনে দিনে একটা ‘ট্রেন্ড’–এ পরিণত হচ্ছে?

যিনি আজ মারা গেলেন বা যাঁর আজকে জন্মদিন, সেই ঔপন্যাসিকের অসংখ্য ভক্ত, পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব আছে। এই দিনটা ওই মানুষগুলোর কাছে বিশেষ কিছু। এদিনে তাঁরা শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁদের প্রিয় মানুষ, কাছের মানুষটাকে স্মরণ করতে চান, বরণ করতে চান। কিন্তু সমালোচকদের বিরূপ মন্তব্য তাঁদের দুঃখ এবং শোকই কেবল বাড়িয়ে দেয়। এর বেশি কিছু করতে পারে না।

এই যেমন গতকাল সোমবার ওপার বাংলার কথাসিত্যিক সমরেশ মজুমদার দেহত্যাগ করেছেন। হতে পারে, সাহিত্যিক হিসেবে তিনি বড়। আবার এমনও হতে পারে, তিনি আলোচনারও যোগ্য নন। কিন্তু যেদিন তিনি অন্য জগতের উদ্দেশে যাত্রা করলেন, সেই দিনটাতে কি তাঁকে আমরা সম্মানের সঙ্গে বিদায় জানাতে পারি না? আমাদের মধ্যে যাঁরা আজ তাঁর সমালোচনা করছি, বলছি যে তাঁর একটা উপন্যাসও পদের না, এক শটা উপন্যাস লিখেও আদতে তিনি একটা উপন্যাসও ঠিকঠাক লিখতে পারেননি—এই কথাগুলো নিয়ে কি পরে কখনো আলোচনা করা যেত না? আজই উপযুক্ত সময়?  
কোনো ঔপন্যাসিক যখন লেখেন, তখন তিনি এটা নিশ্চিতভাবেই জানেন যে নেতিবাচক সমালোচনার স্বীকার হতে পারেন। পৃথিবীর কোনো শিল্পই একই সঙ্গে সবাইকে সন্তুষ্ট করতে পারে না। সেটা সম্ভব নয়। একজন লেখক এটা জেনেই লিখতে বসেন।  

তবে কোনো লেখকের প্রয়াণের দিনে এটি নিয়ে অসংবেদনশীল মন্তব্য করে আপনি একটা কাজই কেবল ঠিকঠাকভাবে করতে পেরেছেন। তা হলো, মানুষ হিসেবে নিজেকে আর একটু ছোট করা।

যেকোনো ব্যক্তিরই যে কারও লেখা পছন্দ বা অপছন্দ করার অধিকার রয়েছে। তবে এটা কখনোই ভোলা উচিত নয়, ওই সাহিত্যিক—যাঁর সমালোচনা আপনি করছেন, তিনি তাঁর গোটা জীবনটা উৎসর্গ করেছেন সাহিত্যে। খেয়ে, না খেয়ে পাতার পর পাতা লিখে গেছেন। হয়তো মহৎ কোনো সাহিত্য হয়নি সেগুলো। তবে আজ যখন তিনি দুনিয়া থেকে বিদায় নিচ্ছেন, তখন আপনি বা আমি তাঁকে একলহমায় ‘বাতিল’ করে দিতে পারি না। সভ্য লোকের কাজ এটা নয়। এই বিশেষ দিনে আমরা কেবল তাঁকে তাঁর এই ‘ডেডিকেশন’-এর জন্য শ্রদ্ধা জানাতেই পারি। অশ্রদ্ধা প্রকাশ সংবেদনশীল মানুষের কাজ নয়।

সমরেশ মজুমদারের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ আছে। তিনি বামপন্থাকে পুঁজি করে জনপ্রিয় লেখক হয়েছেন। নকশাল আন্দোলনকে ‘ক্যাশ’ করেছেন, আজগুবি গল্প ফেঁদেছেন। এ রকম অভিযোগ আছে বাংলাদেশের কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদকে নিয়েও। তিনি মধ্যবিত্তের আবেগ বিক্রি করেছেন। উপন্যাস লেখেননি, ‘অপন্যাস’ লিখেছেন ইত্যাদি।

হুমায়ূন আহমেদ

এগুলো নিয়ে কথা বলাটা কোনো সমস্যা নয়। বরং সাহিত্য সমালোচনা জরুরি। সমস্যা হচ্ছে, এই কথাগুলো বলার জন্য তাঁদের জন্মদিন বা মৃত্যুদিনই কেন বেছে নিতে হবে? কেন যে কেউ কেউ এই বিশেষ দিনগুলোতে ওই অসংবেদনশীল কথাগুলো বলার জন্য ঘাপটি মেরে থাকেন!

যিনি আজ মারা গেলেন বা যাঁর আজকে জন্মদিন, সেই ঔপন্যাসিকের অসংখ্য ভক্ত, পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব আছে। এই দিনটা ওই মানুষগুলোর কাছে বিশেষ কিছু। এদিনে তাঁরা শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁদের প্রিয় মানুষ, কাছের মানুষটাকে স্মরণ করতে চান, বরণ করতে চান। কিন্তু সমালোচকদের বিরূপ মন্তব্য তাঁদের দুঃখ ও শোকই কেবল বাড়িয়ে দেয়। এর বেশি কিছু করতে পারে না।

এই প্রবণতা একপ্রকার সাইবার বুলিং। হুমায়ূন আহমেদ যে কালের বিচারে টিকবেন না, সস্তা লেখা লিখেছেন—কথাটা কেবল আমাদের মনে পড়ে ১৩ নভেম্বর আর ১৯ জুলাই, তাঁর জন্ম আর মৃত্যুদিনে। এই প্রবণতা কেবল আমজনতার নয়, বড় বড় সাহিত্যিকের মধ্যেও দেখা যায়।

একজন জনপ্রিয় ঔপন্যাসিকের মৃত্যুর দিনে তাঁকে নিয়ে অসম্মানজনক মন্তব্য করা ভদ্রতাজ্ঞানের বাইরের একটা বিষয়। কারও মৃত্যুদিনে আমাদের উচিত ওই মৃত ব্যক্তির প্রতি সমবেদনা জানানো। পাঠক হিসেবে তাঁর লেখা আমাদের পছন্দ হতেও পারে, না–ও পারে। কিন্তু আমরা তো ‘এমপ্যাথি’ দেখাতে পারি। অনলাইন বা অফলাইনে সহানুভূতির সংস্কৃতি গড়ে তোলার চেষ্টা করতে পারি।

ভালো কিছু বলতে না পারলে চুপ করে থাকতে পারি। তাতে এটা অন্তত প্রকাশ হবে না যে মানুষ হিসেবে আমরা অসংবেদনশীল।